মহিউদ্দিন খান মোহন : বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া লন্ডনে গেছেন গত ১৫ জুলাই। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তিনি সেখানে তার পা ও চোখের চিকিৎসা করাবেন এবং সেখানে অবস্থানরত বড়ছেলে তারেক রহমান, পুত্রবধু ও নাতনীর সাথে কিছুদিন অবস্থান করবেন। এছাড়া ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী কন্যারাও এখন লন্ডনে। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, চিকিৎসা ও পরিবারের সাথে ঈদুল আযহা উদযাপন করে বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন। যাবার আগে তিনি স্থায়ী কমিটির নেতাদের সাথে বৈঠক করে তার অনুপস্থিতিতে দলের কার্যক্রম কীভাবে চলবে তার একটি দিক নির্দেশনাও দিয়ে গেছেন বলে সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার এ সফর আকস্মিক কোনো ব্যাপার নয়। বেশ কিছুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল তিনি লন্ডনে তার বড় ছেলে তারেক রহমানের কাছে যাবেন। তার এ সফর নিয়ে দেশবাসী কারো কোনো প্রশ্ন আছে বলে মনে হয় না। কেউ কেউ অবশ্য এ প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছিলেন যে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেত্রীর দেশ ছেড়ে এতদিন বিদেশে থাকা কতোটা সমীচীন। তার অনুপস্থিতিতে দল নেতৃত্বহীন হয়ে পড়বে কীনা। জরুরি প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত আসবে কী করে। এসব প্রশ্নের জবাবে বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বর্তমানে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে থেকেই সহজে যে কারো সাথে যোগাযোগ করা যায়। রয়েছে ভিডিও কনফারেন্সের সুবিধা। ফলে দুই-তিন মাস দেশের বাইরে থাকলেও দল পরিচালনায় কোনো ধরনের সমস্যা হবার কথা নয়। এসব প্রশ্ন থাকার পরও বেগম খালেদা জিয়ার এ লন্ডন সফর নিয়ে দেশবাসী কারো মনে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আছে বলে মনে হয় না।
কিন্তু বেগম জিয়ার এ সফরকে নিয়ে ক্ষমতাসীন মহল থেকে যে ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে, তাতে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন। বেগম জিয়া লন্ডন যাবার একদিন পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রশ্ন তুলে বলেন যে, বেগম খালেদা জিয়া কি মামলার ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন? তিনি কি মামলার ভয়ে আর দেশে ফিরে আসবেন না? গত ১৭ জুলাই সচিবালয়ে নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, একজন মামলার ভয়ে দেশে আসেন না, আরেকজন টেমস নদীর পাড়ে গেলেন। শনিবার থেকে ফেসবুকে দেখছি, টুইটারে দেখছি স্ট্যাটাস। এতবেশি সময়ের জন্য একটি দলের চেয়ারপার্সন বিদেশে যাচ্ছেন। এখন জনশ্রæতি হচ্ছে- তিনি কি মামলার ভয়ে পালিয়ে গেলেন? তিনি কি মামলার ভয়ে ফিরে আসবেন না? একইদিনে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ এক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছেন, ষড়যন্ত্র করতে খালেদা জিয়া লÐন গেছেন। মন্ত্রী - নেতাদের এসব বক্তব্যের সাথে সুর মিলিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। একইভাবে কটাক্ষবাণ নিক্ষেপ করছেন বেগম খালেদা জিয়ার দিকে। ১৭ জুলাই সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রী সভার বৈঠক শেষে অনির্ধারিত আলোচনায় এক মন্ত্রী বলেন, উনি গেলেন, কিন্তু ফিরে আসবেন কীনা কে জানে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেখেন সে ফিরে আসে কী না। ( সূত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২১ জুলাই ২০১৭)। আর ‘মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়’- কবির এ অমরবাণীকে স্মরণ করেই বোধকরি ২১ জুলাই ফরিদপুরে এক সভায় স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনও একই কথা বলেছেন। আশা বা আশঙ্কা করা যায় যে, বেগম খালেদা জিয়া দেশে না ফেরা পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে এবং আওয়ামী লীগের নানা পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীরা নানা ধরণের ব্যঙ্গ-বিদ্রæপের কাদা ছুঁড়তেই থাকবেন।
বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের এসব বক্তব্য-মন্তব্য দেশবাসীর মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একজন শীর্ষ নেত্রীর বিদেশ সফরকে কেন্দ্র করে দায়িত্বশীল কোনো নেতা এ ধরনের বালখিল্য মন্তব্য করতে পারেন কী না বা তা কতোটা শোভনীয় এ প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। বিএনপি মহাসচিব আওয়ামী লীগ নেতাদের মন্তব্যকে রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বলে মন্তব্য করেছেন। গত ২১ জুলাই ঠাকুরগাঁওয়ে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মির্জা আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে এখন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিষোদগার করছে। তিনি বলেছেন, আমরাও আওয়ামী লীগের সমালোচনা করি, তবে তা শিষ্টাচার মেনেই করি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ সে কাজটা করে না। (সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব, ২২ জুলাই, ২০১৭)।
এদিকে বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে গণমাধ্যমেও আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। তিনি কেন এত লম্বা সময়ের জন্য লন্ডন গেলেন, সেখানে চিকিৎসা ছাড়াও রাজনৈতিক কি কি কাজ করবেন তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। কেউ কেউ বলছেন যে, বিএনপি যে নির্বাচনকালিন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করবে, তা নিয়ে পূত্র ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্যই মূলত: বেগম জিয়া লন্ডন গেছেন। এ প্রসঙ্গে গত ২০ জুলাই প্রথম আলো পত্রিকায় সোহরাব হাসান লিখেছেন,‘কয়েক মাস ধরেই বিএনপির নেতারা বলে আসছিলেন, নির্বাচনকালিন সহায়ক সরকারের একটি রূপরেখা দেবেন। অনেকের ধারণা, সেই রূপরেখা চুড়ান্ত করতেই খালেদা জিয়া লন্ডন গেছেন।’ একই নিবন্ধে তিনি বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য প্রসঙ্গে লিখেছেন,‘জনশ্রæতি নিয়ে একজন দায়িত্বশীল নেতার এ ধরনের মন্তব্য মানায় না।রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন জনশ্রæতিও আছে যে আওয়ামী লীগ চায় না বিএনপি নির্বাচনে আসুক। আর খালেদা জিয়া বিদেশে থাকলেই সেটা সম্ভব। বিএনপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা এত বিচলিত না হয়ে নিজের ঘর সামলাক। ছাত্রলীগের হানাহানি বন্ধ করুক।’
প্রবীণ সাংবাদিক সোহরাব হাসান যর্থাথই বলেছেন। বিএনপিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা যত সময় ও মেধা ব্যয় করছেন তা না করে সেটা যদি নিজেদের সংগঠনের কাজে লাগাতেন তাতে তাদের দল উপকৃত হতো। যে ধরনের ভাষা ও কায়দায় তারা বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে কথিত ‘জনশ্রæতি’কে পুঁজি বানিয়ে সমালোচনার তীর নিক্ষেপ করে চলেছেন, তা সব সভ্যতা-ভব্যতার সীমারেখা অতিক্রম করে গেছে বলেই সচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেকেই এই নিবন্ধের লেখকের কাছে উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, রাজনীতিতে বিরোধিতা, শত্রæতা, নিন্দা- সমালোচনা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে প্রতিদ্ব›দ্বী রাজনৈতিক দলের নেতা- নেত্রীদের প্রতি ন্যুনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকবে না এটা কি মেনে নেয়া যায়? বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একটির শীর্ষ নেতা। তিনি তিনবার এদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও দুইবার জাতীয় সংসদে বিরাধী দলীয় নেতা ছিলেন। তার রয়েছে আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার এক গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে আপোস করার নজির তিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সৃষ্টি করেন নি। এ আপোসহীনতা যেমন তাকে খ্যাতি এনে দিয়েছে, আবার তা তাকে বিপদসঙ্কুল পথেও ঠেলে দিয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা জরুরি অবস্থার ( ওয়ান- ইলেভেন) কথা স্মরণে আনতে পারি। ওই সময় দেশত্যাগের জন্য বেগম খালেদা জিয়ার ওপর যে তীব্র চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল তা দেশবাসীর অজানা নয়। কিন্তু প্রবল সে চাপের মুখেও তিনি আপন সিদ্ধান্তে ছিলেন অবিচল। শত চেষ্টা করেও ওই সরকার তাকে দেশত্যাগে সম্মত করাতে পারেনি। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। দেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। বাঁচলে এদেশেই বাঁচবো, মরলে এ দেশেই মরবো।’ বেগম খালেদা জিয়ার সে অনমনীয়তার কাছে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল জরুরি সরকারকে। তারা হাল ছেড়ে দিয়ে অন্য পন্থায় সিদ্ধিলাভের চেষ্টায় রত হয়েছিল। একটি কথা বোধকরি জোর দিয়েই বলা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার আপোসহীনতার কারণেই জরুরি সরকারের ‘মাইনাস টু’ ফর্মূলা সফলতার মুখ দেখে নি। স্মরণ রাখা দরকার, ওই সরকারের চাপের মুখে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ১৫ মার্চ ২০০৭ এ দেশত্যাগ করেছিলেন। প্রচÐ চাপের মুখেও বেগম খালেদা জিয়াকে দেশত্যাগে রাজী করাতে না পারায় শেখ হাসিনার বাংলাদেশে ফিরে আসার সুযোগ সুষ্টি হয়। এসব কথার কথা নয়, নিকট ইতিহাসের জাজ্বল্যমান সত্য। তো ভয়ের কাছে নতি স্বীকার না করা সে নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা যখন হাস্যকর মন্তব্য করেন, তখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে তারা কি হুশে আছেন, নাকি অজানা আতঙ্কে অবোল তাবোল বকতে শুরু করেছেন?
তবে, বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর যে ক্ষমতাসীন মহলকে কিছুটা হলেও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। এ বিষয়ে গত ২১ জুলাই দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ‘খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরে আওয়ামী লীগে টেনশন’ শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদনে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। পত্রিকাটি লিখেছে,‘ লন্ডন সফর নিয়ে ভেতরে ভেতরে টেনশনে আছে আওয়ামী লীগ। লন্ডনে ছেলের সাথে বৈঠক করে কি বার্তা নিয়ে আসেন খালেদা জিয়া, তার ওপর নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের আগামীদিনের রাজনৈতিক সমীকরণ। ফলে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যক্ষেণও করছে ক্ষমতাসীনরা।’ প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আওয়মী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা মনে করেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি গভীর ষড়যন্ত্র করছে। বিএনপি নেত্রী চিকিৎসার নাম করে লন্ডন গেছেন তার বড় ছেলে তারেক রহমানের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন আনতে। নির্বাচনের আগে ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত ছক কষতে লন্ডনে মা- ছেলে শলা- পরামর্শ করবেন। পত্রিকাটি আওয়ামী লীগের দু’জন কেন্দ্রীয় নেতার বক্তব্যও তুলে ধরেছে ওই প্রতিবেদনে। তারাও একই ধরনের কথা বলেছেন।
‘বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়’ বলে একটি প্রবাদ আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত। এর মর্মকথা কারো অজানা নয়। তাহলে কি আওয়ামী লীগকে এখন মনের বাঘে খেতে শুরু করেছে? বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর গোপন কোনো বিষয় নয়। পা ও চোখের চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডন যাবেন, এ কথা কয়েক মাস আগে থেকেই প্রচারিত ছিল। সেখানে তার বড় ছেলে তারেক রহমান অবস্থান করছেন এবং তিনি তার বাসাতেই অবস্থান করবেন সেটাও সবাই জানেন। আর যেহেতু তারেক রহমান দলের দ্বিতীয় শীর্ষনেতা, তাই তাদের মধে দলের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। দলের নীতি নির্ধারণী বিষয় কিংবা আগামীদিনের কর্মপন্থা সম্বন্ধে তারা যদি আলোচনা করেন তাকে কি কোনোভাবেই ষড়যন্ত্রের সংজ্ঞায় ফেলা যায়?
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন