আবুল কাসেম হায়দার
১ জুন ’১৭ জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের জন্য ৪ লক্ষ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন। যা চলতি বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি। বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ৮৮ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থ বছরের তুলনায় ২৯ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে কর রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ২ লক্ষ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থ বছরের চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে এনবিআর থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ৩৬ হাজার ২০ কোটি টাকা। এছাড়া কর ব্যতীত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ২৭ হাজার কোটি টাকা।
আগামী ১ জুলাই ’১৭ থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হচ্ছে। সর্ব পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ঘোষণা করা হয়েছে। ভ্যাট অব্যহতির বিদ্যমান সীমা ৩০ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ৩৬ লক্ষ টাকা এবং টার্নওভারের সীমা ৮০ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া টার্নওভার ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের জন্য এবারের বাজেটে থাকছে বিশেষ বরাদ্দ।
প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ২২ লক্ষ ২৬৬ কোটি টাকা। এতে প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এদিকে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার টার্গেট ঠিক করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট আয়-ব্যয় হিসাবে বেশ ঘাটতি রয়েছ। ঘাটতির সম্ভাব্য পরিমাণ হচ্ছে ১ লক্ষ ১২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণ ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। অনুদান ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
বর্তমান ব্যাংক হিসাব ও বিমানের টিকেটে যথাক্রমে সর্ব্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকায় এবং ১ হাজার ৫০০ টাকা আবগারী শুল্ক নির্ধারিত রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৫ কোটি ১ টাকা থেকে ঊর্ধ্বে পরিমাণের ব্যাংক ডিপোজিটের বিপরীতে ৩০ হাজার টাকা এবং আন্তর্জাতিক টিকেটের বিপরীতে ৩ হাজার টাকা আবগারী শুল্ক ধরা হয়েছে। ভ্যাট, স্থানীয় পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক, আবগারী শুল্ক এবং টার্নওভার কর আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৬৬ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেট তা বাড়িয়ে ৮৭ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের তুলনায় ৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি। এই লক্ষ অর্জনে ভ্যাট আইন ২০১২ পহেলা জুলাই থেকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে এখন আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। বিভিন্ন সংস্থা, রাজনৈতিক দলসমূহ, বাজেট বিশেষজ্ঞগণ এতদিন বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে পরামর্শ রাখছেন। জাতীয় সংসদে বাজেট পাশের পূর্বে সংশোধন, সংযোজন করা যাবে। তাই জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এনিয়ে মূল্যায়ন করা খুবই জরুরি।
১. তৈরি পোশাক শিল্প তথা বস্ত্রখাত: তৈরি পোশাক শিল্পে অগ্রিম কর ১ শতাংশ হারে কর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বস্ত্র খাতের অন্যান্য উপখাতেও ১ শতাংশ হারে প্রস্তাব করা হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাগণ আগামী ২ বছর অগ্রিম কর কর্তনের বিধান প্রত্যাহারের আহবান জানিয়েছেন। বস্ত্রখাতের অন্যান্য উপখাতে ও অগ্রিম আয়কর কমিয়ে ২৫ শতাংশে আনা প্রয়োজন। বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পসহ বস্ত্রখাত কঠিন সময় অতিক্রম করছে। ব্যাংকের অধিক সুদের কারণে উৎপাদন খরচ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই উৎপাদন খরচ অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ থেকে আমাদের দেশে বস্ত্র খাতের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়াতে এই খাত হুমকির সম্মুখিন। বস্ত্রখাতের সকল উপখাতে অগ্রিম কর ২৫ শতাংশে পুননির্ধারণ করা জরুরি। অন্যদিকে তৈরি পোশাক ও বস্ত্রখাতের অন্যান্য উপখাতে বিদ্যুৎ গ্যাসের বিলের উপর ভ্যাট সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করা উচিত।
২. ব্যাংকে টাকা রাখার উপর কর: নতুন করে ব্যাংকে টাকা রাখার উপর কর বাড়ানো হয়েছে। সার্বিকভাবে বর্তমানে ব্যাংকে আমানতের উপর সুদ কমেছে। ফলে আমানতকারীরা দু’ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সুদ কমেছে, করও বাড়ছে। আমানতকারীরা এখন খুবই শংকিত, তারা কোথায় যাবে? সরকারের এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। এর ফলে আমাদের আর্থিক খাতে ছায়া অর্থনীতির পরিমাণ বাড়বে। লেনদেন যেভাবে ব্যাংকিং খাতে হওয়ার সুযোগ ছিল তা আর হবে না। এতে কর আদায় ও আর্থিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা কমবে। অল্প কিছু অর্থের জন্য সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এই পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত হয়নি। এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের যে আয় হবে তার চেয়ে বেশি ব্যাংকিং খাত ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
আমরা চাই দেশে বৈধ লেনদেন বৃদ্ধি পাক। তবে অতিরিক্ত করের কারণে তা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের করের টাকা দিয়ে সরকারি ব্যাংকসমূহকে টিকিয়ে রেখে আবার ও লুটপাটের সুযোগ তৈরি করে দেয়া উচিত হয়নি। সকল সরকারি ব্যাংক বেসরকারি খাতে অবিলম্বে ছেড়ে দেয়া উচিত। সরকার কেন ব্যবসা করবে? প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকে জমা রাখা টাকার উপর অতিরিক্ত কর্তন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা উচিত। ব্যাংকিং খাতের উন্নতির স্বার্থে এটি খুবই জরুরি।
৩. ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে হ্রাস: ১ জুলাই থেকে ভ্যাট আইন ২০১২ কার্যকর হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট সকল ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে আদায় করার সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। নতুন মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনে ভ্যাটের হার ১২ শতাংশ করার কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে বাজেটে ১৫ শতাংশ রাখা হয়েছে। তাতে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়বে। অন্যদিকে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে গরিব মানুষের সর্বনাশ ডেকে আনবে। পৃথিবীর কোনো দেশে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেই। এটি অধিক। ভ্যাট অবশ্যই কমিয়ে ১২ শতাংশ নির্ধারণ করা উচিত। অবশ্য বাজেটে ১ হাজার ৪৩টি পণ্যকে ভ্যাট থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। এইটিও অনেক কম। আরো বেশ কিছু পণ্যকে ভ্যাট থেকে অব্যহতি দেয়া প্রয়োজন।
প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসায়ীরা দু’টি ছাড় পেয়েছেন, তা হলো ভ্যাটমুক্ত লেনদেন বা টার্নওভার সীমা ৩০ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৬ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ দিনে গড়ে সাড়ে ১১ হাজার টাকা বিক্রিতে ভ্যাট দিতে হবে না। অন্যদিকে দেড় কোটি টাকা লেনদেনে ব্যবসায়ীরা লেনদেন কর দিতে পারবেন। এখন যে সীমা ৮০ লক্ষ টাকা। অবশ্য এই ক্ষেত্রে লেনদেন কর ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। কিন্তু তার পরও ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১২ শতাংশ করা উচিত। তা না হলে অধিক ভ্যাটের চাপে ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়বে।
৪. সরকারি ব্যাংকে করের টাকা: সরকারি ব্যাংক গুলোর জন্য আগামী বাজেটে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই টাকা জনগণের করের টাকা। মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগের নামে এই সরকারের আমলে সরকারি ব্যাংকগুলোকে মোট ১৪ হাজার কোটিরও বেশি টাকা দেয়া হয়েছে। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরের জন্যও সরকার সরকারি ব্যাংকসমূহের জন্য ২ হাজার মোট টাকা রেখেছিল। তা থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় ১ হাজার ৮ শত কোটি টাকার অনুমোদন দিয়েছে। জনগণের ব্যাংকে জমা টাকা থেকে সরকার কর কেটে নিয়ে আবার সেই টাকা সরকারি ব্যাংকে মূলধন হিসাবে বিনিয়োগ করবে। এটা একটা অনৈতিক কাজ। বরং সরকারি ব্যাংকসমূহের সংস্কার করা দরকার।
অন্যদিকে সরকারি ব্যাংক থেকে লুট হয়ে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা উদ্ধারের ব্যবস্থা করে মূলধন যোগানের ব্যবস্থা করা উচিত। লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদেরকে আরও উৎসাহিত করা হলো। সুশাসন ও আইনের শাসন কায়েম ছাড়া ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্যদশা হতে মুক্তি আসবে না।
৫. কর্পোরেট কর কমানো প্রসঙ্গে: দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কর্পোরেট কর কমিয়ে আনা উচিত। বিশ্বের অন্যান্য দেশে কর্পোরেট কর আমাদের দেশের মত এত বেশি নয়। বর্তমানে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ হারে কর্পোরেট কর দিতে হয়। কোথাও কোথাও ৪৫ শতাংশ রয়েছে। করের অধিক চাপে সাধারণ গ্রাহক দিশেহারা। নতুন কোন বিনিয়োগ করার সুযোগ প্রতিষ্ঠানগুলো পাচ্ছে না। লাভের ৪০ শতাংশ কর দেয়ার পর প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন বিনিয়োগের সুযোগ ও সাহস হারিয়ে ফেলে। তাই বিনিয়োগ বৃদ্ধির স্বার্থে কর্পোরেট কর কমপক্ষে ৫ শতাংশ কমিয়ে আনা প্রয়োজন।
৬. শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত : শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর শিক্ষাখাতে অধিক বাজেট বরাদ্দ থাকে। এবারও শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বাজেটের ১৬.৪ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। খাত হিসাবে সব চেয়ে বেশি। দ্বিতীয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে জন প্রশাসন খাতে ১৩.৬ শতাংশ । সবচেয়ে কম বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম খাতে মাত্র ০.৯ শতাংশ।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি দুই মন্ত্রণালয় মিলে ১৬.৪ শতাংশ বরাদ্দ অনেক কম। এর অধিকাংশ ব্যয় হবে কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা বাবদ। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল-কলেজ-মাদরাসা এমপিও ভুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান। এই সকল স্কুল-কলেজ-মাদরাসার হাজার হাজার শিক্ষক কর্মচারী এমপিও না হওয়াতে করুণভাবে, দৈন্যদশায় জীবন কাটাচ্ছে। বাজেটে আলাদাভাবে স্কুল-কলেজ-মাদরাসাকে এমপিওর জন্য কোনো বরাদ্দ উল্লেখ করা হয়নি। আশাকরি, সমাপনী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বিষয়টি উল্লেখ পূর্বক সকল স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাকে এমপিও ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে বাজেটে বড় বরাদ্দ ঘোষণা করবেন। অন্যদিকে শিক্ষা খাতের সকল পর্যায় থেকে ভ্যাট ও কর আদায় বন্ধ করার ঘোষণা দেয়া প্রয়োজন। সরকারি, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ভ্যাট, কর নেয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে কেন ভ্যাট, কর নেয়া হবে?
৭. দুর্নীতি, অনিয়ম ও সুশাসন: বাজেট বক্তৃতায় বাজেট বাস্তবায়নের জন্য দুর্নীতি মুক্ত সমাজ, অনিয়ম মুক্ত প্রসাশন ও সুশাসন সম্বলিত সরকার যে জরুরি তা নিয়ে অর্থমন্ত্রী তেমন কিছু উল্লেখ করেননি। এ বিশাল বাজেট বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হচ্ছে দুর্নীতি, ঘুষ ও অনিয়ম। বিগত অর্থ বছরে আর্থিক খাতের অনিয়ম সর্বোচ্চে উঠে এসেছে। ব্যাংকিং খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক হতে ৮ হাজার কোটি টাকা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লোপাট করা হয়েছে। সরকারি ৪টি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন নামে লোপাট করা হয়েছে। বরং সরকার জাতীয় বাজেট থেকে সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বিগত বছরের মতো এ বছরও ২ হাজার কোটি টাকা রেখেছেন। এই সকল ঘটছে দেশে সুশাসন নেই বলে। আইনের শাসন কার্যকর নয় বলে নির্বিঘেœ অর্থ লুট চলছে। প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এই সকল নিয়ে কোন কথাই বলেননি। বিচারের নামে যে তামাশা চলছে, তাও উল্লেখ করেননি। বিগত মেয়াদে এই অর্থমন্ত্রীর আমলে শেয়ার বাজার লুট হয়েছে। আজও তার কোনো বিচার হয়নি। এ বছর হলমার্ক, বিসমিল্লাহ সহ বাংলাদেশ ব্যাংক হতে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের বিচারের ব্যাপারের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য তৎপরতা জাতির সামনে আসেনি। আশাকরি সমাপনী ভাষণে অর্থমন্ত্রী, দুর্নীতি অনিয়ম, ঘুষ ও সুশাসন নিয়ে দিক নির্দেশনা মূলক বক্তব্য রাখবেন, যা বাজেট বাস্তবায়নে কাজে আসবে।
৮. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বাজেট বাস্তবায়ন: বিগত বছরটি রাজনৈতিক উত্তাপ ছাড়াই সরকার বেশ নিরাপদে পার করতে পেরেছে। কিন্তু এডিবির বাস্তবায়ন টার্গেট অতিক্রম করতে পারেনি। বিগত অর্থ বছরে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল একেবারে শান্ত। কোন হরতাল, অবরোধ বা অস্থিতিশীল কোন পরিস্থিতি বিরাজ করেনি। এরপরও কেন দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে পারেনি?
বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাস্তবায়ন। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। আগামী বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই বর্তমান বাজেটকে একটি নির্বাচনী বাজেট বলা যায়। আগামী নির্বাচন সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ করাটাই বর্তমান সরকারের নিকট জাতি আশা করে। বিশ্বজুড়ে সকল বন্ধু দেশ আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক হওয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করছে। এই আস্থার জন্য সরকারকে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারকে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ করতে হবে।
৯. গ্যাস ও বিদ্যুৎ ¯¦ল্পতা: অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ২০১৮ সালের মধ্যে শিল্পখাতে সকল কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও টার্গেট অনুযায়ী উৎপাদন করতে সরকার সক্ষম বলে তিনি বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। ইতিমধ্যে সরকার ১ জুন থেকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি কার্যকর করেছে। একই বছরে দ্বিতীয় বার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। গ্যাসের এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ আরও ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। বিগত ৮ বৎসর ধরে সরকার শিল্পখাতের ক্যাপটিভ পাওয়ার দিচ্ছে না। কিন্তু কিছু কিছু শিল্প মালিক তাদের শিল্পে ক্যাপটিভ পাওয়ার গ্যাস সরবরাহ লাভ করেছে। গ্যাসের সরবরাহ শিল্পখাতে নেই বলে বিগত কয়েক বছর ধরে শিল্পে বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে। এখন কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ কেন্দ্রিক শিল্প গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগক্তাগণ চেষ্টা করছেন। তাও সময়মত দ্রæত সময়ে, কম খরচে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না। অত্যধিক ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে গ্যাস ও বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা যায়। তাতে শিল্পে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছে। শিল্পখাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি বন্ধ করতে হবে। তা না হলে শিল্প উদ্যোগক্তাগণ উৎপাদন খরচের ক্ষেত্রে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। একমাত্র তৈরি পোশাক শিল্পভিত্তিক বাংলাদেশকে উন্নত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে ২০২১ সালের পূর্বে গ্যাস ও বিদ্যুৎ মূল্য শিল্পখাতের জন্য বৃদ্ধি বন্ধ করতে হবে।
১০. মাদক ও তরুণ সমাজ: দেশের ৯ শতাংশ শিক্ষিত যুবক-যুবতী বেকার। কর্মসংস্থানের অভাবে যুবকেরা আজ অসামাজিক কর্মকাÐে লিপ্ত হচ্ছে। অন্যদিকে সমাজের বৃহৎ এক অংশ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি গ্রামে-গঞ্জে মাদকের ছড়াছড়ি। মাদক থেকে বাঁচার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে তেমন কোনো দিকনির্দেশনা নেই। সমাজ সেবা অধিদপ্তরে যে সকল মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে তাও অপ্রতুল, কর্মকাÐও সীমিত। বেসরকারি উদ্যোগে মাদক থেকে বাঁচার জন্যে কর্মসূচি ও সেবা মূলক গঠনমুখী কর্ম পরিকল্পনা খুবই কম। দেশে ১৫ থেকে ৩৫ বৎসর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই বিশাল হাতকে কাজে লাগাতে হবে। এই জন্য প্রয়োজন দেশি-বিদেশি শিল্পখাতে বিনিয়োগ। কিন্তু শিল্পে বিনিয়োগ কমে গেছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবে শিল্পখাতে বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসতে পারছে না। মাদক থেকে যুব সমাজকে বাঁচাতে হলে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এই জন্য ব্যাপক হারে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ব্যাংকের সুদের হার কমিয়ে এনে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে। বিদেশে কর্মসংস্থান ব্যাপক হারে সৃষ্টি করার জন্য সরকারকে আরও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। নতুন নতুন দেশে দক্ষ, অদক্ষ, শিক্ষিত, অশিক্ষিত জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে যুব সমাজের বেকারত্বের সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাজেটে এ ব্যাপারে আরও বেশি বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
১১. সাক্ষরতা ও দরিদ্রতা: দেশে ৪০ শতাংশ মানুষ এখন দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। অন্যদিকে সাক্ষরতার হার এখনও ৬০ শতাংশে আমরা উপনিত হতে পারিনি। কিন্তু শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তাতে সাক্ষরতার হার তেমন বাড়বে না। এখনও দেশে এমন গ্রাম রয়েছে যেখানে একটি সরকারি বা বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল নেই। প্রতিটি গ্রামে একটি করে প্রাইমারি স্কুল স্থাপন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাজেটে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির ব্যাপারে ব্যাপক আকারে কোন উদ্যোগের কথা উল্লেখ নেই। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে দারিদ্রতা দূর করার একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাপক কর্মসংস্থান না হলে ব্যাপক আকারে দারিদ্রতা দূর করা যাবে না। এই ক্ষেত্রে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি ছাড়া নিরক্ষরতা ও দারিদ্রতা দূর করা বা হ্রাস করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়।
লেখক: সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিটিএমএ এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইর্স্টান ইউনিভার্সিটি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন