শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খেলাধুলা

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে

নাভিদ হাসান | প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০২ এএম

ছোট্ট লিওনেল মেসি, শৈশবে পড়েছেন মাত্র। তবে বলের সঙ্গে তার সখ্য সেই সময় থেকেই। তাও কি ধরনের জানেন? ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে থাকা মেসি যে ধরনের খেলত, ঠিক তেমনটাই। এই তো শেষ আটের ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে যে রিভার্স পাসে প্রতিপক্ষের রক্ষনকে যেভাবে খাবি খাইয়েছিলেন, সেটা তো সেই পিচ্চি মেসিও করে দেখাতো আরও ২৭ বছর আগে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সেই চলমান চিত্র সবাই দেখেছে বটে। গতরাতে লুসাইলের আইকনিক স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনার জাতীয় সংগীতে গলা মেলালেনোর আগে হয়তো শেষবারের মতো বিশ্বকাপের মঞ্চে নামলেন তিনি। রেফারির খেলা শুরুর বাঁশি বাজতেই একটি রেকর্ড গড়ে ফেললেন লিওনেল মেসি। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ২৬ ম্যাচ খেলার মালিক বনে গেলেন আর্জেন্টাইন মহাতারকার। ছাড়িয়ে গেছেন ২৫ ম্যাচ খেলা জার্মানির ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক লোথার ম্যাথাউসকে। আর ম্যাচে কি করলেন তিনি? জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি গোল করে ৩৬ বছর পর দেশকে জেতালেন শিরোপা। শব্দের মাধ্যমে একটু ধরা যাক মেসিকে, যদিও তা বড়ই কঠিন।
গতরাতে দুইবার পিছিয়ে পড়েও যেভাবে আর্জেন্টিনা তাদের স্নায়ুচাপ ধরে রেখেছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। আর এমি মার্তিনেজ অতিরিক্ত সময়ের একদম শেষ মুহুর্তে এবং টাইব্রেকেরা যে দুইটা সেভ করেছেন তাতেই পূর্ণতা আসে মেসির বর্ণাঢ্য ফুটবল ক্যারিয়ারের। গোটা আর্জেন্টাইন দলই চাচ্ছিল মেসির জন্য বিশ্বকাপটা জিততে। এবারের বিশ্বকাপ শুরু থেকে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বলেছিলেন মেসির হাতে বিশ্বকাপ না উঠাটা দুঃখজনক। সাত বারের ব্যালন ডি-অর জয়ী শিরোপা দাবি করেন। স্বয়ং কাতার বিশ্বকাপের স্থানীয় কমিটির প্রধান হাসান আল তাওহীদী কথা বলেছিলেন ঠিক ইনফান্তিনোর সুরেই। যখন সারা জাহান চায় মেসির হাতে বিশ্বকাপ তখন সৃষ্টিকর্তা আর তাতে বাধ সাধলেন না। মেসির হাত ধরে আর্জেন্টিনা পেল তাদের ইতিহাসের তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা।
আট বছর আগের কথা, ব্রাজিলে ফাইনাল ম্যাচে জার্মিনির বিপক্ষে ১-০ ব্যবধানে হেরে শিরোপার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মেসির করুণ ছবিটার কথা কি মনে আছে? কি ফেলফেল চোখে তাকিয়ে ছিলেন সোনালী শিরোপাটার দিকে। আহা! সেদিন কি কেঁদে উঠেনি ফুটবল ইশ্বরের মনটা? নিশ্চয়ই উঠেছিল। তা না হলে এই দারুণ চিত্রনাট্য কেন সাজাবেন তিনি আট বছর পর মুরুর বুকে? ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে ফাইনালে ওয়েস্ট জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে জিওফ হার্স্টের পর আবারও হ্যাটট্রিক করলেন কিলিয়ান এমবাপে। গত রাতের সেই মনোমুগদ্ধকর ফাইনালে। কিন্তু ওই যে সৃষ্টিকর্তা এবার ভিন্ন কিছু চাচ্ছিলেন, তাই সোনালী শইরোপা এবার মেসির হাতেই গেল। অন্য কারও হাতে যে শোভাই পেত না।
ম্যাচসংখ্যার পাশাপাশি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি সময় খেলার রেকর্ডও গড়ছেন মেসি। চারটি বিশ্বকাপ খেলার পথে জার্মানির পাওলো মালদিনি মোট ২ হাজার ২১৭ মিনিট খেলেছিলেন। আজ ফাইনালের পর মেসি খেলেছেন মোট ২ হাজার ৩১৪ মিনিট। জার্মানির ২০০৬ থেকে শুরু করা মেসির এটি টানা পঞ্চম বিশ্বকাপ। এবারের আসরে আর্জেন্টিনার হয়ে প্রতিটি মিনিটই তিনি মাঠে ছিলেন। সর্বোমোট ৭ গোল করে আর ৩ এসিস্ট করে আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের দুঃখ মোচন করলেন।
কাতার বিশ্বকাপে অসাধারণ পথচলায় আরেকটি কীর্তি গড়লেন লিওনেল মেসি। প্রায় একশ বছরের বিশ্বকাপ ইতিহাসে যেখানে পা পড়েনি আর কারও। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্ব মঞ্চে গোল ও এসিস্টের হিসেবে মোট ২১ গোলে সম্পৃক্ত রইলেন তিনি। ১৯ গোলে সম্পৃক্ত থেকে মেসির পরে আছেন তিন জন- জার্মানির জার্ড মুলার, মিরোসøাভ ক্লোসা ও ব্রাজিলের রোনালদো। তবে এসকল ব্যক্তিগত প্রাপ্তির চেয়ে মেসির কাছে বহু গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিশ্বকাপ শিরোপাটা। সেটা হাতে পেয়ে যে তার ফুটবল জীবনটাই পূর্ণতা পেল।
সময়টা ২০১৬, ইউরো ফাইনালে শিরোপাটা উঠেছিল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হাতে। ঠিক সম-সাময়িক ফুটবলার মেসির ক্যারিয়ারে তখনও জাতীয় দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিরোপা শূন্য। এরপর গড়িয়েছে বহু সময়। মেসি নিজেকে ভেঙ্গে গড়েছেন নতুন ভাবে। এক ইয়াতালিয়ান চিকিৎসকের সরণাপন্য হয়ে বদলালেন খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা। ধীরে ধীরে স্নায়ু চাপ সামলে নিতে শিখে গেলেন। রাশিয়া বিশ্বকাপে ভালো দল নিয়ে ব্যর্থ হলো আলবিসেলসেস্তারা, তখনই জানতেন যে ২০২২ সালে বয়সটা যাবে ৩৫ ছাড়িয়ে। কিন্তু দৃঢ প্রতিজ্ঞ মেসি। আর্জেন্টিনা পেল লিওনেল স্কালোনির মত একজন সময়পোযোগী ম্যানেজার। টোটাল ফুটবলের টোটকায় হঠাৎই বদলে গেল গোটা আর্জেন্টিনা। অন্যদিকে লিওনেল মেসি হয়ে উঠলেন অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি কার্যকরী। কোপা আমেরিকার শিরোপা জেতার পরই বিশ্বকাপের স্বপ্ন বিভোর হয়ে উঠলো লাতিন আমেরিকার দেশটি, সঙ্গে গোটা পৃথিবীর আকাশি-নীল সমর্থকরা। ফুটবল ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে সেই কোটি সমর্থকদের সকল দাবি দাওয়া পূরণ করলেন ‘এলএম১০’।
ডিয়াগো ম্যারাডোনার মাধ্যমেই আর্জেন্টিনার ফুটবলে শুরু হয় এক নতুন যাত্রা। ম্যারাডোনার নশ্বর শীারটা নেই, তবে তিনি তো অবিনশ্বর তাঁর ফুটবল কীর্তিতে। নক্ষত্র হয়ে আকাশ থেকে ঠিক দেখলেন লুসাইলে তার উত্তরসূরী মেসির কীর্তি। অন্যদিকে গোঞ্জালো মন্তিয়াল যখন টাইব্রেকারের চতুর্থ শটটি জালে জড়ালেন তখন মেসির ভেতরটায় কি চলছিল? অন্তর্জামী হয়ে তা জানার উপায় নেই। তবে বঙ্গোপোসাগরের এই পাড়ে বসে মনে হচ্ছিল তিনি কেবল ম্যারাডনাকেই খুঁজছিলেন, তার কাছে বাকি সবই শূন্য ছিল তখন। আর হয়তো গোটা আলবিসেলেস্তাদের মনে-মনে বলছিলেন ‘আমি পেরেছি ডিয়াগোর ল্যেগাছি বহন করতে। এই বিশ্বকাপের বাটে আমার চিহ্ন আর পড়বে না তবে তার সোনালী শিরোপায় আমি খোদাই করে রাখলাম আমার নাম! আমি আর্জেন্টিনার হয়ে ফুটবল পায়ে আমার সবটুই উজাড় করে তোমাদের জন্য সর্বোচ্চ সাফল্য এনে দিলাম...

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন