এ.কে.এম. ফজলুর রহমান মুনশী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
(ঙ) তাছাড়া শায়খুল হাদীস মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী (রহ:)-এর অভিভাষণেও অনুরূপ ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া যায়। (ফয়জুল বারী)
সুতরাং ‘ওয়া আলাল্লাজিনা ইউত্বিকুনাহু’-এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, “যারা কষ্টসহকারে রোজা রাখতে পারে।” তবে এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, যারা অতিকষ্টে রোজা রাখতে পারে তাদের বেলায় ফেদিয়া দেয়ার অনুমতি যেমন রয়েছে, তেমনি যারা রোজা রাখতে মোটেই সক্ষম নয়, তাদের জন্যও ফেদিয়া প্রদানের অনুমতি অবশ্যই রয়েছে।
মূল সমাধান : “ওয়া আলাল্লাজিনা ইউত্বিকুনাহু ফিদইয়াতুন ত্বায়ামু মিছকীন” এই আয়াতটির তফসীর বিশ্লেষণে সাহাবীদের আমল হতেই এখতেলাফ চলে আসছে। সুতরাং এ সম্পর্কে সাহাবীদের তিনটি শ্রেণীর সন্ধান পাওয়া যায়।
(১) কোন কোন সাহাবীর বর্ণনা হতে জানা যায় যে, প্রথম রমজানের পূর্বে কয়েকটি রোজা ফরজ ছিল। এই রোজাগুলোর সম্পর্কে অনুমতি ছিল, কেউ ইচ্ছা করলে রোজা রাখতে পারে অথবা প্রত্যেক রোজার বদলে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করতে পারে। তারপর রমজান মাসের রোজা ফরজ হবার পর এই হুকুম রহিত (মানছুখ) হয়ে গেছে।
(২) সাহাবীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর অভিমত এই যে, “ইউত্বিকুনাহু” শব্দের ‘হু’ জমীর বা সর্বনামটি সাওম শব্দের প্রতি প্রযোজ্য নয় বরং ইহা ‘তায়াম’ শব্দের প্রতি প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে আয়াতটির অর্থ দাঁড়াবে, “যে ব্যক্তি ফেদিয়া দানের সামর্থ্য রাখে সে রোজা রাখার সাথে একজন মিসকীনের ফেদিয়াও আদায় করবে: পরবর্তী সময়ে এই হুকুমও রহিত হয়ে গেছে। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস-ই-দেহলভী (রহ:) মিসকীনদের আহার্য ফেদিয়ার দ্বারা “ছদকায় ফিতিরকে’ বুঝায়েছেন। যা রমজানের পর প্রত্যেক সামর্থ্যবান রোজাদার নিজের এবং নিজের নাবালেগ সন্তানাদির পক্ষ হতে আদায় করে থাকেন। (ফাউজুল কাবীর)
(৩) সাহাবীদের তৃতীয় শ্রেণীর মতানুসারে জানা যায় যে, এই হুকুম রহিত করা হয়নি। বরং রোজার ফেদিয়া দেয়ার অনুমতি তাদের প্রতি প্রযোজ্য যারা মাজুর। যেমনÑ বয়”বৃদ্ধ নারী-পুরুষ ও গর্ভবর্তী মহিলা।
তবে আসল কথা হচ্ছে এই যে, ‘ইউত্বিকুনা’ শব্দটির আভিধানিক অর্থের তাহকীক করা হয়নি। ‘এতাকাত’ শব্দটিকে ‘ওয়াছউন’ শব্দের সমার্থবোধক বলে মনে করা হয়েছে। তাই তারা উপরোক্ত আয়াতে কারীমার অর্থ করেছেন, “যারা রোজা রাখতে পারে, তারা একজন গরীব-মিসকীনকে আহার করাবে।” এই অর্থ অনুসারে হয়ত এই আয়াতটির হুকুম রহিত হয়ে গেছে বলে মেনে নিতে হবে, কিংবা বর্তমান যুগের লাগামহীন বুদ্ধিজীবীদের মত বলতে হবে, যারা রোজা রাখতে সক্ষম তারাও রোজার বদলে ফেদিয়া প্রদান করে রোজার কষ্ট হতে বাঁচতে পারে। অথচ এই অভিমত সম্পূর্ণই ভুল। কারণ তাদের মতানুসারে বলা যায়, যারা গরীব তারাই রোজা রাখবে এবং যারা ধনী তারা ফেদিয়া প্রদান করে রোজার কষ্ট ও যাতনা হতে বিমুক্ত থাকবে। অথচ ইসলামের ফারায়েজগুলোতে এই ধরনের তারতম্য কোথাও রাখা হয়নি। ইসলামের নীতিমালার ধারাবাহিকতারও তা বিপরীত। তাছাড়া এর পরবর্তী আয়াত, “যে রমজান মাসে থাকবে, তার উচিত মাস ভর রোজা রাখা” এর নির্দেশকেও অমান্য করা হবে।
উপসংহার : পরিশেষে এ কথা স্পষ্টত:ই বলা যায় যে, ‘ইত্বাক্কাত’-এর অর্থ হচ্ছে, “কোনও কাজকে কষ্টসহকারে আদায় করার সামর্থ্য থাকা।” তাই উপরোল্লিখিত “ইউত্বিকুনাহু” শব্দ সম্বলিত আয়াতের সঠিক অর্থহবে, “যারা অত্যন্ত কষ্ট সহকারে রোজা রাখতে সক্ষম, তারা রোজার বদলে একজন মিসকীনের খাদ্য ফেদিয়া প্রদান করবে।”
এই নিরিখে মাজুর লোকদের দু’টি শ্রেণী স্বভাবত: নজরে পড়ে) (এক) ঐ ধরনের মাজুর যারা সময় সাপেক্ষে মাজুর হয়েছেন। যেমন-রোগাক্রান্ত হওয়া, মৃত্যু ভয় দেখা দেয়া, অথবা সফরে গমন করা। এমতাবস্থায় তাদের উপর এই আয়াতের নির্দেশ কার্যকর হবে। “তবে তোমাদের মাঝে যারা রোগাক্রান্ত হবে অথবা সফরে থাকবে তারা অন্যান্য দিনে রোজা আদায়ের মাধ্যমে সংখ্যা পূরণ করবে।” (সূরা বাক্কারাহ : রুকু-৩৩)
মোটকথা ওজর পাওয়া গেলে মাজুর ব্যক্তি রোজা রাখবে না। বরং সমপরিমাণ দিনগুলোর রোজা পরবর্তী দিনগুলোতে কাযা আদায় করবে। এই শ্রেণীর সঙ্গে গর্ভবতী ও দুধদানকারী মহিলারাও শামিল রয়েছেন। যদি গর্ভবর্তী মহিলা বা দুধদানকারী মহিলা নিজের অসুস্থতার অথবা বাচ্চার অসুস্থতার ভয় করেন, তাহলে এই ওজর থাকাকালীন সময়ে রোজা না রেখে ওজর দুর হওয়ার পর কাজা আদায় করতে পারেন।
(দুই) তবে ওজর যদি সার্বক্ষণিক হয়, ওজর দূর হওয়ার সম্ভাবনাই না থাকে যেমন চির রগ্ন হওয়া, খুবই কমজোর হওয়া, মৃত্যুপথ যাত্রী, বৃদ্ধ হওয়া, যারা অতিকষ্টে রোজা রাখতে পারেন, তারা রোজা না রেখে প্রত্যেক রোজার বদলে একজন মিসকীনের খাদ্য ফেদিয়াস্বরূপ দিতে পারেন। “ওয়া আলাল্লাজিনা ইউত্বকুনাহু ফিদইয়াতুন ত্বায়ামু মিছকীন” অর্থাৎ “যারা অতিকষ্টেরোজা রাখতে পারেন তারা ফেদিয়াস্বরূপ একজন মিসকীনের খাদ্য দান করবেন” নিদের্শটি তাদের উপরই প্রযোজ্য।
রোজার উপর আরোপিত আপত্তির জবাব :
জ্ঞান এবং স্বভাব-প্রকৃতি অনুসন্ধানকারী কিছু লোক যারা সাধারণ ইবাদতবন্দেগীগুলোর উদ্দ্যেশ্য এবং লক্ষ্য নির্ধারণে বাক-বিতন্ডার আশ্রয় গ্রহণ করে। অসামাজিক এবং বন্য মানুষদের ধারণা হচ্ছে এই যে, তারা মনে করে আল্লাহ আমাদের কায়িক পরিশ্রমের ফলে সন্তুুষ্টি লাভ করেন এবং তারা রোজার হাকীকতকেও শুধু এতটুকুই বুঝে যে, এটা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুুষ্টি অর্জনের জন্য শারীরিক কষ্ট বরণ করা। এ সকল ভ্রান্ত মতাদর্শ অবলম্বনকারীদের জন্য অন্যান্য ধর্মে যদিও পদস্খলনের অবকাশ রয়েছে তবু এর চূড়ান্ত প্রতিরোধ অবশ্যই দরকার। যেমন হিন্দু যোগী এবং জৈন ধর্মের অনুসারীরা রোজা সম্পর্কিত কষ্ট এবং বেদনাজনক অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইহুদীদের ব্যবহারিক আচার-আচরণের মাঝে রোজার জন্য নফসকে কষ্ট দেয়ার প্রচলন জারী আছে। সুতরাং লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তৌরাত কিতাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোজার জন্য কষ্টদায়ক শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। সফরুল আহবার (১৬-২৯) কাÐে আছে, “এই আইন তোমাদের জন্য চিরস্থায়ীভাবে বহাল থাকবে যে, ৭ম মাসের ১০ম তারিখে তোমাদের সকলেরই চাই যেু, তোমাদের সাথে বসবাস করে নিজের জানকে দু:খ দিতে হবে।
তৌরাতের সফরুল আদদ (২৯-৭) কাÐে আছে, “এবং এই সপ্তম মাসের ১০ম তারিখে পবিত্র জমাআত প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তোমরা নিজেদের প্রাণকে কষ্ট দিবে। কিন্তুু কোন কাজ-কর্ম করবে না।” এই ব্যবহারিক দিকটি তৌরাতের অন্যান্য কাÐেও পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু কুরআনুল কারীমে রোজার জন্য যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা হল সাওম। সাওম শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা, মুক্ত থাকা এবং নিশ্চুপ থাকা। এর দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইসলামী রোজার হাকীকত কি এবং এর লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যই বা কি? কুরআনুল কারীমে মুসলমানদেরকে লক্ষ্য করে যেখানে রোজার হুকুম দেয়া হয়েছে সেখানে এই নির্দেশও প্রদান করা হয়েছে যে, “আল্লাহ তোমাদের সাথে সহজ এবং নমনীয়তা প্রকাশ করতে চান। কিন্তু কষ্ট ও কাঠিন্য কামনা করেন না।” (সূরা বাকারাহ ” রুকু-২৩) তাছাড়া ইসলামের সাধারণ নিয়ম-নীতি হচ্ছে এই যে, “আল্লাহ পাক কোন মানুষকে শক্তির বহির্ভুত কোন বোঝা বহন করতে বাধ্য করেন না।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-৪০) কুরআনুল কারীমে রাসূলুল্লারাহ (সা:)-এর দ্বীন প্রচারের মৌলিক গুণাবলীকে এভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তিনি তোমাদেরকে পুণ্য কর্মসমূহ নিষ্পন্ন করার নির্দেশ প্রদান করেন এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করেন এবং অপবিত্র বস্তুসমূহকে হারাম করেন এবং যে সকল তাউক ও জিঞ্জিরসমূহ তাদের উপর আরোপিত আছে সেগুলোকে অপসারিত করেন।” (সূরা আ’রাফ ” রুকু-১৯)
এ সকল আয়াতে বর্ণিত নির্দেশাবলীর উদ্দেশ্যে হচ্ছে এই যে, ইসলামী ইবাদত ও আহকামের মাঝে কোন বস্তু ও উদ্দেশ্য আরোপিত করা হয়নি, যা এর দ্বারা মানুষের মন-প্রাণকে দু:খ বেদনায় পরিলিপ্ত করবে। রোজাও এই শ্রেণীর ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। এ সকল কারণে ইসলাম রোজার কষ্ট ও বেদনাকে অক্ষম, অপরাগ ও দুর্বল লোকদের থেকে অপসারণের ব্যবস্থা রেখেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন