পবিত্র শবে বরাত ও রমজানকে সামনে রেখে প্রতি বছরের মতো এবারও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বি গেছে। চাল, ডাল, তেল, চিনি, ছোলা, খেজুর, শাক-সবজিসহ এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। প্রায় প্রতিদিনই পণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি পত্র-পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। তার প্রভাব যে খুব পড়ছে না, তা পণ্যের অব্যাহত উর্ধ্বগতি থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ একাধিকবার বলেছেন, রমজানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে না; স্থিতিশীল থাকবে। এমনকি তাঁর সঙ্গে এক বৈঠকে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সব পণ্যের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে এবং তা অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি। কাজেই সরবরাহের ঘাটতির যুক্তি দেখিয়ে দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। ব্যবসায়ীদের এমন কথা ও যুক্তির পরও কেন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে, তার কোনো সদুত্তর নেই। এ পরিস্থিতিতে যে সত্যটি সামনে এসে যায় তা হচ্ছে, বরাবরের মতোই ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মূল হোতা হিসেবে কাজ করছে। একদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্যের যথেষ্ট মজুদ আছে এবং মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণ নেই, আরেক দিকে ঠিকই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। বলা বাহুল্য, যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হচ্ছে তা ব্যবসায়ীরাই তৈরি করেন। বিষয়টি অনেকটা সর্ষের ভেতর ভূত থাকার মতো। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই হোক বা অন্য কোনো কারসাজির মাধ্যমে হোক, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছে না।
পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অজুহাতের শেষ থাকে না। বিশ্ব বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, ডলারের দাম বৃদ্ধি, আমদানি ও সরবরাহ কম, বিরূপ প্রকৃতিসহ হেন কোনো উছিলা নেই যা তারা ব্যবহার করে না। এবার যেমন হাওর অঞ্চলে বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার উছিলায় চালের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, বৃষ্টির অজুহাতে শাক-সবজির দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ এসব পণ্যসহ অন্যান্য সব পণ্যেরই যথেষ্ট মজুদ রয়েছে বলে বারবার বলা হচ্ছে। এটাও বলা হচ্ছে, রমজানে সারাদেশে নিত্যপণ্যের যে চাহিদা রয়েছে, তার তুলনায় যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। রমজানে পণ্যের চাহিদা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সয়াবিন ও চিনি আড়াই লাখ টন, খেজুর ১৫ হাজার টন, ডাল ৫০ হাজার টন ও পেঁয়াজ তিন লাখ টন প্রয়োজন হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তাহলে দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ থাকতে পারে না। অথচ পণ্য ক্রয় করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। এক চাল কিনতে গিয়েই কেজি প্রতি ৫-৬ টাকা বেশি গুণতে হচ্ছে। দাম বৃদ্ধির কারণে অন্যান্য পণ্য কিনতে গিয়ে মানুষ তার চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে তারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ছে। খাদ্য সংস্থানের মৌলিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এখন তাদের খেয়েপরে বেঁচে থাকার মতো চিন্তা করতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষের এই টানাপড়েনের জীবন থেকে স্বস্তি দেয়ার মতো কোনো উদ্যোগ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আছে বলে মনে হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা যে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে না বলে বাণিজ্যমন্ত্রীকে আশ্বস্থ করেছেন, সে কথা তারা রাখছেন না। নিজেদের একটি অংশের সিন্ডিকেট যে কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, এ ব্যাপারেও নিশ্চুপ রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশে পণ্যমূল্য একবার বৃদ্ধি পেলে তা আর কমতে দেখা যায় না। যে বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধির দোহাই দেয়া হয়, তা কমে গেলেও কমানো হয় না। গত জানুয়ারিতে বিশ্ব বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে লিটার প্রতি ৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়। পরবর্তীতে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমে স্থিতিশীল থাকলেও তা আর কমানো হয়নি। বরং এ দাম আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হাওরে দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার অজুহাতে এখন চালের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে চাল ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে আমদানির প্রস্তাব করেছেন। আমদানির অনুমতিও দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী তাদের ইচ্ছামতো দাম বৃদ্ধি করে যে ফায়দা হাসিল করতে চাচ্ছেন, তা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে বলেছেন, চাল আমদানির অনুমতি দেয়া মোটেও উচিত হবে না। এতে দেশের কৃষক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ আর কয়েক দিন পরই নতুন চাল বাজারে আসবে। তখন ধান-চালের ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে কৃষককে হতাশ হতে হবে। অন্যদিকে সরকার বরাবরই বলছে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোনো ঘাটতি নেই। তাহলে চাল আমদানি করতে হবে কেন? এদিকে একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি গুদামে আপৎকালীন খাদ্য মজুদ প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। অপরিকল্পিতভাবে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি পালন করতে গিয়েই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে মজুদ কম থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওয়ার এলাকায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি বন্ধ রাখা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অনৈতিক কারসাজি ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা এবং কার্যকর উদ্যোগের অভাবে বাজারে পণ্যমূল্য হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্তে¡ও মূল্য কেন উর্ধ্বগামী, অবিলম্বে তার সঠিক কারণ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষকে নির্ণয় করতে হবে। যে সিন্ডিকেটের কথা বছরের পর বছর ধরে শোনা যাচ্ছে, এ সিন্ডিকেটে কারা তা খুঁজে বের করা সরকারের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ করা খুবই সম্ভব। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে পণ্যমূল্য সহনীয় রেখে জনসাধারণকে স্বস্তিতে রাখা। কোনো গোষ্ঠীর কারণে তা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে, তা হতে দেয়া যায় না। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে হবে। এর সাথে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। একটি শ্রেণী অনৈতিকভাবে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে অর্থ আদায় করে নেবে, তা বরদাস্ত করা যায় না। শবে বরাত ও রমজানকে সামনে রেখে পণ্যের যে মূল্যবৃদ্ধি বা বৃদ্ধির কারসাজি, তা কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে প্রতিকার করতে হবে। রমজানে যাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা স্বস্তিতে সিয়াম পালন করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা বাঞ্চনী। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর, টিসিবি, প্রতিযোগিতা কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং বিভাগকে সক্রিয় হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন