মহান আল্লাহপাক মানুষকে একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। শুধু নামাজ রোজা, হজ্ব ও যাকাত আদায় করার নাম ইবাদত নয়: বরং আল্লাহ ও তার রাসূলের হুকুম অনুসারে যখন যা করা হবে তাই ইবাদত রুপে গণ্য হবে। ব্যবসা বাণিজ্য হচ্ছে হালাল উপার্জনের একটি অনন্য পন্থা। ব্যবসাকে হালাল ঘোষণা করে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন- “আল্লাহপাক ব্যবসাকে বা কেনাবেচাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন” (সূরা বাক্বারা: আয়াত ২৭৫)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে ঘ্রাস করো না কিন্তু পরস্পর রাজী হয়ে ব্যবসা করা বৈধ’ (সূরা নিসা: আয়াত-২৯)।
যারা আল্লাহর বিধান অনুসারে ব্যবসা করে তারা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত মর্যাদাবান। যারা আল্লাহর অন্যান্য বিধান পালন করতঃ সৎভাবে ব্যবসা করে তাদের ভূয়সী প্রশংসা করে মহান আল্লাহপাক ইরশাদ করেন “সেই সকল লোক যাদেরকে ব্যবসা বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে এবং সালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান হতে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সেই দিনকে যেই দিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে”। (সূরা নূর: আয়াত-৩৭)।
উক্ত আয়াতে সৎ ব্যবসায়ীর পরিচয় দেয়া হয়েছে- বলা হয়েছে সৎ ব্যবসায়ী আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয় না, আল্লাহর বিধান পালনে সে সর্বদা তৎপর থাকে। একজন সৎ ব্যবসায়ী মানুষকে ওজনে কম দিতে পারে না। পণ্যে ভেজাল মিশ্রিত করে তা বিক্রি করতে পারে না। আল্লাহর বিধান পালনকারী একজন ব্যবসায়ী ব্যবসার ক্ষেত্রে কখনও কোন প্রকার প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারে না। অসৎ ব্যবসায়ীরা মানুষকে ওজনে কম দেয়, পণ্যে নানা ধরণের ভেজাল মিশ্রিত করে বাজারকে অস্থির করে তুলে।
এতে করে ক্রেতাদের দুর্ভোগ চরমে পৌছে। এরা বাহ্যিক লাভবান হয় বটে; কিন্তু এদের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। এদের করুণ পরিণাম সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে-“মন্দ পরিণাম তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। যারা লোকের নিকট হতে মেপে লওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য মাপে বা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়। তারা কি চিন্তা করেনা যে, তারা পুনরুত্থিত হবে মহা দিবসে (সূরা মুতাফফিফিন: আয়াত ১-৫)। যে সকল সৎ ব্যবসায়ী সঠিকভাবে মেপে দেয়, ব্যবসার ক্ষেত্রে কোন প্রকার মিথ্যার আশ্রয় নেয় না তাদের সু মহান মর্যাদা ও শুভ পরিণাম ঘোষণা করে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন- “মেপে দিবার সময় পূর্ণভাবে দিবে এবং ওজন করবে সঠিক দাড়িপাল্লায়, ইহাই উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্ট” (সূরা বনি ইসরাঈল: আয়াত-৩৫)।
অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের আকণ্ঠে নিমজ্জিত আমাদের সমাজ। অবৈধ ব্যবসার ছড়াছড়ি আজ সর্বত্র। অবৈধ ব্যবসার তান্ডবে আজ লুকিয়ে যাচ্ছে হালাল ব্যবসা। আমাদের সমাজে অনেক লোক আছেন যারা তথাকথিত ব্যবসার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমা রাখেন। আর ব্যাংক তাদেরকে মাসিক ১০% বা ২০% হারে লাভ দিয়ে থাকে। এরা ঘরে বসেই বিনা কষ্টে এই টাকা পেয়ে থাকেন।
তারা মনে করেন এটা ব্যবসা। এটা তাদের সম্পূর্ণরুপে ভুল ধারণা। আসলে এটা সুদ। এই সুদকে তারা খোড়া যুক্তি দিয়ে ব্যবসা প্রমাণ করার চেষ্টা করে। ব্যবসার নাম নিয়ে সুদের লেনদেন করছেন আমাদের সমাজের অনেকে। এদের পরিণাম অত্যন্ত করুণ। এদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- “তাদের অনেককেই তুমি দেখবে পাপে সীমালংঘনে ও অবৈধ ভক্ষণে (সুদ, ঘুষ-দুর্নীতিতে)” তৎপর: তারা যা করে নিশ্চয়ই তা নিকৃষ্ট” (সূরা মায়িদা: আয়াত-৬২)। ব্যবসা তো হচ্ছে সেটা যাতে টাকা বিনিয়োগ করা হয়, চিন্তা ফিকির ও পরিশ্রম করা হয় এবং লাভ ক্ষতি উভয়টাকে সর্বান্তকরণে মেনে নেয়া হয়।
চিন্তাফিকির নেই, পরিশ্রম নেই, কোন প্রকার ক্ষতিকে মেনে নেয়া হয় না- সেটাকে কোন বিবেকে ব্যবসা বলা হয়? ব্যাংক থেকে ২০% বা ৩০% লাভে বিনা পরিশ্রমে যা পাওয়া যায় তা সরাসরি সুদ। সুদকে ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. ইরশাদ করেন- “সুদের গুনাহের সত্তরভাগের ক্ষুদ্রতম ভাগ এই পরিমাণ যে, কোন ব্যক্তির নিজের মাকে বিয়ে করে” (মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা-২৪৬)। হযরত জাবের রা. বর্ণিত হাদীসে আছে- সুদ দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের উপরই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের লা’নত। (মুসলিম)।
ইসলামে হালাল ব্যবসার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যবসা করার সময় ক্রেতার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করলে ব্যবসায়ীর প্রতি আল্লাহ অত্যন্ত খুশী হন। তাকে জান্নাত দান করেন।
হযরত আবু হুজায়ফা রা. বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. ইরশাদ করেন- ‘তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের এক ব্যক্তির কাছে মালাকুল মাউত রুহ কবজ করার জন্য উপস্থিত হলেন- মালাকুল মউত তাকে জিজ্ঞেস করলেন- দুনিয়ার জীবনে তুমি কোন বিশেষ নেক আমল করেছ কি? সে বলল- আমার স্মরণ নেই- তবে একটি আমলের কথা স্মরণ হচ্ছে- আর তা হল দুনিয়ার জীবনে আমি লোকদের সাথে ব্যবসা করতাম। ব্যবসা ক্ষেত্রে আমি লোকদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতাম।
আমার খাতক ধনী হলে আমি তাকে সময় দান করতাম। আর খাতক গরীব হলে আমি আমার প্রাপ্য মাফ করে দিতাম। ঐ আমলের বদৌলতে আল্লাহপাক তাকে জান্নাত দান করেছেন’ (বুখারী ও মুসলিম)। সৎ ব্যবসায়ির শান-মান বর্ণনা করে হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. ইরশাদ করেন- “সত্যবাদী আমানতদার ও বিশ্বাসী ব্যবসায়ী ব্যক্তি কিয়ামতের দিনে নবীগণ সিদ্দিকগণ এবং শহীদগণের দলে থাকবেন” (তিরমিজী, দারে কুতনী, ও দারেমী)।
সুদ ব্যবস্থা আমাদের অর্থনৈতিক দুর্গতির মূল কারণ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করার লক্ষ্যে সকল প্রকার সুদী লেনদেনের প্রতি লাত্থি মেরে হালাল ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করা আমাদের সকলের উচিত। এই দুনিয়া তো ক্ষণিকের, পরের জীবনে আমাদের সব কিছুর জন্যই জবাব দিতে হবে। চরম বাস্তব এই চিন্তাটা আমাদের মধ্যে যেদিন আসবে, সেদিনই মুসলিমরা রক্ষা পাবে সুদ নামক ভয়ংকর আগুনের হাত থেকে। আল্লাহ আমাদের সকলকে সুদ ও হারাম থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক- প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন