শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল : এগারো মাসের এক শিশু চুরি ও মারধরের মামলায় হাজিরা দিতে বাবার কোলে চড়ে ঢাকার সি.এম.এম আদালতে এসেছিল। এমন সংবাদ আমরা প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় দেখে থাকি। এটা নতুন কোনো ব্যাপার নয় কিংবা এটা অবাক হওয়ার বিষয়ও নয়। কিন্তু আমরা সচেতন জনগোষ্ঠী কখনও এসব অন্যায় কাজের প্রতিকারের ব্যাপারে সচেতন হই বলে মনে হয় না। যদি আমরা প্রকৃত অর্থে সকল ধরনের অপরাধের ব্যাপারে সচেতন হতাম, তাহলে আজ আমাদের এই সমাজ সংসারে নির্দয় কার্যকলাপের এতোটা উৎসব চলত না। আজ যে দিকেই চোখ যায় কেবলই হতাশা আর দুর্নীতির চালচিত্র যেন আমাদের চোখের সামনে দোল খেতে থাকে। আমরা অসহায়ের মতো কেবল চেয়ে থাকি আর অক্ষমের মতো আর্তনাদ করে নিজেদেরকেই দোষারূপ করে থাকি। আমাদের যেন নিষ্ফল আর্তনাদ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় যে, এক মৃত ব্যক্তি ও এগারো মাসের এক শিশুর বিরুদ্ধে চুরি ও মারধরের মামলায় চার্জশিট দেওয়ার অভিযোগ প্রকাশ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এক এসআইকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
মানুষ প্রশ্ন করতেই পারে পুলিশ কি ঘটনাস্থলে না গিয়ে থানায় বসে শুধু মাত্র একশ্রেণীর মামলাবাজ ব্যক্তির কথামতো মামলার চার্জশিট কোর্টে দিয়ে থাকে? একটি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোন মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর মামলাটি যখন তদন্ত করতে যান, তখন তিনিই এই মামলার তদন্তের ব্যাপারে প্রধান ব্যক্তি। তিনি মামলার তদন্তের ব্যাপারে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের কথা শুনতে বাধ্য নন। মামলা মোকদ্দমার ব্যাপরে যারা সচেতন তারা সবাই জানেন, সংশ্লিষ্ট কোন মামলার কোন তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করার সময় তিনি অবশ্যই ঘটনাস্থলে যাবেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘটনাস্থলের আশেপাশের লোকদেওর যেমন সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন, তেমনি বাদীর মানীত সাক্ষীদেরও সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন। তিনি ঘটনাস্থলের খসড়া মানচিত্র তৈরি করবেন। তিনি একটি সি.ডি অর্থাৎ কেইস ডায়েরি তৈরি করবেন। তিনি সেই সি.ডি-এর মধ্যে অর্থাৎ কেইস ডায়েরির মধ্যে সংশ্লিষ্ট মামলার সবকিছু সংরক্ষিত করবেন। আমরা যদি সচেতনভাবে একটু চিন্তা-ভাবনা করি, তাহলে একটা কথা আমরা ঠিকই বুঝতে পারব, আর তা হলো, যে তদন্তকারী কর্মকর্তা কোন চুরি কিংবা মারধরের মামলায় এগারো মাসের শিশু এবং কোন মৃত ব্যক্তিকে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করেন, তিনি মামলার তদন্তের জন্য ঘটনাস্থলে কখনও যান নি এবং বাদীর মানীত সাক্ষী ছাড়া আশেপাশের কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন নি। তিনি অবশ্যই প্রতিপক্ষের প্রতি বাদীর আক্রোশ মেটানোর জন্য অন্যায় লাভের আশায় কিংবা নিজের পকেট ভারি করে এগারো মাসের শিশুকে ও মৃত ব্যক্তিকে চার্জশিটভুক্ত আসামী করে কোর্টে চার্জশিট প্রদান করেছেন। আমাদের দেশের একশ্রেণীর পুলিশ কর্মকর্তা সম্পর্কে এমনিতেই অনেকেই অনেক কথা বলাবলি করে থাকেন। দুর্নীতিবাজ পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তারা টাকা পয়সা নিয়ে ভালো মানুষের বিরুদ্ধেও তদন্ত না করে কোর্টে চার্জশিট দিয়ে ফেলেন। আমরা এমন কথাও শুনে থাকি যে, এমন পুলিশ কর্মকর্তাও আছেন, যিনি টাকা পয়সা ছাড়া থানায় মামলা রুজু করতে চান না। নানা রকম কথাবার্তা কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে ভুক্তভোগী লোকদের অভিযোগ গ্রহণ না করে থানা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে থাকেন। এসব কথাও নতুন কোন কথা নয়। আমাদের দেশে ভোক্তভুগী মানুষরা ঠিকই জানে তারা পুলিশের কাছ থেকে কতোটা সেবা পেয়ে থাকে। আবার মানুষ এটাও বুঝে থাকে যে, গুটি কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার জন্য আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনীর সৎ সদস্যরা কতোটা বদনামের ভাগীদার হয়ে থাকেন।
আমাদের পুলিশ বাহিনীতে কিছু সংখ্যক অসৎ সদস্য আছে, যারা নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়েন বলে সচেতন মানুষ কানাঘুষা করে থাকে। সমাজের বিত্তবান কিংবা ক্ষমতাবানরা অন্যকে ফাঁসানোর জন্য পুলিশ সদস্যদেরকে ব্যবহার করে থাকেন। কিছু সংখ্যক পুলিশ সদস্য অন্যায় লাভে লাভবান হয়ে নিজেদেরকে ব্যবহার করার সুযোগও করে দেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় যে, এক গরীব চা দোকানীকে মাদক দিয়ে ফাঁসাতে গিয়ে ধরা পড়ে জনক্ষোভের সম্মুখে পড়েন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। জানা যায় যে, চা দোকানীর সাথে এক ব্যক্তির শত্রæতা ছিল। সেই ব্যক্তির নিজের শত্রæতা মিটাবার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করে মাদক দিয়ে চা দোকানীকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল। চা দোকানী অসৎ পুলিশ কর্মকর্তাদের অন্যায় কাজ দেখে ফেললে অসৎ পুলিশের লোকেরা চা দোকানীকে বলে, তুই এখানে মাদক (ফেন্সেডিল) রেখেছিস। তুই চায়ের দোকানের আড়ালে মাদকের ব্যবসা করিস। গরীব চা দোকানী অসৎ পুলিশ কর্মকর্তাদের কথার প্রতিবাদ করে উঠলে এবং চা দোকানীর চিৎকারে আশেপাশের লোকজন ছোটে আসে এবং প্রতিবাদী মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলে, চা দোকানী রক্ষা পায় এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে দুই অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার অপরাধের বিচারের আশ্বাস দিলে জনগণের মনের ক্ষোভ স্তিমিত হয়। যে পুলিশের কাজ হলো সাধারণ মানুষকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করা, সেই পুলিশের এক শ্রেণী অসৎ কর্মকর্তারা যদি দুর্বৃত্তদের পক্ষে চলে যায়, তাহলে মানুষ মান-সম্মান নিয়ে বাঁচবে কী করে? আমরা মাঝে মধ্যে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগের কথা শুনে থাকি যে, যা শুনলে কোন শান্তিপ্রিয় মানুষের মন ভালো থাকার কথা নয়।
দেশবাসী মনে করে না আমাদের পুলিশ বাহিনীর পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সবাই অসৎ। আমাদের পুলিশ বাহিনী সবাই যে অসৎ নয় তার প্রমাণ হলো, এখনও আমরা রাতে শান্তিমতে ঘুমাতে পারি। কিন্তু তারপরও কথা থাকে কিংবা প্রশ্ন আসে মনে, আর প্রশ্নটি হলো গুটিকয়েক অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার জন্য পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যে সব সদস্যরা সৎ এবং নিষ্ঠাবান, তারা কেন সমালোচনার মুখোমুখী হবেন? আমরা যতই উন্নয়নের কথা বলি না কেন কিংবা বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা উন্নয়নের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য যতই কাজ করে যাই না কেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষ যদি রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত অসৎ ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণের মাঝে আনতে না পারেন, তাহলে আমাদের উন্নয়নের লাভটুকু অসৎ প্রকৃতির লোকেরা খেয়ে ফেলবে। ঘরে যদি ইঁদুর বাড়তে থাকে তাহলে সেই ইঁদুরের দল সবকিছু কেটে তছনছ করে দেবেই।
লেখক : কবি, গল্পকার, আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন