শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

ইসলামে বিনোদনের শিষ্টাচার

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

\ পাঁচ \

আবূ হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সালমান আল ফারিসী রা. ও আবুদ দারদা রা. এর মাঝে রাসূল স. ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে দিলেন। একদিন সালমান রা. আবুদ দারদা রা. এর সাথে সাবাত করতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন যে, তার স্ত্রী উম্মুদ দারদা রা. জীর্ণ শীর্ণ কাপড় পরে বির্মষ অবস্থায় আছেন। তখন তিনি তাকে বললেন তোমার এ কী দশা? তিনি বললেন, তোমার ভাই আবুদ দারদা দুনিয়াবিমুখ হয়ে গেছে। তারপর আবুদ দারদা রা. বাড়িতে আসলেন, তিনি তার মেহমানের জন্যে খাবার তৈরি করলেন, তারপর তাকে বললেন, খাও তিনি নিজে বললেন, আমি রোযাদার। সালমান আল ফারিসী রা. বললেন তুমি না খেলে আমি খাচ্ছি না। বর্ণনাকারী বললেন, তারপর তিনি খেলেন। যখন রাত হলো তখন আবুদ দারদা রা. রাতের নামাজের জন্যে দাঁড়াতে গেলেন, কিন্তু সালমান রা. বললেন তুমি শুয়ে পড়ে। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। তারপর আবার উঠতে চাইলেন, কিন্তু সালমান রা. বললেন ঘুমাও। অতঃপর যখন রাতের শেষাংশ হলো, তখন সালমান রা. বললেন এবার ওঠ. তারপর তারা দুজন নামাজ আদায় করলেন। তারপর সালমান রা. আবুদ দারদা রা. কে লক্ষ্য করে বললেন, তোমার ওপর তোমার প্রভুর হক আছে, তোমার ওপর তোমার নিজের নাফস এর হক রয়েছে। তোমার ওপর তোমার পরিবারের হক রয়েছে। প্রত্যেক হরদারকে তার হক প্রদান করো। তারপর আবুদ দারদা রা. রাসূলূল্লাহ স. এর কাছে এসে তা জানলে রাসূলুল্লাহ স. বললেন, সালমান সত্যই বলেছে। উপর্যুক্ত হাদীস গুলো থেকে প্রমানিত হয় যে, মানুষের আত্মার প্রশান্তি তথা বিশ্রামের প্রতি যতœশীল হওয়া উচিত। সময়ের একটি অংশ আনন্দ ও প্রফুল্লতায় কটানো বাঞ্জনীয়, যাতে কাজের প্রতি বিরক্তকর ভাব দূর হয় এবং ক্লান্তি বিদূরিত হয়, সাথে সাথে পূর্ণ একাগ্রতা ও স্বত:স্ফ’র্তভাবে আল্লাহ তাআলার ইবাদতে মশগুল থাকা যায়। ইসলামের প্রতিটি বিধানই যেহেতু সত্য বলিষ্ট ও বাস্তনিষ্ঠ, ভারসাম্যপূর্ণ ওমানবরুচির সাথে সামঞ্জস্যশীল, তাই অন্য কোন বিনোদন ব্যবস্থার তুলনায় ইসলাম প্রদর্শিত বিনোদন ব্যবস্থা আলাদা ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ঠমন্ডিত। নিম্নে আমরা ইসলামের বিনোদন ব্যবস্থা কতিপয় বৈশিষ্ঠ্য তুলে ধরছি।
আল্লাহর প্রতি ঈমানের একান্ত দাবি হলো, মানুষের সমগ্র জীবনটাই সর্বাপস্থায় তার বন্দেগীর অনুভূতির সজ্জীবিত থাকবে, আর জীবনের সকলের কাজকর্ম একমাত্র তার নির্দেশ অনুযায়ী পরিচারিত হবে। জীবনের আনন্দ নিরানন্দ ব্যস্ততা ও অবসর যাপন, ছোট খাট সবটুকুই ইসলামী শরীআতের আলোকে হওয়াটাই বান্দাহর বন্দেগীর দাবি। এ নিরিখে একজন আল্লাহর বান্দাহ বিনোদনকে এভাবে গ্রহণ করবেন যে, আমার দেহ মনের সুস্থতা আমাকে হক্কুলাহ (আল্লাহর হক্ব) ও হক্কুল ইবাদ (বান্দাহর হক্ব) আদায়ে সক্ষম রাখবে, পূর্ন উদ্ধার ও একাগ্রতা নিয়ে আমার ওপর মহান আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারব। তাহলে একজন মুমিন ব্যক্তি তার জীবনে যে সময়টুকু শরীয়ত নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চিত্ত বিনোদনে ব্যয় করবেন,তা নিঃসন্দেহে আল্লাহর বন্দেগীর আওতায় গণ্য হবে।
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ স. এর একটি হাদীস আমাদেরকে চমৎকার শিক্ষা প্রদান করে। তিনি বলেন, তোমাদের কেউ স্বীয় স্ত্রীর সাথে সহবাস করলে, তাতেও সাদাক (সাওয়াব) হবে। এ কথা শুনে সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল! আমাদের কেউ তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে যৌন চাহিদা পূরণ করলেও কি সে সাদাকার সাওয়াব পাবে? তখন রাসূলূল্লাহ স. বললেন কেউ যদি তার যৌন চাহিদা হারাম পন্থায় পূরণ করে, তাহলে এতে কি গুনাহ হবে বলে তোমরা মনে করো না? তারা বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই গুনাহ হবে। রাসূলুল্লাহ স. বললেন এভাবেই তো বৈধ উপায়ে নিজ স্ত্রীর সাথে মেলামশা করলে আল্লাহর কাছে সাওয়াব পাওয়া যায়। এভাবে একজন মুমিন তার সকল কার্যকলাপ কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সম্পাদিত করে আল্লাহর বন্দেগীর অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এ প্রসঙ্গে সাইয়িদুনা মু আয় ইবনু জাবাল রা. এর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন: আমি আমার নিদ্রাতে ও আল্লাহর কাছে সওয়াবের আশা রাখি, যেমন আমি রাতে নির্ঘুম থেকে ইবাদতের মধ্যে সওয়াবের আশা করে থাকি। সর্বাবস্থায় ইসলাম নির্দেশিত মৌলিক বিষয়গুলো অটুট রেখে স্থান, সময় ও পরিবেশের আলোকে বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যম মানুষ নির্ধারন করতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, কোন অবস্থাতেই যেন বিনোদন ব্যবস্থা ব্যক্তিকে পাপাচার ও সীমালংঘনের দিকে ধাবিত না করে। কারণ, যা হারামের দিকে নিয়ে যায়, ইসলাম তাকে হারাম ঘোষণা করেছে। দেহ, আত্ম ও বিবেক বুদ্ধির সমন্বয়েই একজন মানুষ। কাজেই ইসলাম একটি স্বভাবগত জীবনব্যবস্থা হিসেবে মানুষের মানসিক, দৈহিক ও আত্মিক সব রকমের বৈধ চাহিদা পূরণের যথার্থ নির্দেশনা দিয়ে থাকে। মোটকথা ইসলামের বিনোদন পদ্ধতি মানবপ্রকৃতি ও রুচির সাথে পূর্ণসামঞ্জস্যশীল।
মানব জীবনের বিভিন্ন দিক রয়েছে। যেমন: আত্ম, শরীর ও বিবেব। তার আরো রয়েছে নানা প্রকার ঝোঁক প্রবণতা। এগুলোর মাঝে সামগ্রিক সমতা ও পূর্ণতা না এলে মানব জীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ইসলাম প্রদত্ত বিনোদন ব্যবস্থা মানুষের জীবনে ভারসাম্য এনে দেয়। ফরে মানষ অবসাদ মুক্ত হয়ে প্রশান্তি ও স্থিরতা খুঁজে পায়।
ইসলাম প্রদত্ত বিনোদন ব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ঠ্য হলো, এটি বিনোদনমূলক কর্মকান্ডকে আবশ্যিক কর্মকান্ডের ওপর প্রাধান্য দেয় না। বিনোদন চর্চা হবে অবসর সময়ে, যখন ব্যক্তি তার ওপর আবশ্যিকভাবে পালনীয় দায় দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকেন। সুতরাং ওয়াজিব ইবাদত, উর্পাজন, খাওয়া দাওয়া ঘুম ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কাজের ওপর বিনোদনমূলক কাজ প্রধান্য পাবে না। অনুরূপভাবে আত্মীয় স্বজনের দেখাশুনা রুগ্ন ব্যক্তির সেবা যতœ ইত্যাদির ওপর বিনোদনমূলক কর্মতৎপরতা অগ্রাধিকার পাবে না। ইসলামে বিনোদনের মূলনীতি মূলগত ভাবে বিনোদন হলো একটি জায়িয। ইসলামী শরীআতের একটি বড় মূলনীতি হলো সাধারণ যেকোন বিষয়ে মূলনীতি হলো- যতক্ষন পর্যন্ত কোন বিষয় হারাম হওয়ার সুস্পষ্ট দলিল না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ তা হালাল হিসেবে গণ্য হবে।
এ প্রসঙ্গে রাসূল স. বলেন: আল্লাহ তাআলা তার কিতাবে যা হালাল করেছেন তা হালাল, আর যা হারাম করেছেন তা হারাম। আর যে সব বিষয় নিয়ে তিনি নীরব রয়েছেন (হালাল কিংবা হারাম হওয়ার হুকুম বলেননি।) তাতে রয়েছে ছাড়। সুতরাং তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত ছাড় গ্রহণ করো। কেননা আল্লাহ তাআলা কোন কিছু ভুলেন না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ স. তার এ বক্তব্যের পক্ষে (কুরআনের সূরা মারইয়ামের ৬৪ নং আয়াত) পড়লেন আর আপনার প্রভু বিস্মৃত হওয়ার নন। সুতরাং বিনোদনের উপায় উপকরণ, ধরন প্রকৃতি, যদি ইসলামি শরীয়াহর প্রতিষ্ঠিত মূলনীতির পরিপন্থি না হয়, তাহলে সে বিনোদন ব্যবস্থা জায়িয বলে গণ্য হবে।
বিনোদন মানব জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভারসাম্য আনয়নের মাধ্যম মাত্র। জীবনের কোনো এক দিকের ভারসাম্য বিনষ্ট হলে সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে জীবনের সে অংশের পরিপূর্ণতা লাভের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হয়। কিন্তু যদি এ সীমালঙ্গন করে বিনোদনকেই জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিণত করা হয়, তখন সে বিনোদন বৈধতার গন্ডি পেরিয়ে মাকরুহ বা হারামের পর্যায়ের চলে যায়। সুতরাং বিনোদন কোনো পেশা নয়, একে যদি পেশা হিসেবে গ্রহণ করাহ হয়, তকন তা বৈধ থাকে না। কেননা এমতাবস্থায় তা ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে ধর্মীয় ও অত্যাবশ্যকীয় কাজ থেকে দূরে নিয়ে যাবে। প্রয়োজসাতিরিক্ত এ সব বিনোদনমূরক কর্মকান্ড ইসলাম কোন অবস্থাতেই অনুমোদন দেয় না। কারণ, ইসলাম যেখানে ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রে ও সীমালঙঘন পছন্দ করে না, সেখানে বিনোদনের মত মুবাহ একটি বিষয় জীবনের উদ্দেশ্য বানানোকে মোটেও সমর্থন করে না।
ইতঃপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে, ইসলামের দৃষ্টিতে বিনোদনমূলক তৎপরতা হলো প্রতিবিধানমূলক ব্যবস্থা, যা মানুষের দেহ মনের নানা অসংগতি দূর করতে সহায়তা করে। আবশ্যকীয় কর্মকান্ডই মানুষের জন্যে মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন