রাজধানী ঢাকার কন্ঠহার হিসাবে অতিহিত বুড়িগঙ্গা নদী নির্বিচার দখল ও দূষণে মৃতপ্রায়। বেপরোয়া দখলে এক সময়ের সুবিস্তৃত এই নদী সংকুচিত হয়ে পরিণত হয়েছে মরা খালে। লাগাতার বিপুল বর্জ্য পতনে এর তলদেশ এতটাই ভরাট হয়ে গেছে যে, ভারি নৌযান চলাচল অচলাবস্থায় এসে পৌঁছেছে। পানি কমে গেছে অস্বাভাবিক রকম এবং তা এতটাই দূষিত যে, মাছসহ সমুদয় জলজ প্রাণী মরে সাফ হয়ে গেছে। পানি উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত এবং ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। এ অবস্থা একদিনে হয়নি। দীর্ঘ দিনের অবহেলা, উপেক্ষা ও অবিমৃষ্যকারিতার জন্য বুড়িগঙ্গা কেন্দ্রিক ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে রাজধানী। ‘বুড়িগঙ্গা বাঁচাও,’ নামে পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করছেন অনেক দিন ধরে। সরকারের তরফেও বুড়িগঙ্গা দখল ও দূষণমুক্ত করার অঙ্গীকারসহ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ নদীর অবস্থার কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। দিনকে দিন অবস্থা বরং আরো নাজুক হয়ে পড়েছে। এ পটভূমিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বুড়িগঙ্গায় প্রায় ৬২ রকমের রাসায়নিক বর্জ্য রয়েছে। একই সঙ্গে এন্টিবায়োটিক রয়েছে প্রচুর পরিমানে। এর ফলে ওই পানিতে কোনো ধরনের জলজ-প্রাণীর বসবাসের সম্ভবনা নেই বললেই চলে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে বুড়িগঙ্গার তলদেশে ৮ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত পলিথিনসহ প্লাস্টিকজাতীয় বর্জ্য রয়েছে। রাজধানীর মানববর্জ্য, শিল্পকারখানার বর্জ্য, যান্ত্রিক নৌযানের বর্জ্য সবই এ নদীতে পতিত হচ্ছে। স্মরণ করা যেতে পারে, শুধু বুড়িগঙ্গাই নয়, ঢাকার আশপাশের অন্য সব নদীও প্রায় একই রকম দখল ও দূষণের শিকার। এর আগে নদীগুলো দখলমুক্ত করার যে সব উদ্যোগ নেয়া হয় তা কার্যকর হয়নি। লোক দেখানো দখল উচ্ছেদের পর অল্পদিনের ব্যবধানেই তা পুনর্দখল হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার মতো অন্য নদীগুলোর পানি পান ও ব্যবহার অযোগ্য। কিছু দিন আগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, পানির গুণগত মানের বিচারে যে পাঁচটি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয়, সেই পাঁচটি ক্যাটাগরির একটিতেও বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশের ছয় নদী পড়ে না। এই নদীগুলোর পানি বিষাক্ত এবং পরিশোধনের অযোগ্য। অথচ বাস্তবতা এই যে, এই নদীগুলোর পানি রাজধানীবাসীর পানির অন্যতম উৎস। ঢাকা ওয়াসা এই নদীগুলোর পানি শোধন করে সরবরাহ করছে। এর পরিমান প্রায় ২৫ মিলিয়ন লিটার।
বুড়িগঙ্গাকে দখল ও দূষণমুক্ত করার জন্য অতীতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। দখলমুক্ত করার কর্মসূচী আসলে লোক দেখানো কর্মসূচীতে পর্যবসিত হয়েছে। বুড়িগঙ্গার দুই তীর এখনো সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির দখলে রয়েছে। কবে দখল মুক্ত হবে কিংবা আদৌ হবে কিনা, কেউ বলতে পারে না। দূষণমুক্ত করার কর্মসূচীও ব্যর্থ হয়েছে। বুড়িগঙ্গার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি, নাব্যতা পুনরুদ্ধার, পানির গুনগত মান বৃদ্ধি ও নৌচলাচল সচল রাখার জন্য ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে একটি কর্মসূচী নেয়া হয়। বরাদ্দ ধরা হয় ৯৪৪ কোটি টাকা। পরে সময় বাড়ানো হয় ২০২০ সাল পর্যন্ত। ব্যয় বাড়ানো হয় ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। পরে সময়ের সঙ্গে ব্যয় ২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়। এই কর্মসূচীর কোনো খবর নেই। ফলে এর যে লক্ষ্যসমূহ নির্ধারণ করা হয়েছিল তা কাগজ কলমেই আবদ্ধ হয়ে আছে। বুড়িগঙ্গা পুনর্খনন ও বর্জ্য অপসারনের একটি প্রকল্প নেয়া হলেও তার সুফল পাওয়া যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, পুনর্খননের জন্য বরাদ্দকৃত ৭শ কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। বর্জ্য অপসারনে ২২ কোটি টাকা ব্যয় এবং কাগজ কলমে প্রায় ৬ হাজার ৬১১ ঘন মিটার বর্জ্য অপসারিত হয়েছে বলে বলা হলেও বাস্তবে তা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন কি জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিআইডবিøউটিএর ৪ কোটি টাকার মধ্যে ৩ কোটি টাকা অপচয় হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, বুড়িগঙ্গাকে দখল দূষণমুক্ত করা, তার নাব্যতা বৃদ্ধিসহ পানির মনোন্নয়নের যত উদ্যোগ ও কর্মসূচী নেয়া হয়েছে, তার অংশ বিশেষ কাজ হয়েছে বলে দাবি করা হলেও আসলে কাজের কাজ কিছু হয়নি। এতে মোটা অংকের টাকা লুটপাট ও অপচয় হয়ে গেছে।
বুড়িগঙ্গাকে বলা হয়, ঢাকার ফুসফুস। এই ফুসফুস মারাত্মক জরাক্রান্ত। এর নিরাময় না হলে ঢাকার অস্তিত্ব, তার নাগরিকদের জীবন-যাপন আরও বিপন্ন হয়ে পড়বে। বিশ্বে মানব বসবাসের অনুপযুক্ত নগরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান শীর্ষে। বুড়িগঙ্গা এবং এর আশপাশের অন্য নদীগুলো বাঁচানো না গেলে, এমন এক সময় আসতে পারে যখন পরিবেশগত বিপর্যয় ও পানির অভাবে এ নগর পরিত্যক্ত ঘোষিত হতে পারে। এক তথ্যে জানা যায়, মানববর্জ্য, গৃহস্থালীবর্জ্য ও শিল্প কারখানার বর্জ্যরে মধ্যে প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় পতিত হয় ১০ হাজার ঘনমিটার। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হলে এর দখলমুক্ত করার পাশাপাশি এই বিপুল বর্জ্য পতন শূন্যে নামিয়ে আনার বিকল্প নেই। গত বছর বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগকে দখল ও দূষণমুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ২১ সদস্য বিশিষ্ট একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে যার প্রধান করা হয়েছে নৌবাহিনী প্রধানকে। জানা যায়, নৌবাহিনীর তরফে তিন স্তরের একটি কর্মপরিকল্পনা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে। ১,২ ও ৩ বছর মেয়াদী কর্মপরিকল্পনার রূপরেখায় পর্যায়ক্রমে নদী থেকে ময়লা অপসারণ, নদী দখলমুক্তকরন এবং নদীপ্রবাহ ঠিক রাখতে খনন ও তীর সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এই কর্ম পরিকল্পনা সুচারুরূপে বাস্তবায়িত হলে কাঙ্খিত সুফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। নৌবাহিনী কবে নাগাদ এই কর্মকরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করবে তা জানা যায়নি। অবিলম্বে এই কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করা দরকার। যে কোনো মূল্য দ্রæততম সময়ের মধ্যে বুড়িগঙ্গাকে দখল ও দুষণমুক্ত করতে করতে হবে। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতেই হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন