বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

নওগাঁর শত বছরের প্যারা সন্দেশ যাচ্ছে বিদেশে

| প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা : নওগাঁর ‘প্যারা’ সন্দেশের সুখ্যাতিও এখন বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশে পৌঁছেছে। এই সন্দেশ যারা তৈরি করেন তারা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারেননি ঠিক কখন থেকে নওগাঁর ‘প্যারা’ সন্দেশের প্রচলন শুরু হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা ও গবেষকরা ধারণা করছেন, নওগাঁয় একশ’ বছরের আগে থেকে প্যারা সন্দেশ তৈরী হচ্ছে। জানা গেছে, শহরের কালীতলা এলাকায় শ্রী শ্রী বুড়ী কালী মাতা মন্দিরের কাছে শত বছর আগে থেকে এই ‘প্যারা’ সন্দেশ তৈরী হতো। এই সন্দেশ পূজারীরা বিভিন্ন পূজা মন্ডপের দেবদেবীর উপাসনার উদ্দেশ্যে মন্দিরে ভোগ দিতেন। তবে সময়ের ¯েœাতে এখন বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন, আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে পাঠানো বা নিয়ে যাওয়া মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘প্যারা সন্দেশ’ মিষ্টির জগতের অনেক বড় একটি জায়গা দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্যারা সন্দেশ তৈরি হলেও এটি নওগাঁ জেলা শহরে প্রথম শুরু হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গবেষক ও কবি প্রাক্তন অধ্যাপক আতাউল হক সিদ্দিকী জানান, হিন্দু সম্প্রদায় সারা বছর বিভিন্ন পূজা-অর্চনা করে আসেন। প্রতি পূজায় পূজার সময় পূজারীরা মন্দিরে ভোগ দিয়ে থাকেন। এই ভোগের প্রয়োজন মেটাতে শহরের কালীতলায় শত বছর আগে ছোট ছোট মিষ্টির দোকান বসে। এসব দোকান থেকে প্রয়োজনীয় মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যাদি কিনে নিয়ে পূজারীরা মন্ডপে মন্ডপে দেবীর অর্ঘ্য হিসেবে ভোগ দিয়ে থাকেন। দেবীর আরাধনায় মিষ্টির প্রয়োজনেই প্রায় শত বছর আগে এই দোকানীদের পূর্ব পুরুষরা প্রথম তৈরি করেন ‘প্যারা’ সন্দেশ। কিন্তু পরবর্তীতে এই সন্দেশ শুধু দেবির আরাধনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সুস্বাদু আর পুষ্টিগুণের কারণে এই সন্দেশ হয়ে উঠেছে এলাকার বিখ্যাত মিষ্টি হিসেবে। তাই শুধু দেশের মধ্যেই নয়, এটি এখন যায় বিদেশেও। জনশ্রæতি আছে, ভারতের বিহারের কোনো এক নবাবের মিষ্টি তৈরির কারিগর ছিল মহেন্দ্রী দাস। নবাব এক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হওয়ার পর ওই ব্যক্তি প্রাণ নিয়ে নওগাঁ শহরের কালীতলায় বসতি গড়ে। জীবিকার তাগিদে মহেন্দ্রী দাস ‘প্যারা’ সন্দেশ তৈরি করে বিভিন্ন মন্দিরে বিক্রি শুরু করেন। পরে সেখানেই ছোট্ট একটা মিষ্টির দোকান খুলে বসেন। শত বছর আগে তখন কালীতলা এলাকায় জনবসতি ছিল না বললেই চলে। মহেন্দ্রীর পর তার ছেলে ধীরেন্দ্রনাথ দাস দোকানের দায়িত্ব পান। সেই সময় বিমল মহন্ত নামে মিষ্টি তৈরির এক কারিগরের হাতের স্পর্শে ‘প্যারা’ সন্দেশের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ধীরেন্দ্রনাথ দাস প্রায় ৩০ বছর ব্যবসার পর দোকানটি সুরেশ চন্দ্র মহন্তের কাছে বিক্রি করে দিয়ে অন্যত্র চলে যান। এরপর সুরেস চন্দ্র মহন্ত দোকানে নতুন মিষ্টির কারিগর নারায়ণ চন্দ্র প্রামাণিককে আনেন। নারায়ণ সেই থেকে প্যারা সন্দেশ তৈরি করে আসছেন। আবারও ওই দোকানের মালিকানা পরিবর্তন হয়। বর্তমানে দোকানের মালিক বৈদ্য রতন দাস। তবে মিষ্টির কারিগর রয়েছেন সেই নারায়ণ চন্দ্র দাসই। বর্তমানে নওগাঁ শহরে বেশ কয়েকটি দোকানে অন্যান্য মিষ্টির পাশাপাশি ‘প্যারা’ সন্দেশ তৈরী করে থাকেন। এর মধ্যে ‘প্যারা’ সন্দেশ তৈরী করে সুনামও অর্জন করেছেন। শহরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ব্যবসায়ী মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী নাজমুল হক জানান, ‘প্যারা’ সন্দেশ তৈরির প্রথম ধাপে তরল দুধের সাথে চিনি মিশিয়ে জ্বাল কওে তৈরি করা হয় ক্ষীর। ক্ষীর যখন হাতায় জড়িয়ে আসে তখন উষ্ণ ক্ষীর দু’হাতের তালু দিয়ে রোল করে সামান্য চাপ দিলেই তৈরি হয়ে যায় হালকা খয়েরী রংয়ের প্যারা সন্দেশ। তৈরি পদ্ধতি খুব সহজ। প্রতিটি প্যারা সন্দেশ প্রায় আধা ইঞ্চি চওড়া ও দুই ইঞ্চি লম্বা করা হয়ে থাকে। প্রতি কেজিতে ৭৫ থেকে ৮০টি প্যারা সন্দেশ পাওয়া যায়। এক কেজি সন্দেশ তৈরি করতে দরকার হয় ৭ লিটার তরল দুধ। দুধ আর চিনি ছাড়া অন্য কোন উপকরণ না থাকায় এই সন্দেশ স্বাভাবিকভাবে রাখা যায় ১০ থেকে ১৫ দিন। আর কৃত্রিম উপায়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এই সন্দেশ ভালো রাখা যায়। কালীতলা এলাকার প্যারা সন্দেশ দোকানের স্বত্বাধিকারী বৈদ্য রতন দাস জানিয়েছেন, বংশপরম্পরায় এখানকার মিষ্টির কারিগররা নিরবচ্ছিন্নভাবে তৈরি ও সরবরাহ করে যাচ্ছেন নওগাঁর বিখ্যাত ‘প্যারা’ সন্দেশ। দেশের মধ্যে পূজা, ঈদসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানেই শুধু নয় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেও নিয়ে যাওয়া হয় এই সন্দেশ। এছাড়া পার্শ্ববর্তী ভারতসহ বেশ কয়েকটি আত্মীয়স্বজন এখানকার ‘প্যারা’ সন্দেশ নিয়ে যান। বর্তমানে প্রতি কেজি সন্দেশের দাম ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা। আর স্বাদ ও মানের দিক থেকে এই প্যারা সন্দেশ অতুলনীয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন