সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অভিমত

প্রকাশের সময় : ৩ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন একুশে সাহিত্য পুরস্কার
মুজিবুর রহমান মুজিব : অমর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস, বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চেতনার উৎস। বাংলা ও বাঙ্গালির স্বাধীনতার সোপান। উনিশ’শ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ভাষা আন্দোলনের শুভ সূচনার লগ্নে মো. রফিক, আব্দুস সালাম, আবুল বরকত এবং আব্দুল জব্বার নিজেদের অমূল্য জীবন উৎসর্গ করেন। সালাম-বরকত রফিক-জব্বারের আত্মবলিদানে ভাষা আন্দোলন তুঙ্গে উঠে তৎকালীন পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল, গণধিকৃত কায়েমী স্বার্থবাদিগোষ্ঠী বাংলা ও বাঙ্গালির আন্দোলনের কাছে মাথানত করতে বাধ্য হয়। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয় সরকার। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারিকে দেশ ও জাতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় শহীদ দিবস হিসেবে উদযাপন করে। জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানগণকে জাতীয় সম্মান সরূপ একুশে পদক-প্রদান করে থাকে। একুশে পদক-স্বাধীনতা পদকের মতো সম্মান ও গৌরবের।
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদের সম্মান ও স্মরণে প্রবাসে স্বাধীনতার সংগঠক ও বাঙ্গালির অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের নিরন্তর সৈনিক, শিল্প-সাহিত্য-ক্রীড়া ও সংস্কৃতি-শিক্ষানুরাগী সৈয়দ রাগিব আলী তার বিশাল শিল্পসা¤্রাজ্যের বিপুল পরিমাণ অর্থ ধর্ম ও মানব কল্যাণে ব্যয় করার লক্ষ্যে উদার পৃষ্ঠপোষকতার মহৎ মানসিকতায় সিলেটের গুণীজনকে সম্মানিত-মূল্যায়িত করার একান্ত ইচ্ছায় গঠন করেছেন রাগিব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন। সৈয়দ রাগিব আলীর দিবারাত্রির মহাকাব্য আজীবন অফুরান প্রেরণার উৎস ছিলেন তার জীবনসঙ্গিনী এ যুগের বেগম রোকেয়া-বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। স্বামী-স্ত্রীর নামেই গঠিত হয় রাগিব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন। সিলেটের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটি, জালালাবাদ রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজসহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান-কোচেয়ারম্যানের গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করেন সৈয়দ রাগিব আলী এবং মহিয়সী নারী-প্রেমময়ী জীবন সঙ্গীনী বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী। সামাজিক মূল্যবোধের মারাত্মক রকমের অবক্ষয়, নৈতিকতার নিদারুন ক্রমাবনতি এবং সামাজিক অস্থিরতা ও অশান্তির মাঝে ও রাগিব-রাবেয়া ছিলেন আদর্শ দম্পতি। ‘লাভ আফ্টার ম্যারেজ’-এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন রাগিব-রাবেয়া দম্পতি। তারা ছিলেন শুধুই দুজনে-দুজনার। মহান আল্লাহর অপার বিশ্বাস ও ভালোবাসায় তারা কঠিন জটিল এই জীবনকে সুখময়-প্রেমময় করে তুলেছিলেন। বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যুর পর সৈয়দ রাগিব আলী নির্বাক-নিস্তব্দ-ভাষাহারা-ছন্দহারা-বিহ্বল-দিশেহারা হলেও তা ছিল সাময়িক। তিনি মহান মালিকের মেহেরবানীতে শোককে শক্তিতে পরিণত করে পুনঃ দেশ ও জাতির কল্যাণে মানবসেবামূলক কর্মকা-ে আত্মনিয়োগ করেন। রাগিব সা¤্রাজ্যের হাল ধরেন।
সিলেটের জ্ঞানী-গুণী-বিদ্বান-বিজ্ঞজনকে সম্মানিত, মূল্যায়িত ও উৎসাহিত করার জন্য সৈয়দ রাগিব আলী প্রতিষ্ঠিত সেবা সংগঠন-রাগিব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন ১৯৯৮ সাল থেকে সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১৪ সাল থেকে একুশে সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে আসছে। শান-শওকত-মানমর্যাদা ও আকারে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাছাড়া এমন আন্তরিক আয়োজন আর নেই। পদকপ্রাপ্তগণকে নগদ টাকা অনুদান এবং সম্মাননা স্মারক পদক প্রদান করা হয়। অদ্যাবদি সাহিত্য পুরস্কারে সাতাশ জন গুণী এবং একুশের পদক ও পুরস্কারে তেত্রিশ জনকে পদক ও পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। সিলেটের জ্ঞানী-গুণী-প-িত-প্রাজ্ঞজনদের মধ্যে যারা পুরস্কার পদক লাভ করেছেন তাদের মধ্যে উপমহাদেশের প্রখ্যাত প-িত ও দার্শনিক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, সুরমা পারের কবি দিলওয়ার, সাবেক সচিব, কবি ও কলামিষ্ট মোফাজ্জল করিম, অধ্যাপক গবেষক মোহাম্মদ আসদ্দর আলী, প্রখ্যাত সাংবাদিক জগলুল আহমদ চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক ঝর্ণাদাশ পুরকায়স্থ, কবি নৃপেন্দ্র লাল দাস, কবি আফজাল চৌধুরী, ইতিহাস গবেষক মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান মুজিব প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
‘একুশে সাহিত্য পুরস্কার-২০১৬’ জাঁকজমকের সাথে অনুষ্ঠিত হয় গেল ২৭ ফেব্রুয়ারি রাগীব নগরে। এবারের একুশে পদক প্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন সুনামগঞ্জের সুসন্তান,বাংলাদেশের প্রবীনতম সাংবাদিক-কলামিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরী, সিলেটের সাহিত্যাকশেই নয় বাংলাদেশের সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক, প্রায় প্রত্যহই মননশীল প্রবন্ধ নিয়ে দেশ ও জাতির সম্মুখে হাজিরা দেন তিনি সেই প্রকৃতি প্রেমি প্রবীণ সাংবাদিক আফতাব চৌধুরী, মৌলভীবাজার জেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ইসলামি চিন্তাবিদ প্রফেসর সৈয়দ ফজলুল্লাহ, একই জেলার কমলগঞ্জ উপজেলাধীন সমশেরনগরের সব্যসাচীলেখক মীর লিয়াকত আলী, ঐতিহ্যবাহী হবিগঞ্জের অনুসন্ধানী-চারণ সাংবাদিক-বিশিষ্ট আইনজীবী মনসুর উদ্দিন আহমদ ইকবাল, বৃহত্তর সিলেটের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ-কবি কালাম আজাদ প্রমুখ। ফাউন্ডেশনের বাছাই কমিটি খুবই আন্তরিক ও দায়িত্ববান। চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে পদকপ্রাপ্তদের নাম নির্ধারণ করেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল শাখায় তাদের মূল্যায়ন করা হয়। সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট বিভাগীয় সদর মৌলভীবাজার হয়ে হবিগঞ্জ পর্যন্ত সিলেট বিভাগের সর্বত্রই প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই সৌভাগ্যবান। পদকপ্রাপ্ত প্রায় সকলেই আমার পরিচিত-সুসম্পর্কযুক্ত। আমার জেলা মৌলভীবাজারে দুইজন এবং নিকট প্রতিবেশী জেলা হবিগঞ্জের মনসুর উদ্দিন ইকবাল, ঢাকা ভার্সিটিতে আমার মাস্টার্স-এর সহপাঠি। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর সৈয়দ ফজলুল্লাহ আর আমি ষাটের দশকে ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের সহপাঠি এবং সেকেন্ড ব্লকের রুমমেট ছিলাম। এক শহরে বসবাস করি বলে বাল্য-কৈশোরের ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের বন্ধন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আরো মজবুত হয়েছে। অনুজ প্রতিম-¯েœহভাজন কবি ও কলামিস্ট লেখক মীর লিয়াকত আছেন আমাদের ভূবনে তার মানব কল্যাণমুখী কাব্যকর্মে-চিন্তায়-চেতনায়। এবারের পুরস্কারপ্রাপ্ত সকল ব্যক্তিই স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্ব স্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল। এই কীর্তিমান-কৃতী পুরুষগণকে সম্মানিত করে সৈয়দ রাগিব আলী যেনো নিজেই সম্মানিত হলেন- সিলেট বাসীকে আরেক দফা কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করলেন। মানবপ্রেমিক সৈয়দ রাগিব আলীকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও সশ্রদ্ধ অভিবাদন। একুশের পদকপ্রাপ্ত গুণীজনকে অভিনন্দন শুভেচ্ছা ও সম্মান-শ্রদ্ধা জানাই।
অগ্রজ প্রতিম পরম শ্রদ্ধেয় সৈয়দ রাগিব আলী ঢাকা-সিলেটের সকল আন্তরিক আয়োজনে অনুগ্রহপূর্বক আমাকে আমন্ত্রণ করেন। আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে দু কথা বলতে বলেন। ২০০৯ সালে সাহিত্য পুরস্কারে আমি সংবর্ধিত-সম্মানিত হয়েছিলাম। আমার জেলা থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি অগ্রজ প্রতিম সৈয়দ আহমদ আলী আজিজের নেতৃত্বে গাড়ির বহর করে আমাকে সিলেট নিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়াও প্রত্যক-রাগীবী আয়োজনে যোগ দেই। ভালোমন্দ দু’কথাবলি। বৃহত্তর সিলেটের বিশিষ্ট মুরব্বী হিসেবে তার কথা ফেলতে পারি না। তার দুইজন ¯েœহভাজন সহকর্মী অগ্রজপ্রতিম মোস্তফা কামাল এবং অনুজপ্রতিম চৌধুরী হারুন আকবর-এর উষ্ণ সান্নিধ্য উপভোগ করতাম একসময়। তারা দুজনই বর্তমানে কবরবাসী। সিলেটে গেলে বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর মাতৃ¯েœহ-বোনের মমতা পেতাম। তিনিও এখন রাগিবনগর তাদের পারিবারিক গোরস্থানে চির শয়ানে। মহান মালিক তাদের বেহেশত নসীব করুন। আয়োজনে দক্ষ সিলেটের ডাকের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক দেওয়ান তৌফিক মজিদ লায়েক এবং ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব মেজর (অব) শায়কুল হক চৌধুরী, সিলেটের ডাকের কার্য নির্বাহী সম্পাদক-ভ্রাতিপ্রতিম আব্দুল হামিদ মানিক দায়িত্ব পালনে বরাবরই আন্তরিক। ফাউন্ডেশন ও পুরস্কারের প্রবর্তক সৈয়দ রাগিব আলীর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু এবং ফাউন্ডেশনের কল্যাণ কামনা করি।
লেখক : সিনিয়র এডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন