ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ইন্ডিয়ার প্রখ্যাত বাঙালি লেখক। তিনি বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির অমিয় সম্ভাবনা দেখেছেন। তবে সেই সঙ্গে তিনি তার দেশে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতির জন্য অশনি সংকেত দেখেছেন। আর এক প্রখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশও একই কথা বলেন। সুনীলের একটি নামকরা বই হলো ‘আমি কি বাঙালি?’ তিনি এই বইয়ের এক স্থানে (পৃষ্ঠা ২৭-২৮) কবি জীবনানন্দের উদ্ধৃতি এনে ভাষা সংস্কৃতি বিষয়ক হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। জীবনানন্দ লিখেছেন, “অনুপাতে কম হলেও ভাষার (ও সাহিত্যের) ওপর একটা অবক্ষয়ের চাপ পশ্চিম বাংলায়ও ক্রমে ক্রমে দেখা দেবে মনে হয়। এখনই দেখা দিচ্ছে। বাংলা একদিন কোটি কোটি লোকের ভাষা ছিল, বাংলার বাইরে নানা দিকে তার পরিব্যাপ্তি ছিল, মর্যাদা ছিল, কয়েক বছর আগেও দেশের পরিধি প্রায় তিন গুণ বড় ছিল। মননের ও কাজের নানা দিকে বাঙালির ভারতীয় খ্যাতি ছিল। সব কিছুই এত বেশি সঙ্কুচিত হয়ে গেছে, বিপর্যয় এত বেশি, টাকাকড়ির কুশৃঙ্খলা এত কঠিন যে, ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে চিন্তা করার সময় খুব সম্ভব দেশের নেই আজকাল। ভাষা লোকের মুখে ভেঙে গড়ে সাহিত্যিকদের হাতেই বিশেষভাবে অগ্রসর হয়। বাংলার লোকদের অনেকেই আজ উৎখাত এবং প্রায় সব বাঙালিই আজ টাকা ও অন্নের সমস্যায় কাষ্ট পাচ্ছে। বেকার, আধ বেকার, আধপেটা খাওয়া লোক প্রায় ঘরে ঘরে আজ। চাকরি নেই, ঘর নেই, ভাত নেই এ রকম দুঃখ-কষ্ট বাঙালি শিগগির বোধ করেনি। এই সমস্যাই আজ সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলার লোকের হাড়, মাংস, চিত্ত থেকে মুখের ভাষা উপভাষার নতুন নতুন বিকাশের পথ আজ আশা করা কঠিন। যে বাংলা একদিন ভাত, কাপড়ে ঘরে তৃপ্তি পেয়ে গল্প রূপকথা বচন ছড়া ইত্যাদি তৈরি করেছিল বাংলার সেই হৃদয় নেই এখন, সেসব লোক নেই, সে প্রবাদ ছড়া লেখা-লেখন নতুন যুগে কোনো যুক্তিঘন ক্রমবিকাশ লাভ করল না, মরেই গেল মানুষই মরে যাচ্ছে বলে।”
“বাংলার সাধারণ জনতাপট আজ এরকম। এদের সাহিত্য আজ নিস্তব্ধ। সাহিত্যিকদের সাহিত্য বেঁচে আছে অবশ্য; তারই থেকে সাধারণজনও কিছুটা তৃপ্তি সংগ্রহ করে নিজেদের রুচি বৃদ্ধি অনুসারে বাংলাদেশে এখনও বড়, মাঝারি অনেক সাহিত্যিক আছেন।” (জীবনানন্দ দাশ, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’)
সুনীল কবি জীবনানন্দের এসব মন্তব্য নিজস্ব বিনা মন্তব্যে উদ্ধৃত করেছেন। অর্থাৎ তিনি একে মান্যতা দিয়েছেন। ইন্ডিয়ায় বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ বিপন্ন। তা কোণঠাসা। তবে জীবননান্দ বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন সাহিত্যের ব্যাপারে। এটা সুনীলের মতামত হবে। সুনীল লেখেন রাম মোহন বঙ্কিমের আমল থেকেই জাতীয় চেতনার উদ্ভব। আমরা যাকে নবজাগরণ বলি, দেড়শ বছর আগে তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরা। তারা অনেক সৎকাজ করেছিলেন বটে, একটা মারাত্মক ভুলও করেছিলেন। তারা মুসলমানদের কথা একেবারেই মনে রাখেননি। ওই লোকটি বাঙালি না মুসলমানÑ এই নির্বোধ প্রশ্ন প্রায় সব শ্রেণীর হিন্দুদের মুখে শোনা যেত। এখনও মাঝে মাঝে শোনা যায়। এই প্রশ্নের উত্তরে পরবর্তীকালে মুসলমানরা এই হিন্দুদের মুখে একেবারে ঝামা ঘষে দিয়েছে বলা যায়। ১৯৪৭ এর স্বাধীনতার দশ বছর আগেই বোঝা গিয়েছিল, বঙ্গদেশে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা অনেক বেশি।
তিনি আবার লেখেন, ‘অনেক মুসলমানও আগে নিজেদের বাঙালি বলত না, ধর্মীয় পরিচয়টাই ছিল একমাত্র। কিন্তু এই সময় তাদেরও জাতীয় চেতনা জাগে। হিন্দু সদস্যরা সাহেবি পোশাক পরে এসে বক্তৃতায় ইংরেজির ফুলঝুরি ছোটাতেন, লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি পরা গ্রামের মুসলমানরা এখন বক্তৃতা শুরু করেন বাংলায়।’
তিনি লেখেন, ‘মুসলমান না বাঙালি, অনেকটা এই প্রশ্নেই বাংলা ভাগ হলো। তারপর কিছু বছর পর ওই দিকের স্বাধীন রাষ্ট্রটি, আমাদের মতামত না নিয়েই নাম গ্রহণ করল বাংলাদেশ। এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই ধারনা হতে শুরু করেছে বাংলাদেশেই শুধু বাঙালিদের বাস এবং অদূর ভবিষ্যতে কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারে, ভারত নামে দেশটাতেও বাঙালি থাকে নাকি? কিংবা হিন্দুরাও বাঙালি হয়?’ ‘বাঙালি কে? আমি কি বাঙালি’ নিবন্ধন থেকে, পৃষ্ঠা-৪৪)
বাংলার মুসলমানরা বাঙালি না মুসলমান, না মুসলমান বাঙালি এই প্রশ্ন আগে ছিল। তবে এ কথা ঠিক যে হিন্দু ভাইয়েরাও অতীতে নিজেদের বাঙালি বলতে চাইত না, কারণ বাংলা শব্দটা মুসলমানদের দেওয়া। নিজেদের গৌড়জন বলত। মুসলমানরা তো নামের সঙ্গে সেই মধ্যযুগ থেকে বাঙালি পদবি লাগাত। ঢাকার লালবাগের কেল্লায় গেলে দেখবেন যে পরীবিবির কবরের দক্ষিণে ফাঁকা জায়গায় একটা কবর আছে। নামফলকে লেখা মির্জা বাঙালির সমাধি। এ পর্যন্ত কোনো অমুসলমান বাঙালির নামে সঙ্গ বাঙালি উপাধি দেখা যায়নি। সুনীল বাংলাদেশের এই নামকরণের আপত্তি করেছেন। কেন তাদের (ইন্ডিয়ান?) মতামত নেওয়া হয়নি, অথচ তিনি নিজেই বলেছেন যে, বাঙালি মুসলমানই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর জীবনানন্দ দাশ তো ইন্ডিয়াতে বাঙালি ও বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়েই শঙ্কিত।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘আমি কি বাঙালি?’ গ্রন্থে ইতিহাসের পরিহাস শীর্ষক নিবন্ধে লেখেন : “পাকিস্তানের একটা অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ হয়েছে। তবু বাঙালি জাতির মিলনের কোনো চিহ্ন নেই এবং দূরত্ব আরও বাড়ছে। ... বাংলার মিলনের সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে আছে বলেও মনে হয় না। কেউ সে কথা উচ্চারণ করে না। তবে বাংলাদেশে যখন আমাকে বিদেশি অতিথি বলে পরিচয় দেওয়া হয়, তখন কেমন যেন লাগে (পৃষ্ঠা ৬৭)।”
জীবনানন্দ, সুনীল তো নিজেরাই ইন্ডিয়াতে বাঙালি ও বাংলা ভাষা নিয়ে শঙ্কিত, সেখানে দুই বাংলার মিলনের সম্ভাবনা, অচিন্তনীয়। ১৯৪৭ এর পূর্বে কায়েদে আজম, শহীদ সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশেম, শরৎ বসু (সুভাষ বসুর ভাই), বঙ্গবন্ধু স্বাধীন যুক্ত বাংলার পক্ষে কাজ করেছিলেন, কিন্তু মহাত্মা গান্ধী, সরদার প্যাটেল, নেহেরু প্রমুখের কারণে তা সম্ভবপর হয়নি। সুনীলকে বাংলাদেশে স্বাগতম। তবে আইনগত কারণেই তো আর বাঙলাদেশি নাগরিক নন। বেচারা এর ভিতর পরপারে চলে গেছেন। নইলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চাইলে তাকে দেওয়া হতো।
সুনীল বাংলাদেশের টিভি অনুষ্ঠান, বইপুস্তক, পত্র-পত্রিকা ইন্ডিয়াতে প্রবেশের বাধার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন কারও কলাকৌশল, কারও স্বার্থ। কথা ঠিকই। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল সেখানে দেখানো হলে এখানকার পণ্যের বিজ্ঞাপনও দেখাতে হবে। আর এটা সেখানকার পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি ও সরকার চায় না। তারা ইন্ডিয়ার বাংলাদেশ বাজারকে ধরে রাখতে চায়।
দুই দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি বিভক্তই যদিও কেউ কেউ দাবি করেন অভিন্ন, সুনীল তো তার এক সাক্ষাৎকারে বলেই ফেললেন যে, বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের বই ইন্ডিয়ায় না চলার কারণ হলো হুমায়ূনের উপন্যাসের মুসলমানি পটভূমি ও মুসলমানি ভাষা ওখানে চলে না, জনপ্রিয় নয়। তারকাঁটা, ফারাক্কা ইত্যাদি সবকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
সুনীল লেখেন, “চারজন তরুণ ঢাকার রাজপথে রক্ত দিয়েছিল। তাদের এই আত্মদানে অনুপ্রাণিত হয়ে সমস্ত দেশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। তারপর পাকিস্তানি আমলেই বাংলা ভাষা পেয়েছিল রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি।” (পৃষ্ঠা ১৭১)
লাহোর প্রস্তাবের পথ ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষাও করতে পেরেছে। ইন্ডিয়াতে কোনো দিনই বাংলা রাষ্ট্রভাষা হতে পারবে না সংখ্যা তত্ত্বের কারণে। তারা যদি তাদের নেতা শরৎবসুর কথা শুনত, তাহলে আজ আফসোস করতে হতো না।
লেখক : ইতিহাসবিদ, কলাম লেখক ও গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন