মো. শামসুল আলম খান : ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ডা: মাহাববুর রহমান লিটন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা বিএনপির আহ্বায়কের পদ বাগিয়ে নেন। দলের ভেতরে-বাইরে তার একচ্ছত্র দাপটে সেই সময়ে অনেকেই ছিলেন কোণঠাসা।
ত্রিশাল উপজেলা বিএনপির সভাপতি হওয়ায় পদাধিকার বলেই তিনি এখন ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি। আন্দোলন-সংগ্রামে এতদিন মাঠমুখী না হলেও ঢাকায় বসে দলীয় রাজনীতিতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতেই এখন উঠেপড়ে লেগেছেন।
আর এজন্যই ‘গাঁটছড়া’ বেঁধেছেন নিজের মতোই পেশায় ব্যবসায়ী দলীয় আরো তিন নেতা জাকির হোসেন বাবলু, মোর্শেদুল আলম ও লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবুর সঙ্গে।
দল পুনর্গঠন প্রশ্নে এ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সঙ্গে মাঠের নেতাদের মতবিরোধ ও বিভক্তি স্পষ্ট হওয়ায় ন্যূনতম সাংগঠনিক অবয়বও হারাতে বসেছে দলটি। দু’বার সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়েও আর সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। কেন্দ্রে লবিংয়ের জোরে মাঠ নেতারাও এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছে না। ফলে ময়মনসিংহে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না দলটি।
দলীয় সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের দিকে কাউন্সিলের মাধ্যমে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির নতুন কমিটি গঠিত হয়। এরপর ২০১২ সালের মার্চে কেন্দ্র থেকে ১৮৪ সদস্যের কমিটি করে দেয়া হয়। ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল গঠন করা হয় উত্তর জেলা বিএনপি র আহŸায়ক কমিটি।
মাস দু’য়েক আগে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সম্মেলন ডেকেও প্রশাসনের বাধায় করতে পারেনি দলটির নেতারা। এরপর আরেক দফা প্রস্তুতি নিয়েও কাজ হয়নি। তবে দু’বারই আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে থাকা নেতারা ঢাকায় বসে চালবাজি করা ওই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সম্মেলন বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ তুলেন।
দলের অনেক নেতাকর্মীর ভাষ্য, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ হিসেবে রয়েছেন ডা: লিটন। আর ‘গেইম মেকার’র দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি এ কে এম মোশাররফ হোসেনের সৎ ছোট ভাই ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বাবলু ওরফে ক্লাসিক বাবলু।
তাদের সিন্ডিকেটে রয়েছেন ‘টাকার কুমির’ হিসেবে পরিচিত পেশায় ব্যবসায়ী মুর্শেদুল আলম ও মাজেদ বাবু ওরফে কালা বাবু। এর মধ্যে ডা: লিটন বাদে অন্যদের ছাত্র রাজনীতির কোনো অভিজ্ঞতা নেই। দলীয় রাজনীতিতেও তাদের বয়সও নেহায়েত কম। আন্দোলন-সংগ্রামে না থেকে নিজেদের ব্যবসা নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকেন বেশি, এমন অভিযোগও রয়েছে।
সূত্র মতে, এ সিন্ডিকেটের নেতারা চান কাউন্সিলের বদলে কেন্দ্র থেকে বিএনপির কমিটি। কাউন্সিল হলে তারা মাঠে টিকতে না পারার আগাম শঙ্কাতেই নিজেদের পছন্দমতো কমিটি বাগিয়ে নিতে চান। আর এজন্যই তারা ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে নিজেদের শক্ত অবস্থার কথা জানান দিচ্ছেন।
তবে মাঠের নেতা হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ, সাবেক সংসদ সদস্য প্রকৌশলী শামসুদ্দিন, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ফখরুদ্দিন বাচ্চু, দক্ষিণের সহ-সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম ওয়ালিদ, ত্রিশাল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন, মুক্তাগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান ও দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক জাকারিয়া হারুন, দক্ষিণের সদস্য ফুলবাড়িয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমানসহ সাবেক ছাত্রনেতাদের বড় একটি অংশসহ অন্য নেতাদের প্রত্যাশা সম্মেলনের মাধ্যমেই হবে নতুন নেতৃত্ব নির্ধারণ।
ত্রিশাল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও স্থানীয় উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন এসব বিষয়ে বলেন, ঢাকায় বসে দল চালানো ব্যবসায়ী নেতারা সম্মেলনকে বাধাগ্রস্ত করছে।
আন্দোলন-সংগ্রামে এরা মাঠে থাকে না। ‘অতিথি’ হয়ে এলাকায় আসে। দল আমাদের চেয়ারম্যান বানিয়েছে। আমরা মাঠে থাকি। কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। এসব নেতারা মূলত ‘ঘরের শত্রæ বিভীষণ’ যোগ করেন এ নেতা।
সূত্র জানায়, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন নিজের ছেড়ে আসা ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসন থেকেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করতে ইচ্ছুক। কিন্তু নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকেই দলীয় টিকিট পাওয়া ছোট ভাই বাবলু তাকে ছাড় দিতে নারাজ। বছরখানেক যাবত এ নিয়েই দুই ভাইয়ের মাঝে দ্ব›দ্ব চলছিল। একজন আরেকজনের ছায়াও মাড়াননি অনেকদিন।
কিন্তু দক্ষিণ জেলা বিএনপির নতুন কমিটি গঠন প্রশ্নে একটি সুপারিশপত্রকে ঘিরে দুই ভাইয়ের মাঝে নতুন করে ‘সমঝোতা’ হয়েছে, এমন দাবি সূত্রের। বিএনপির কেন্দ্রীয় মহাসচিব বরাবর লেখা একটি অভিযোগপত্রে নতুন কমিটির জন্য সুপারিশপত্রে তার স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগ তুলেছেন মোশাররফ হোসেন।
আর তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ জেলা যুবদল সভাপতি শামীম আজাদ এজন্য দায়ী করেছেন দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য প্রকৌশলী শামসুদ্দিন ও সাবেক ছাত্র নেতা, ভালুকা উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফখরুদ্দিন বাচ্চুকে।
তবে বাচ্চু ঠিকাদার হলেও দলীয় রাজনীতিতে তার শ্রম-ঘাম ও ত্যাগ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। আন্দোলনে মাঠে থেকে গুলিবিদ্ধ ও তিন বার কারাবরণের রেকর্ড রয়েছে তার।
এ বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য প্রকৌশলী শামসুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটির জন্য মোশাররফ হোসেন গত ১৯ ফেব্রæয়ারি ১১ ইউনিটের ২২ নেতার স্বাক্ষর করা খসড়া সুপারিশপত্রে নিজে স্বাক্ষর সম্বলিত সুপারিশ করেছেন। হয়তো বা তিনি ভুলে গিয়ে অস্বীকার করছেন। অথবা কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়েই প্রতারণার অভিযোগ তুলছেন।
তিনি বলেন, পয়সা নিয়ে খেলা ব্যবসায়ী নেতারা মাঠে না থাকলেও দলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতের মুঠোয় রাখতে চান। প্রশাসনকে এরাই ভুল বুঝিয়েছে। এদের কারণেই সম্মেলন বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। মাঠে দলীয় নেতাকর্মীদের সমর্থন না থাকায় মূলত তারা চায় কেন্দ্র থেকে কমিটির।
প্রকৌশলী শামসুদ্দিনের কথায় সমর্থন দিয়ে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ ওয়াহিদ বলেন, আন্দোলন-সংগ্রামে না থাকলেও ব্যবসায়ীরা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে নেতৃত্বে আসতে চায়।
কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপোষহীন নেত্রী চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তার নির্দেশিত গঠন-পুনর্গঠন দায়িত্বে নিয়োজিত নেতারা কখনোই দলের স্বার্থ, শক্তি দেখা ছাড়া অন্য কিছু দেখবেন না। যারা দলের জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত হামলা-মামলা উপেক্ষা করে কাজ করছেন তাদেরকেই নেতৃত্বে আনবেন বলে আমি শতভাগ আশাবাদী।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ত্রিশাল উপজেলা বিএনপির সভাপতি ডা: মাহবুবুর রহমান লিটনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
তবে এ বলয়ের দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদুল আলম বলেন, রাজনীতিতে সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। আমাদের মাঝে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু যারা সিন্ডিকেট বলে অপপ্রচার করছে, তারা অতিরঞ্জিত করে এসব বলছে। আর এ মহলটিই দক্ষিণের সভাপতির স্বাক্ষর জাল করেছে। কেন্দ্র যদি সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি দেয় তবে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন