মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৫ আষাঢ় ১৪৩১, ০২ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

নিবন্ধ

বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায়

| প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ : চৈত্র মাস থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টিপাত। বৃষ্টিপাতের সাথে বজ্রপাত ও বিকট শব্দে মানুষের মাঝে বিরাজ করছে অজানা আতংক। সম্প্রতি বজ্রপাতের আঘাতে বেশ কিছু মানুষের প্রাণ চলে গেছে। অন্য দিকে বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির লাশ নিয়ে  বিপাকে  আছেন আত্মীয়-স্বজন। বজ্রপাতের আঘাতে নাকি মেগনেট সৃষ্টি হয়। আর এ কারণেই কতিপয় দুশ্চরিত্র লোক এ মানুষের হাড় কবর থেকে চুরি করে  নিয়ে যায়। যদিও মেগনেট সৃষ্টির বিষয়টি বৈজ্ঞানিক সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। একটু সচেতন হলে এবং বজ্রপাত সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলে তা রক্ষা পেতে সহায়ক হবে বলে আশা করি। বজ্রপাতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি গত দুই সপ্তাহ পত্রিকার পাতায় আমরা দেখেছি।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে মারা যাচ্ছে দেড় থেকে দুইশ মানুষ। তবে এর সুনির্দিষ্ট তথ্য দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরসহ সরকারের কোনো সংস্থার কাছে নেই। বজ্রপাত সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষণায় জানা যায়, বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। বজ্রপাতে প্রতি বছর ২০০ থেকে ৩০০ মানুষের প্রাণহানি হলেও আবহাওয়া অধিদফতরের বজ্রপাতের পূর্বাভাস পাওয়ার কোনো সরঞ্জাম বা যন্ত্রপাতি নেই। এমনকি বজ্রপাত সংক্রান্ত কোনো গবেষণাও আবহাওয়া অধিদফতরের কাছে নেই বলে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রেও বজ্রপাত নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। তারা শুধু বজ্রপাতে মৃত্যুর পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে থাকে। একই অবস্থা আবহওয়া অধিদফতরেরও। এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের যেমন কোনো গবেষণা নেই তেমনি নেই সচেতনতামূলক কর্মসূচি। শুধু মৃতের সংখ্যা হিসাব রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আবহাওয়া অধিদফতরের কার্যক্রম।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও দুর্যোগ নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়- ২০১৩ সালে দেশে বজ্রপাতে মোট মৃত্যু হয় ২৮৫ জনের, ২০১২ সালে ২০১ জনের এবং ২০১১ সালে ১৭৯ জনের। ‘উইকিহাউ’ এক নিবন্ধ থেকে জানা যায়, বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাকৃতিকভাবেই বায়ুমন্ডলে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়ে মেঘের রূপ ধারণ করে। এই বিদ্যুৎ মেঘে দুটির চার্জ ধনাত্মক ও ঋণাত্মক হিসেবে থাকে। বিদ্যুৎ শক্তির দুটো মেঘ কাছে আসলে পারস্পরিক আকর্ষণে চার্জ আদান প্রদান হয়। যার কারণে বিদ্যুৎ চমকায়। মেঘের নিচের অংশ ঋণাত্মক চার্জ বহন করে। আবার ভূপৃষ্ঠে থাকে ধনাত্মক চার্জ। দুই চার্জ মিলিত হয়ে তৈরি করে একটি ঊর্ধ্বমুখী বিদ্যুৎ প্রবাহ রেখা, যা প্রচন্ড বেগে উপরের দিকে উঠে যায়। ঊর্ধ্বমুখী এই বিদ্যুৎ প্রবাহ উজ্জ্বল আলোর যে বিদ্যুৎ প্রবাহের সৃষ্টি করে তা-ই বজ্রপাত। বজ্রপাতের তাপ ৩০ থেকে ৬০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, আকাশে যে মেঘ তৈরি হয়, তার ২৫ থেকে ৭৫ হাজার ফুটের মধ্যে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে বেশি। বজ্রপাতের গতি প্রতি সেকেন্ডে ৬০ হাজার মিটার বেগে নিচে নেমে যায়। এই বিপুল পরিমাণ তাপসহ বজ্র মানুষের দেহের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হয়।
বজ্রপাতের স্থায়িত্বকাল এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ। ঠিক এই সময়েই বজ্রপাতের প্রভাবে বাতাস সূর্যপৃষ্ঠের পাঁচ গুণ বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রচন্ড শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ। শব্দের গতি আলোর গতির থেকে কম হওয়ায় বজ্রপাতের পরই শব্দ শোনা যায়। বজ্রপাত ভূমিকম্পের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। একটি বজ্রপাতে প্রায় ৫০ হাজার অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুৎ শক্তি থাকে। অথচ বাসাবাড়ির বিদ্যুৎ চলে গড়ে ১৫ অ্যাম্পিয়ারে। একটি বজ্র কখনও কখনও ৩০ মিলিয়ন ভোল্ট বিদ্যুৎ নিয়েও আকাশে জ্বলে ওঠে। বাংলাদেশে বছরের দুটি মৌসুমে বজ্রপাত বেশি হয়।
বজ্রপাতের কারণ ঃ বাংলাদেশে বজ্রপাতের ওপর তেমন কোনো গবেষণা না হলেও ইউরোপ, জাপান ও আমেরিকায় চলছে বিস্তর গবেষণা। ২০০৮ সালে সুইডেনের উপসালায় অনুষ্ঠিত ২৯তম ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন লাইটিং প্রটেকশন’ শীর্ষক সম্মেলনে তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওফিজিক্স বিভাগের গবেষক কলিন প্রাইস তার ‘থান্ডারস্টর্ম, লাইটিং অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে দেখান, বায়ুদূষণ তথা পরিবেশ দূষণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে বজ্রপাতের। এ নিবন্ধে বলা হয়, বজ্রপাতে একদিকে যেমন বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বায়ুদূষণের ফলে বেড়েছে পরিবেশে বজ্রপাতের হার ও এর তীব্রতা। জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। তাছাড়া গণহারে মোবাইলের ব্যবহার বাড়ার কারণে এ মৃত্যুর হারটাও বাড়ছে। কাল বৈশাখীর বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা দুনিয়ার বুকে বাংলাদেশেই বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ, আবহাওয়ার পরিবর্তন, মোবাইল-ফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি ও টিনের তৈরি স্থাপনাকে চিহ্নিত করেছেন। একদিকে বড় বড় গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, অন্যদিকে মোবাইল ফোনসহ যান্ত্রিক ব্যবহার বৃদ্ধি মানুষকে বজ্রপাতের নিশানা করে তুলছে।
পরিবেশ অধিদফতরের হিসাব ঃ বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বাতাসে কার্বনের পরিমাণ চার শতাংশের বেশি বেড়েছে গত কয়েক বছরে। বাতাসে ধূলিকণার মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রোগ্রামকে সহনীয় পর্যায়ে ধরা হলেও সেখানে রাজধানীর এলাকাভেদে বাতাসে এ ধরনের উপাদান প্রতি ঘনমিটারে ৬৬৫ থেকে দুই হাজার ৪৫৬ মাইক্রোগ্রাম বা তারও বেশি পরিমাণ পাওয়া গেছে। বজ্রপাতের পরপরই ট্রপোস্টিম্ফয়ার বা বায়ুমন্ডলে সবচেয়ে নিচের স্তরে নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ে। কার্বন ডাইঅক্সাইড বা কার্বন মনো-অক্সাইডের চেয়ে বেশি বিষাক্ত নাইট্রোজেন অক্সাইড রূপান্তরিত হয়ে তা রীতিমতো পরিণত হয় ওজোন গ্যাসে। এ গ্যাস বাতাসের এমন একটি স্থানে ভেসে বেড়ায়, যার ফলে দিন দিন বেড়েই চলেছে বায়ুদূষণের মাত্রা।
বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায় ঃ ১. দালান বা পাকা ভবনের নিচে আশ্রয় নিন। ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোনো অবস্থাতেই খোলা বা উঁচু স্থানে থাকা যাবে না। সবচেয়ে ভালো হয় কোনো একটি পাকা দালানের নিচে আশ্রয় নেয়া। ২. উঁচু গাছপালা ও বিদ্যুৎ লাইন থেকে দূরে থাকুন। কোথাও বজ্রপাত হলে উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই এসব স্থানে আশ্রয় নেবেন না। খোলা স্থানে বিচ্ছিন্ন একটি যাত্রী ছাউনি, তালগাছ বা বড় গাছ ইত্যাদিতে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি থাকে। ৩. জানালা থেকে দূরে থাকুন। বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি থাকবেন না। জানালা বন্ধ রাখুন এবং ঘরের ভেতর থাকুন। ৪. ধাতব বস্তু স্পর্শ করবেন না। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না। এমনকি ল্যান্ড লাইন টেলিফোনও স্পর্শ করবেন না। বজ্রপাতের সময় এগুলো স্পর্শ করেও বহু মানুষ আহত হয়। ৫. বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র থেকে সাবধান। বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিক সংযোগযুক্ত সব যন্ত্রপাতি স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি বন্ধ করা থাকলেও ধরবেন না। বজ্রপাতের আভাষ পেলে আগেই এগুলোর প্লাগ খুলে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করুন। অব্যবহৃত যন্ত্রপাতির প্লাগ আগেই খুলে রাখুন। ৬. গাড়ির ভেতর থাকলে বজ্রপাতের সময় গাড়িটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন। গাড়ির ভেতরের ধাতব বস্তু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। গাড়ির কাচেও হাত দেবেন না। ৭. খোলা ও উঁচু জায়গা থেকে সাবধান। এমন কোনো স্থানে যাবেন না, যে স্থানে আপনিই উঁচু। বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা বড় মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে যান। বাড়ির ছাদ কিংবা উঁচু কোনো স্থানে থাকলে দ্রæত সেখান থেকে নেমে যান। ৮. পানি থেকে সরুন। বজ্রপাতের সময় আপনি যদি ছোট কোনো পুকুরে সাঁতার কাটেন বা জলাবদ্ধ স্থানে থাকেন তাহলে সেখান থেকে সরে পড়–ন। পানি খুব ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী। ৯. পরস্পর দূরে থাকুন। কয়েকজন মিলে খোলা কোনো স্থানে থাকাকালীন যদি বজ্রপাত শুরু হয় তাহলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যান। কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যান। ১০. নিচু হয়ে বসুন। যদি বজ্রপাত হওয়ার উপক্রম হয় তাহলে কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসুন। চোখ বন্ধ রাখুন। কিন্তু মাটিয়ে শুয়ে পড়বেন না। মাটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুস্পৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
বজ্রপাতের আগ মুহূর্তের লক্ষণ জানুন ঃ আপনার উপরে বা আশপাশে বজ্রপাত হওয়ার আগের মুহূর্তে কয়েকটি লক্ষণে তা বোঝা যেতে পারে। যেমন বিদ্যুতের প্রভাবে আপনার চুল খাড়া হয়ে যাবে। ত্বক শিরশির করবে বা বিদ্যুৎ অনুভূত হবে। এ সময় আশপাশের ধাতব পদার্থ কাঁপতে পারে। অনেকেই এ পরিস্থিতিতে ‘ক্রি ক্রি’ শব্দ পাওয়ার কথা জানান। আপনি যদি এমন পরিস্থিতি অনুভব করতে পারেন তাহলে দ্রæত বজ্রপাত হওয়ার প্রস্তুতি নিন। রবারের বুট পরুন। বজ্রপাতের সময় চামড়ার ভেজা জুতা বা খালি পায়ে থাকা খুবই বিপজ্জনক। এ সময় বিদ্যুৎ অপরিবাহী রাবারের জুতা সবচেয়ে নিরাপদ। বাড়ি সুরক্ষিত করুন। আপনার বাড়িকে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। এজন্য আর্থিং সংযুক্ত রড বাড়িতে স্থাপন করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নিতে হবে। ভুলভাবে স্থাপিত রড বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।
বজ্রপাতে আহত হলে কি করবেন? বজ্রপাতের সময় আশপাশের মানুষের খবর রাখুন। কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রæত চিকিৎসককে ডাকতে হবে বা হাসপাতালে নিতে হবে। একই সঙ্গে এ সময় বজ্রাহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ বিষয়ে প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ নিয়ে রাখুন।
লেখক : শিক্ষক ও সাংবাদিক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন