বিশ্বের ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারমাধ্যম সমূহের অবিশ্বস্ততা ও পক্ষপাতদুষ্ট নীতির অশুভ পরিণাম দাঁড়িয়েছে এই যে বিভিন্ন মহল কর্তৃক আজ বিশ্বের সর্বত্র ইসলামকে জুলুম, বর্বরতা, পাশবিকতা ও সন্ত্রাসের ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ঐ প্রচার মিডিয়াগুলো এখন তাদের সংবাদ, প্রতিবেদন, সমীক্ষা, ছায়াছবি, সক্ষাৎকার প্রচার পত্র ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে অহরহ এ ধারণা সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছে যে, ইসলাম ও শান্তি এমন দুটি পরস্পর বিরোধী বস্তু যে, তাদের একত্রে সমাবেশ কখনো সম্ভব নয়। কিন্তু আসল ব্যাপার এই যে, ইসলামী শিক্ষাকে মোটামুটিভাবে অধ্যয়ন করলেও উপরোক্ত ধারণা যে অমূলক ও ভিত্তিহীন তা যে কোন বিবেক-সম্পন্ন লোকের পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা মোটেই কঠিন নয়। প্রকৃত পক্ষে ইসলাম যেভাবে শান্তি ও নিরাপত্তা, ঐক্য ও সাম্য এবং ইনসাফ ও ন্যায়নিষ্ঠতার প্রতিনিধিত্ব করে তার বাস্তব দৃষ্টান্ত পেশ করা বিশ্বের কোন ধর্ম, সভ্যতা বা সমাজ ব্যবস্তার পক্ষে আজো সম্ভব হয় নি। ভবিষতে হবার কোন সম্ভাবনা নাই। এক কথায় বলতে গেলে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আবির্ভাবের প্রধান লক্ষ্যই ছিলো মানুষের মধ্যে শান্তি ও স¤প্রীতি প্রতিষ্ঠা। এই অর্থে তিনি ছিলেন বিশ্ববাসীর জন্য রহমত তথা আশীর্বাদ স্বরূপ। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুহাম্মাদ! আমি তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া: ১০৭) সত্যিকারের অর্থে ইসলাম হচ্ছে আগাগোড়া একটি আশীর্বাদ। সন্ত্রাস, জুলুম, অত্যাচার, বর্বরতা ইত্যাদি অসামাজিক অমানবিক অনাচার ও কদাচারের সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্ক নেই। ইসলাম একজন অমুসলিমের কাছে এই দাবি করে যে, সে যেন স্থির,ধীরতা ও বিচক্ষণতার সাথে ইসলাম অধ্যয়ন করে এবং গভীরভাবে তার ক্রিয়াকর্মগুলোও প্রত্যক্ষ করে আর একজন মুসলিমকে নির্দেশ দেয়, সে যেন অমুসলিম বিশেষ করে আহলে কিতাব তথা ইয়াহূদ ও খৃষ্টানদেরকে হিকমত ও বিজ্ঞতার সাথে উপদেশ প্রদান করে। এবং বুঝিয়ে তাদেরকে ইসলামের তথা শান্তি ও স¤প্রীতি আন্দোলনের নৈকট্যে নিয়ে আসে। তাদের সাথে অযথা তর্ক-বিতর্ক করবে না, আর এমন কোন আচরণও করবে না যার ফলে তাদের সাথে হিংসা-বিদ্বেষ বা শত্রুতা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করলেও তা করতে হবে সৌজন্যের সাথে, যুক্তি ও প্রমাণের সাথে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত আহলে কিতাবের সাথে বিতর্ক করবে না। তবে তাদের সাথে করতে পারো, যারা ওদের মধ্যে সীমালঙ্গনকারী। এবং বল, আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাতে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো এক আল্লাহ। আমরা তারই প্রতি আত্মসমর্পণকারী।’ (সূরা আনকাবুত: ৪৬) এই আয়াতের মাধ্যমে ইসলামের অনুসারীদেরকে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা প্রতিপদে স্থিরতা, ধীরতা, বিজ্ঞতা ভদ্রতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। তারা যেন রুঢ় কথার জবাব ন¤্র কথায় এবং রাগের জবাব সহিষ্ণুতায়, অভদ্রতার জবাব ভদ্রতায় এবং হৈ চৈ ও চেঁচামেচির জবাব ন¤্রতা ও গাম্ভীর্যের সাথে প্রদান করে। হ্যাঁ, যদি কেউ বিজ্ঞতাপূর্ণ প্রমানভিত্তিক কথার জবাব ঔদ্ধত্যের সাথে প্রদান করে তাহলে তার সাথে তারই মানানসই ভাষা ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এ অবস্থায়ও এটা শ্রেয় যে, যথা সম্ভব ন¤্রতা ও ভদ্রতাকে যেন হাতছাড়া না হয়। পবিত্র কুরআনে মুসলমানদেরকে আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের সাথেও অনুরুপ আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহŸান কর হিকমত (বিজ্ঞতা) ও সদুপদেশ দ্বারা এবং ওদের সাথে আলোচনা-পর্যালোচনা (বিতর্ক) কর সদ্ভাবে।’ (সূরা নাহল: ১২৫)
পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় প্রিয় নবী (সা.) এর মাধ্যমে মুসলমানকে এই শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে যে, তারা যেন সবাইকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে, ভালো দ্বারা খারাপকে প্রতিরোধ করে, সব সময় যেন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দেয় এবং কোন অবস্থায়ই যেন শান্তি-শৃংখলা ও ন্যায়-বিচারকে হাতছাড়া না করে। তাদের প্রধান চিন্তা যেন এমন হয়, কিভাবে আমি আমার সম্বোধিত ব্যক্তির অন্তরে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবো এবং কিভাবে তাকে দেখাতে সক্ষম হবো সরল ও সঠিক পথ। এভাবে যদি তা (মুসলমানের) দলীল-প্রমাণ অন্যদের (অমুসলিমদের) বোধগম্য হয়, তার আচার-আচরণ সভ্য ভব্য হয়, ইসলাম তথা একটি সরল সঠিক দীনকে বুঝাবারই লক্ষ্যই তার কথোপকথন হয় তাহলে অবশ্যই সে সম্বোধিত ব্যক্তির (অমুসলিমদের) চিন্তা ধারার সংশোধন ও প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনে সক্ষম হবে। বিনয় ব্যবহার ও বিন¤্র আচরণের প্রতিফল সব সময়ই সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে থাকে, তা পবিত্র কুরআনে নিম্নে আয়াত দ্বারা অতি সহজেই বুঝা যায়। ‘ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত।’ (সূরা হা-মীম সাজদা: ৩৪)
ইসলাম এতই শান্তি প্রিয় ধর্ম যে, মুসলমানকে যুদ্ধাবস্থায়ও জুলুম ও বাড়াবাড়িমূলক আচরণ থেকে নিরস্ত রাখে, নির্দোষ মানুষকে বিরক্ত করতে নিষেধ করে, যে কারো সাথে অমানবিক ব্যবহার থেকে দূরে রাখে। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ত্রুরা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবে এবং আল্লাহর উপর ভরষা রাখবে। তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’ (সূরা আনফাল ৬১) যারা দুশমনের পেশাকৃত সন্ধির আহŸানে সাড়া দেয়, তারা মূলত ওদের মানবিক ও চারিত্রিক স্পৃহাকে জাগ্রত ও প্রস্ফুটিত করে তুলে এবং নিজেদেরকে ওদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্রে পরিণত করে। এজন্যই এ জাতীয় লোকদেরকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিষ্কৃত করেনি তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়-বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায় পরায়ণদেরকে ভালোবাসেন।’ (সূরা মুমতাহানা: ৮) যে সব অমুসলিম মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনরুপ ষড়যন্ত্র করে না এবং তাদেরকে কোনরুপ কষ্ট দেয় না, ইসলাম তাদের সাথে দয়া, মায়া, হৃদ্যতা, সহানুভূতি, শুভাকাক্সক্ষা ও শুভেচ্ছামূলক আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। অবশ্য যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তাদের সাথে তাদেরই কর্মদোষের কারণে ভালো ব্যবহার করা যাবে না সত্য, তবে কোন অবস্থায়ই বাড়াবাড়ি মূলক আচরণ করা যাবে না। বরং বাহ্যিকভাবে হলেও তাদের সাথে যথা সম্ভব সভ্য আচরণ করতে হবে। আর কোনরুপ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশংকা না থাকলে তাদের সাথে সব রকমের ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যেতেও আপত্তির কিছুই নেই। আমাদের প্রিয় নবী (সা.), সাহাবায়েকেরাম, তাবেয়ীন এবং পরবর্তী যুগের মুসলিম মনীষিদের জীবনে এমন অসংখ্য ঘটনা পরিদৃষ্ট হয় যেগুলোতে অমুসলিমদের সাথে দয়াদ্র ব্যবহার ও বিনয় নম্র আচরণের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। আর নবী (সা.) যেভাবে অমুসলিমদের সাথে সর্বাবস্থায় মানবতাসুলভ দয়াদ্র আচরণ করেছেন তার দৃষ্টান্ত মানব ইতিহাসে বিরল।
মক্কা বিজয়ের মুহূর্তে ইসলামের কট্টর শত্রুদেরকে যাদের অমানুষিক জুলুম অত্যাচারের কারণে একদা রাসূল (সা.) অশ্রুসজল নয়নে আপন প্রিয় মাতৃভূমি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাদেরকে বিনা শর্তে ক্ষমা করে দেন। বিশ্ব-ইতিহাসে এ ধরণের দৃষ্টান্ত শুধু তুলনাহীন নয়, অকল্পনীয়ও বটে। অবশ্য তাঁর এই ব্যবহারের ফলে ঐ সব কট্টর শত্রুদের হৃদয় বলতে গেলে নিমিষের মধ্যেই এমন পরিবর্তন আসে যে, তারা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। এবং দলে দলে ইসলাম তথা শান্তির সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। তাঁর কট্টর শত্রু মক্কাবাসীরা যখন ভয়ানক দুর্ভিক্ষের সম্মুখিন হয়, তখনো দয়াল নবী (সা.) অনতিবিলম্বে তাদের কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধে যে সমস্ত কাফের বন্দী হত, তিনি তাদের সাথে আপন সহোদরের মত ব্যবহার করতেন। তাযেফে আল্লাহর দীন প্রচার করতে গেলে হুজুর (সা.)কে প্রস্তর নিক্ষেপে রক্তাক্ত করে তোলা হয়। এতদসত্তে¡ও তিনি তাদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন এবং পরবর্তী সময়ে যখন তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হন তখনো তাদের উপর কোন প্রকার প্রতিশোধ নেননি, বরং তাদেরকে অকাতরে ক্ষমা করে দেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) তার কথা কাজে ও আচার-আচরণে যে নম্রতা, ভদ্রতা ও ধৈর্য-সহিষ্ণুতার নমুনা পেশ করেছেন তা চিরদিন মানুষের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে নম্রতা যে জিনিসের মধ্যে আছে, সে জিনিস সৌন্দর্যমন্ডিত। আর নম্রতা যে জিনিসে মধ্যে নেই সে জিনিস দূষণীয়।’ (সহীহ মুসলিম) বিনয়,নম্রতা,দয়া,করুণা,সদাচার সদালাপ, সদ্ব্যবহার প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য ইসলাম তার অনুসারীদেরকে বার বার তাকিদ দিয়েছে। আর নির্দেশ দিয়েছে কঠোরতা, নির্দয়তা,অনাচার, অবিচার ও বদমেজাজী থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার। তাইতো হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা পরম করুণাময় এবং তিনি প্রতিটি ব্যাপারেই বিনয় ও করুণাকে পছন্দ করেন।’(বুখারী শরীফ) রহমতের নবী (সা.)বলেন, ‘মহান রাব্বুল আলামীন নম্রতার উপর ততটুকু দান করেন, যতটুকু কঠোরতার উপর করেন না এবং নম্রতা ছাড়া অন্য কিছুর উপরও অনুরুপদান করেন না। (মুসলিম শরীফ) বিনয় নম্রতাকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার পছন্দ করাটা এ কথারই ইঙ্গিতবহ যে, এর মধ্যে মানুষের দুনিয়া-আখেরাতের যাবতীয় উপকার ও মঙ্গল নিহিত রয়েছে। অতএব মানুষের উচিত, তারা যেন নিজেদের মধ্যে নম্রতা, স্নেহমমতা ও দয়াদ্রতারুপি গুণাবলীর প্রসার ঘটায়, যাতে তাদের সামাজিক, সামষ্টিক ও সামগ্রিক জীবন সুখ-শান্তিতে ভরে উঠে এবং তারা সব রকম নির্দয়তা, স্বার্থপরতা, অনাচার, কাদাচার, মারামারি, হানাহানি, সন্ত্রাস ও বিশ্বাসঘাতকতা থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হয়। কেননা যে সমাজে বা রাষ্ট্রে পরস্পর স্নেহ-ভালোবাসা বিস্তার লাভ করে সে সমাজ বা রাষ্ট্র অবশ্য অবশ্যই সুখ-শান্তির জোয়ারে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ।
কোন কোন সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও তাদের চালচলে ও আচার-আচরণে কঠোর হয়ে থাকেন। তাদের ধারণা, কঠোরতা অবলম্বন করলে অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে অন্যের কাছ থেকে কার্যোদ্ধারের করা সম্ভব হয়। কেননা এতে জনসাধারণের মনে যে ভয়-ভীতির সঞ্চার হয় তাতে তারা ইচ্ছা হোক কিংবা অনিচ্ছা হোক, যে কোন আদেশ পালন না করে পারে না। কিন্তু ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সা.) এই ধারণাকে রদ করে দিয়ে ঘোষণা করেছেন, দয়া ও নম্রতা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার সত্তাগত গুণ এবং তা আল্লাহর নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয় বস্তু। আসলে এক মানুষের কাছ থেকে অন্য মানুষের কার্যোদ্ধার করাটা আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও ইরাদার উপর নির্ভর করে এবং খোদ আল্লাহ তায়ালার ফায়সালা, যে নম্রতা অবলম্বন করবে তাকে তিনি এমন পুরষ্কার প্রদান করবেন, যে পুরষ্কার অন্য কাজের মাধ্যমে অর্জন করা যায় না। বিনয় বা নম্রতা হচ্ছে এমন একটি গুণ যার মাধ্যমে মানুষ অতি সহজেই আল্লাহর দয়া ও করুণার অধিকারী হতে পারে। অবশ্য কঠোরতার মাধ্যমেও মানুষের কাছ থেকে কার্যোদ্ধার করা যায় সত্য, তবে এতে তার মনে আঘাত লাগে এবং এই আঘাতের ফলে সে মানসিক শান্তি থেকে বঞ্চিত হয়। অতএব মানুষের কাছ থেকে সেই পন্থা-পদ্বতিতেই কার্যোদ্ধার করতে হবে, যে পন্থায় কাজও হবে আর তার মনে আঘাতও লাগবে না। সুখ শান্তির অপর নামই ইসলাম। তাই ইসলাম বিনয় ও নম্রতার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে।
বিখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমি দশ বছর পর্যন্ত মদীনায় হুজুর (সা.)-এর খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। তখন আমার অনেক কাজই তাঁর পছন্দ হতো না। কেননা বয়স কম হওয়ার কারণে স্বভাবতই আমি অনেক ভুল ত্রুটি করে ফেলতাম। কিন্তু আমার এই দশ বছরের জীবনে হুজুর (সা.) কখনো আমার উদ্দেশ্যে ‘উফ’ শব্দও উচ্চারণ করেন নি এবং কখনো বলেননি যে তুমি এটা কেনো করলে বা কেনো এটা করলে না। (সুনানে আবু দাউদ) নবী (সা.)-এর বিনয় ও নম্র আচরণের উল্লেখ পবিত্র কুরআনে রয়েছে, যেমন, আল্লাহর দয়ার তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলে; যুদি তুমি রুঢ় ও কঠোর চিত্ত হতে তবে তারা তোমার আশপাশ হতে সরে পড়ত। (সূরা আলে ইমরান: ১৫৯) এর অর্থ এই যে, ইসলামী দাওয়াতের দ্রæত সাফল্য ও গ্রহণীয়তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, নবী (সা.)-এর নম্রতা ও খোশমেজাজী, যা পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরে ঢেলে দিয়েছিলেন। যদি এমন না হতো তাহলে নবী (সা.)-এর প্রতি মানুষের কোন আকর্ষণ থাকত না। ফলে তিনি তাদের অন্তর জয় করার সুযোগও পেতেন না। মোট কথা, বিনয় ও নম্রতা হচ্ছে অত্যন্ত প্রশংসনীয় গুণ। তবে ইসলামী শরীয়ত এরও সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। যেখানে দীনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়, কিংবা যেখানে দীনের হুকুম-আহকাম জারী করা অনিবার্য হয়ে উঠে। সেখানে কঠোরতা অবলম্বন করতেই হবে। অনুরুপ পরিস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এমনি কঠোর হয়ে উঠতেন যে, তার চক্ষুদ্বয় তখন রক্তবর্ণ ধারণ করত। এ ছাড়া অন্যান্য অবস্থায় তিনি কখনও কঠোর হতেন না। তখন তার বিনয়, নম্র ও সহৃদয় আচরণ ছোট-বড় সবাইকে সত্যিকারের অর্থে তার দিকে আকৃষ্ট করতেন।
অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয় যে, আজকাল ইসলামের এই মানবিক গুণাবলী ও অতুলনীয় আচার-আচরণের প্রতি আদৌ দৃকপাত না করে ইসলামকে জুলুম, অত্যাচার ও সন্ত্রাসের ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত কারার লক্ষ্যে আজ আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের শত্রু ইসলাম-বিদ্বেষী জ্ঞান পাপীরা যেভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে এবং তাদের মিডিয়াগুলো যেভাবে সত্যকে মিথ্যায় এবং মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে সেটাকে মিথ্যার চরম প্রহসন ছাড়া আর কীই বা বলা যেতে পারে? তবে একথা সকল মহলের জেনে রাখা উচিত যে, ইসলামের দৃষ্টিতে জালিমের জুলুমের প্রতিবাদ এবং প্রয়োজনে তা প্রতিরোধ করাও ফরয। এটা কঠোরতা বা সন্ত্রাস নয় বরং বিশ্বে ন্যায়, সভ্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি সংগ্রাম, যার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা মানুষ মাত্রেই কর্তব্য। ইসলাম মানে শান্তি ও স¤প্রীতি। তবে এর অর্থ এই নয় যে, জালিমের অন্যায় জুলুম প্রতিরোধ করা হবে না। বরং ইসলামের আকীদা হচ্ছে জালিমের জুলুম প্রতিরোধ করো এবং মাজলুমের পক্ষ অবলম্বন কর। শান্তি প্রিয়তার অর্থ এই নয় যে, জালিমের জুলুম মুখ বুজে সহ্য করা হবে, তাকে চিরদিন সিংহরুপেই টিকিয়ে রাখা হবে, এমনকি প্রয়োজন দেখা দিলে তার কাছে নিজের কাপুরুষতা প্রকাশ করে করজোড়ে তারই সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। অনুরুপ মানসিকতা কুরআন-হাদীসের সত্যিকার অনুসারী কোন মুসলমান হতে পারে না। বরং এই অবস্থায় তারা হবে সেই মানসিকতারই অধিকারী, যা আল্লামা ইকবাল রচিত নিম্নের দুটি পঙক্তিতে ফুটে উঠেছে। ‘হো হালকা-ই-ইয়ারা, তো বারীশম কী হা মুমিন, বাযমে হাক্বও বাতিল হো তো ফোলাদ হায় মুমিন।’ অর্থ, ‘মুমিন যখন তার বন্ধুদের মজলিসে থাকে তখন সে আপন আচরণে রেশমের চাইতেও নরম। আর যখন ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধ বাজে তখন সে ইস্পাতের চাইতেও কঠিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন