ইনকিলাব ডেস্ক :সুপরিচিত ভারতীয় অভিনেতা ওম পুরী মারা গেছেন। মুম্বাইয়ের বাসভবনে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল ৬৬ বছর বয়সী এই অভিনেতার। ২০১৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি ঠিক যেভাবে মৃত্যু হওয়ার কথা বলেছিলেন, অনেকটা সেভাবেই গতকাল সকালে মারা গেলেন ওম পুরী। আর চলচ্চিত্র পরিচালক খালেদ কিদওয়াই এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন কীভাবে কেটেছিল ওম পুরীর শেষ সন্ধ্যা।
১৯৫০ সালে হরিয়ানার আম্বালায় এক হিন্দু-পাঞ্জাবী পরিবারে জন্মহয় ওম পুরীর। তার বাবা ভারতীয় রেল ও তার আগে সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। হিন্দি ছাড়াও অনেক ভারতীয় ভাষা এবং ব্রিটিশ ও হলিউডি ছবির সঙ্গে পাকিস্তানের ছবিতেও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চার দশক ধরে অভিনয় করেছেন মি. পুরী। দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা আর তার পরে পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করেন ওম পুরী।
দিল্লির এনএসডি-তে আরেক বিখ্যাত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ ছিলেন ওম পুরীর সহপাঠী। সেই সময়ে খুব কম অভিনেতারই নাট্য-অভিনয়ের প্রথাগত শিক্ষা বা ডিগ্রি ছিল। ১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন ওম পুরী। ‘ঘাঁসিরাম কোতোয়াল’ নামের মারাঠি ভাষায় তৈরি ছবিটি-ই তার অভিনীত করা প্রথম চলচ্চিত্র। তার পরের চল্লিশ বছরে ‘অর্ধ-সত্য’, ‘সদগতি’, ‘আস্থা’, ‘আক্রোশ’, ‘মির্চ মসালা’, ‘জেনেসিস’ বা ‘ধারাভী’র মতো সমান্তরাল ছবিতে যেমন অভিনয় করেছেন, তেমনই বহু হিট বলিউডি বাণিজ্যিক ছবিতেও একই রকম স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি।
‘ডিস্কো ড্যান্সার’ থেকে শুরু করে ‘চাচী ৪২০’, ‘চায়না গেট’, হেরাফেরি’, ‘মালামাল উইকলি’, ‘রং দে বাসান্তি’, ‘দাবাং’-এর মতো জনপ্রিয় ছবিতেও তাকে দেখা গেছে নানা ধরনের চরিত্রে।
নিজের মৃত্যু সম্পর্কে কথা বলেছিলেন ২০১৫ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে। সে বছর মার্চ মাসে তিনি বলেছিলেন, ঘুমের মধ্যেই হয়তো মৃত্যু আসবে তার।
‘মৃত্যুটা তো বুঝতেই পারে না কেউ। ঘুমের মধ্যেই হয়তো চলে যাব। আপনারা হয়তো জানতে পারবেন সকাল সাতটা বাইশ মিনিটে ওম পুরী মারা গেছেন,’ কথাগুলো বলেই হেসে ফেলেছিলেন মি. পুরী। ঘটনাচক্রে তার মৃত্যু অনেকটা সেভাবেই হয়েছে।
তার কথায়, ‘মৃত্যুর ভয় নেই। অসুস্থ হয়ে পড়াটা আরও ভয়ের। যখন দেখি মানুষ অসুস্থ হয়ে গিয়ে চলাফেরা করতে পারে না, অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, আমার সেটাতেই বড় ভয়’।
বিভিন্ন রকম চরিত্রে সাবলীল অভিনয় দক্ষতা, গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর এই দুটোই ছিল ওম পুরীর মূল সম্পদ। সেজন্যই গোটা মুখে বসন্তের দাগ থাকা সত্ত্বেও তাকে সত্যজিৎ রায়, গোবিন্দ নিহালনী, শ্যাম বেনেগাল, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষরা যেমন নিজের ছবির জন্য ডেকেছেন, তেমনই ডেকে নিয়েছেন ‘গান্ধী’ ছবির জন্য রিচার্ড অ্যাটেনবরো বা ‘সিটি অফ জয়ের পরিচালক রোল্যান্ড জফ।
রাজকুমার সন্তোষী, কমল হাসান, সুভাষ ঘাই বা প্রিয়দর্শনের মতো জনপ্রিয় হিন্দি ছবির পরিচালকরাও তাকে রেখেছেন নিজেদের হিট ছবিগুলোতে। আবার ‘ওয়েস্ট ইজ ওয়েস্ট’ বা ‘ইস্ট ইজ ইস্ট’-এর মতো আন্তর্জাতিক ছবিতেও কাজ করেছেন ওম পুরী। বিবিসির টেলিভিশন নাটক ‘দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস’এ-ও অভিনয় করেছিলেন তিনি।
কীভাবে কেটেছিল ওম পুরীর শেষ সন্ধ্যা?
চলচ্চিত্র পরিচালক খালেদ কিদওয়াই বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত ওম পুরীর শেষ সন্ধ্যায় তিনিই ছিলেন অভিনেতার সঙ্গে। মি. পুরীর ফ্ল্যাটে বিকেলে গিয়েছিলেন মি. কিদওয়াই। সেখানে কিছু কাজ সেরে একটি অনুষ্ঠানে এক সঙ্গেই গিয়েছিলেন দু’জনে। নিজের গাড়িতেই ওম পুরীকে নিয়ে গিয়েছিলেন মি. কিদওয়াই। সেখানে হাজির অন্য কয়েকজনের সাথে গল্প করতে করতেই একটু মাথা গরম করে সেই বাড়ি থেকে মি. কিদওয়াইকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যান ওম পুরী। মাঝে হঠাৎই তার ইচ্ছে হয় ছেলে ঈশান্তের সঙ্গে দেখা করার। মি. পুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী ছেলে ঈশান্তকে নিয়ে আলাদাই থাকেন। ছেলের ফ্ল্যাটের কাছে পৌঁছে ঈশান্তকে ফোন করে বাড়ি আসতে বলেন ওম পুরী। ছেলে ততক্ষণে সেই অনুষ্ঠানে চলে গিয়েছিল, যেখান থেকে কিছুক্ষণ আগে রাগ করে বেরিয়ে এসেছেন ওম পুরী।
মি. কিদওয়াই বলছেন, ‘বেশ ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন ওম পুরী। বেশ পানও করেছিলেন তিনি। ওই ফ্ল্যাটে গিয়েও আরও এক পাত্র পাণীয় ঢেলে নেন নিজের জন্য। বারণ করেছিলাম আমি, কিন্তু উনি বললেন, ছেলে ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে করতে এটা খাব। ততক্ষণে যদি ও না ফেরে, তাহলে চলে যাব বাড়ি।
‘রাত প্রায় এগারোটা পর্যন্ত ছেলে ওই পার্টি থেকে আসেনি। তখন মি. পুরীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি, বলি যে চলুন এবার রাতের খাবার খেয়ে নেয়া যাক। উনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিই যখন, তখন প্রায় সাড়ে ১১টা বাজে’।
নিজের বাড়িতে ফিরে গাড়ি পার্ক করার সময়ে মি. কিদওয়াই খেয়াল করেন যে, ওম পুরী নিজের টাকার পার্সটা গাড়িতেই ফেলে গেছেন। অত রাতে আর ফোন করে বিরক্ত করেননি অভিনেতাকে।
‘আজ (শুক্রবার) সকালে সাড়ে ৬টায় ফোন করেছিলাম। কিন্তু কেউ ফোন তোলেনি। ভিসা নেয়ার জন্য যে উনি দূতাবাসে যাবেন ৯টায়। তাই তার গাড়িচালককে ফোন করি আমি। সে জানায় সকাল সাতটায় মি. পুরীর ফ্ল্যাটে পৌঁছে যাবে সে। আর যাওয়ার পথে আমার এখান থেকে ঘুরে যাবে, টাকার পার্সটা নিয়ে নেবে। আমি তারপরে জেগেই ছিলাম। সকাল ৮টা নাগাদ গাড়ির চালকের ফোন পাই। তখনই খবরটা জানতে পারলাম,’ বলছিলেন খালেদ কিদওয়াই।
চলচ্চিত্র জগতে তার অবদানের জন্য ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন ওম পুরী। সূত্র : বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন