মাওলানা মুহাম্মদ ওয়াছেক বিলাহ
\ এক \
অসিয়ত শব্দের অর্থ হলো- মিশ্রণ করা, কল্যাণ কামনা করা। আর শরিয়তের পারিভাষিক অর্থ- মৃত্যুর পরের জন্য নিজের মালিকানা কিছু অংশ বিনিময় ব্যতিরেকে কাউকে দিয়ে দেয়া। (মেশকাত) শাব্দিক অর্থে যে কোন কাজ করার নির্দেশ প্রদানকে অসিয়ত বলা হয়। পরিভাষায় ব্যক্তি বিশেষের মৃত্যুর পরে সম্পাদন করার জন্য মৃত্যুকালে যে নির্দেশ দেওয়া হয় তাকেই অসিয়ত বলা হয় (তাঃমাঃ কোরআন)
ইসলামের প্রাথমিক যুগে যতদিন পর্যন্ত ওয়ারিসের অংশ কোরআনের আয়াত দ্বারা নির্ধারিত হয়নি ততদিন পর্যন্ত মৃত্যুর পথযাত্রী তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ পিতা-মাতা এবং আত্মীয়স্বজনের জন্য অসিয়ত করে যেতেন। অবশিষ্ট সম্পত্তি সন্তানদের মধ্যে বণ্টন করা হতো। মীরাছের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর যেসব ওয়ারিসের নাম সম্পদ নির্ধারিত হয়েছে তাদের নামে অসিয়ত করা বাতিল হয়ে গিয়েছে। নির্ধারিত ব্যক্তিবর্গ অসিয়তকৃত সম্পদ ফেরত দিল। যেমন সুদের কঠোর বিধান অবতীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে আব্বাস বিন আবদুল মোতালেব সর্বপ্রথম অমুসলিমদের নিকট বিরাট অংক পাওয়া ছিল তা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। “যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ মত চলে তিনি তাকে জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন, সেগুলোর তলদেশে দিয়ে স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হবে। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। এগুলো বিরাট সাফল্য যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্যতা করে এবং তার সীমা অতিক্রম করে তিনি তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সে সেখানে চিরকাল থাকবে। তার জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।” (সূরা নিসা : ১৩, ১৪)
কোন ওয়ারিসের জন্য অসিয়ত করলে তা কার্যকর হবে না। যদি কেউ পুত্র, কন্যা, স্বামী অথবা স্ত্রীর জন্য কিংবা এমন কোন ব্যক্তির জন্য অসিয়ত করে যে ত্যাজ্য সম্পত্তি অংশীদার তবে এ অসিয়তের কোন মূল্য নেই। ওয়ারিসরা শুধু ওয়ারিসী স্বত্বের অংশ পাবে। এর অতিরিক্ত তারা কোনো কিছুর অধিকারী নহে, রাসূল (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেন : আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক হকদারকে তার হক দান করেছেন। অতএব কোনো ওয়ারিসের জন্য অসিয়ত চলবে না। “আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক হকদারের হক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং এখন থেকে কোনো ওয়ারিসের পক্ষে অসিয়ত করা জায়েজ নয়”। (তিরমিজি)। কোনো ওয়ারিসের জন্য সে পর্যন্ত অসিয়ত জায়েজ হবে না যে পর্যন্ত অন্য ওয়ারিসগণ অনুমতি না দেয়, (জেস্সাস) হযরত আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেছেন, আমি রাসূল (সা.)-কে বিদায় হজের ভাষণে বলতে শুনেছি আল্লাহ প্রত্যেক হকদারকেই তার হক দিয়ে দিয়েছেন সুতরাং কোন ওয়ারিসের জন্যই কোন অসিয়ত নেই। (আবু দাঊদ, ইবনে মাজা) হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি (অধিক পরিমাণ) অসিয়ত দ্বারা তার ওয়ারিসদের মীরাছের অংশ কমিয়ে ফেলেছে কিয়ামত দিবসে আল্লাহতায়ালা তার বেহেশতের মীরাছের অংশ কমিয়ে দেবেন। (ইবনে মাজা) হযরত আবু ওমামা (রা.) থেকে বর্ণিত আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে এরূপ বলতে শুনেছি। নিশ্চয় আল্লাহ সকল হকদারের জন্য তার হক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কাজেই ওয়ারিসের জন্য কোন রূপ ওসিয়ত করা যাবে না, (আবু দাউদ) “যদি সে উত্তম অসিয়ত রেখে, মা-বাবা ও নিকট আত্মীয়দের জন্য, মীরাছের আয়াত দ্বারা রহিত হয়ে গিয়েছে। (কোরআন) (কেননা মীরাছের আয়াতে উত্তরাধিকারীদের অংশ স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে)। হযরত আমর ইবনে খারিজা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন আল্লাহর রাসূল (সা.) খুৎবায় বলেন, আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক হকদারের হক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর ওয়ারিসের জন্য অসিয়ত জায়েজ নয় (নাসাই শরীফ) হযরত ইবনে খারিজা (রা.) বর্ণিত যে, তিনি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে দেখলেন যে, তিনি নিজের সওয়ারীর উপর থেকে লোকদের খুৎবা দিচ্ছেন। তখন ঐ সওয়ারী জাবর কাটছিল এবং তার মুখ থেকে ফেনা বেয়ে পড়ছিল। তিনি তার খুৎবায় বললেন, আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক লোকের মীরাছের হিসসা ভাগ করে দিয়েছেন, কাজেই ওয়ারিসের জন্য অসিয়ত জায়েজ হবে না। (নাসাই শরীফ) হযরত আমর ইবনে খারিজা (রা.) থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক হকদারের অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, এখন তার ওয়ারিসের জন্য অসিয়তের সুযোগ নেই। (নাসাই শরীফ) আপনি আপনার নিকট আত্মীয়দের সতর্ক করে দিন। (কোরআন) এ আয়াত নাজিল হলে আল্লাহর রাসূল (সা.) কোরাইশদের ডাকলেন তারা জমায়েত হলে প্রথমে সাধারণ লোকদের কে পরে নিজের আত্মীয়দেরকে সতর্ক করে বললেন, কোরআনের নির্ধারিত আদেশ অমান্য করলে কেও শাস্তি থেকে বাঁচতে পারবে না। আমিও তাকে রক্ষা করতে পারব না।
হযরত আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, যে তার ওয়ারিস কে মীরাছ দেয়া থেকে মাহরুম (বঞ্চিত) করে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জান্নাতের মীরাছ থেকে মাহরুম রাখবেন। (ইবনে মাজা) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, কোন লোক তার সত্তর বছরব্যাপী ভালো কাজ করে অতঃপর যখন অসিয়ত করে তখন সে তার অসিয়ত জুলুম করে। এতে তার জীবন শেষ হয় খারাপ কাজের সাথে। পরিণামে সে জাহান্নামে যায়। কোন লোক সত্তর বছর যাবৎ খারাপ কাজ করে। অতঃপর সে তার অসিয়তের বেলায় ইনসাফ করে। এতে তার জীবন শেষ হয় ভালো কাজের সাথে, ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করে। (ইবনে মাজা) হযরত কুররা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, যার মৃত্যু এসে যাবে তখন সে অসিয়ত করবে, আর তার অসিয়ত আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী হবে তাহলে তা সে তার জীবনে যে জাকাত ছেড়ে দিয়েছে তার কাফ্ফারা হয়ে যাবে। (ইবনে মাজা) কোন ওয়ারিসের জন্য অসিয়ত করলে তা কার্যকর হবে না। যদি কেউ পুত্র, কন্যা, স্বামী অথবা স্ত্রীর জন্য কিংবা এমন কোন ব্যক্তির জন্য অসিয়ত করে যে ত্যাজ্য সম্পত্তিতে অংশীদার তবে অসিয়তের কোন মূল্য নেই। ওয়ারিসরা শুধু ওয়ারিসী স্বত্বের অংশ পাবে। এর অতিরিক্ত তারা কোন কিছুর অধিকারী নয় রাসূল (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেন; আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক হকদারকে তার হক হকদান করেছেন। অতএব ওয়ারিসের জন্য অসিয়ত চলবে না। (তাঃমাঃ কোরআন)
অসিয়তের দলিলভিত্তিক আলোচনা কোরআন ও হাদিসে আরো ব্যাপক যা এই স্বল্প পরিসর লিখায় লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নহে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শরিয়তভিত্তিক অসিয়ত না হওয়ায় কি পরিণতি হচ্ছে বাস্তবতার নিরিখে তার ২/১টা উদাহরণে সহজে বুঝা যায়। ছেলে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তার পিতা অসুস্থ। অসুস্থ পিতার চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন ঢাকায়। চিকিৎসা ও খেদমত উভয় চলছে। অসুস্থ পিতাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অধ্যাপক নিজের নামে পিতার সব সম্পত্তি লিখিয়ে নিলেন। ভাই-বোনেরা শুনে অগ্নিশর্মা।
অধ্যাপক সাহেবকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, পিতা অসুস্থ থুরথুরে বৃদ্ধ। আমার অনুপস্থিতিতে অন্য কাকেও আমাদের জাগা-জমি দিয়ে দিতে পাবেন। তাই আমি এমন করেছি। পিতার সম্পত্তি তোমরা যে, যা পাবে তা আমি ফেরত দিয়ে দেব। আজ দেব কাল দেব এভাবে বিলম্ব করায় ছোট ভাই একটি লাঠি নিয়ে গেল স্টিমার ঘাট। অধ্যাপক সাবেক তখন ঢাকা আসার জন্য অন্যান্যদের সাথে স্টিমারের জন্য অপেক্ষমাণ, সমবেত সকলের সামনে অধ্যাপককে বলে আমাদের সম্পত্তি আমাদেরকে ফেরত দিচ্ছেন না কেন? অধ্যাপক সাহেব দেখেন অবস্থা বেগতিক। তখন স্টিমার ঘাট থেকে সরাসরি সাব রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে ভাই-বোনদের সম্পত্তি ফেরত দিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন