বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে নিগৃহীত ও নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাম রোহিঙ্গা। গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমারের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনী, হৃদয়হীন সরকার ও অধার্মিক বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং তাদের অনুগত মানবতাহীন মগ ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের বাড়িঘর, হাট-বাজার, মসজিদ, মাদরাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে বিরানভূমিতে পরিণত করেছে। মিয়ানমার ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের এ গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ জাতি নির্মূল হিসেবে বিশ্বদরবারে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের মানবতাবাদী জনগণ ও সরকার এ সকল বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্ব পরিমন্ডলে নিজেদের মুখ উজ্জ্বল করেছে এবং সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শরণার্থীদের দুঃখ ও দুর্দশা দূরীকরণে সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ বিশ্বের মানবতাবাদীদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সকল জেলা ও প্রান্তের উলামায়ে কেরামের ত্রাণ বিতরণ ও নানা কর্মতৎপরতাও চোখে পড়ার মত- যা ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ। এরই অংশ হিসেবে গত ২২ সেপ্টেম্বর জামেয়া দারুল হুদা সিলেট-এর স্বনামধন্য মুহতামিম ও আল-হুদা আইডিয়াল একাডেমির প্রধান শিক্ষক হযরত মাওলানা মুজীবুর রহমান কাসিমীর নেতৃত্বে ৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি ত্রাণ-কাফেলা শরণার্থীদের আশ্রয় এলাকায় গিয়েছিলাম। জামেয়া ও একাডেমির ছাত্র-শিক্ষক, পরিচালনা কমিটির সদস্যবৃন্দ এবং অন্যান্য মুতাআল্লিকীন ও শুভাকাঙ্খীর দেয়া প্রায় পৌনে তিন লক্ষ টাকা শরণার্থীদের বিভিন্ন সেবাখাতে ব্যয় করেছি। তন্মধ্যে মসজিদ নির্মাণ, স্যানিটেশন, রোহিঙ্গা এতিমখানায় ছাত্রদের থাকা-খাওয়ার আসবাবপত্র প্রদান এবং অতিশয় অসহায় ও বিধবাদের মধ্যে নগত অর্থ বিতরণ অন্যতম। প্রায় এক সপ্তাহের সফরে টেকনাফ ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থায়ী-অস্থায়ী শরণার্থী ক্যাম্পে ঘুরে এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে যে উপলব্ধি হয়েছে তা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
১. আল্লাহর শোকর: মহান সৃষ্টিকর্তার শোকর। তিনি যদি আশ্রয় শিবির এলাকাকে পাহাড়ি অঞ্চল হিসেবে সৃষ্টি না করতেন, তাহলে শরণার্থীদের মাথা গোঁজার জন্য কত হাজার একর ক্ষেতের জমি লাগত- তা বিজ্ঞ নগর পরিকল্পনাবিদরাই অনুমান করতে পারেন। তাছাড়া সমতল ভূমিতে বসবাস করলে বৃষ্টির পানিতে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠত। আর পরিবেশ-প্রতিবেশসহ মানবিক বিপর্যয় এবং নানা মহামারি দেখা দিত। পাহাড়গুলি যেন আল্লাহ তাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। তাই লক্ষ-কোটি শোকর আল-হামদুলিল্লাহ।
২. এলাকাবাসীকে ধন্যবাদ: পরিবেশ দূষণ এবং মানুষের বাড়তি চাপ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা না করে এলাকাবাসী শরণার্থীদের সহায়তায় যে মানবিকতা ও উদারতার পরিচয় দিয়েছে তা সত্যিই অনুকরণীয়। বিশেষ করে (ক) দ্রব্যসামগ্রির দাম না বাড়ানো, (খ) যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি না করা, (গ) শরণার্থীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ না করা, (ঘ) বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বিধবা ও যুবতী মেয়েদের উৎপাত না করা, (ঙ) দূর-দূরান্ত থেকে ত্রাণ নিয়ে আসা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি না করা, (চ) ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি ও টানা-হেচড়া না করা ও (ছ) শরণার্থীদের ব্যবহার করে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত না হওয়া ইত্যাদি কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার সর্বস্তরের জনগণকে দেশবাসীর পক্ষ থেকে অশেষ ধন্যবাদ।
৩. সরকারের করণীয়: শরণার্থীদের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর দায়িত্বে ত্রাণকার্য অর্পণ করায় আভ্যন্তরীণভাবে তা সরকার ও শরণার্থীদের জন্য উত্তম এবং কল্যাণকর হয়েছে। তাছাড়া আরো যা করণীয় তা হলো:
(ক) দুর্নীতি দমন: দেশি-বিদেশি ত্রাণ এবং অর্থসহায়তার ব্যাপারে সরকারকে শতভাগ স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে হবে এবং বিনা-হয়রানিতে যেন শরণার্থীরা সমভাবে তা ভোগ করতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ত্রাণ নিয়ে যেকোনো প্রকার দুর্নীতি কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। ত্রাণের একটি টাকাও যেন বেহাত না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। আর মানবিকতার আড়ালে যেন কোনো রাজনৈতিক কূটচাল না থাকে তা জনগণের কাছে প্রমাণ করতে হবে।
(খ) শরণার্থী মন্ত্রণালয় গঠন: শরণার্থীদেরকে শুধু ন্যূনতম থাকা-খাওয়ার সুবিধা দিলেই চলবে না বরং তাদের জীবনমান উন্নয়ন, দেশে ফিরে যাওয়া, শিক্ষা-দীক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য শরণার্থী মন্ত্রণালয় গঠন করা সময়ের দাবি।
(গ) ডকুমেন্টারি নির্মাণ: নিরীহ জনগণের উপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মগ সন্ত্রাসীদের বর্বর নির্যাতন, পৈশাচিকতা, গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের একটি ফিরিস্ত ও ডকুমেন্ট তৈরি করে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সকল স্তরের নেতা, দল, মানবাধিকারকর্মী, সংগঠন ও সুশীল সমাজের কাছে হস্তান্তর করে জনমত গড়ে তুলতে হবে।
(ঘ) রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা: সুপরিকল্পিতভাবে সিরিজ কর্মসূচি গ্রহণ করে দেশে দেশে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের সকল নতুন-পুরাতন নাগরিকদের সসম্মানে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। প্রয়োজনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে হবে।
(ঙ) উলামা কনফারেন্স আহবান: যেহেতু রোহিঙ্গাদের ৯৫ ভাগই মুসলিম আর মুসলিমদের ধর্মীয় প্রতিনিধিত্ব করেন উলামায়ে কেরাম। তাই বিশ্বের প্রভাবশালী ও শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম এবং মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক উলামা কনফারেন্স আহবান করে তাঁদের কাছ থেকে পরামর্শ ও সহায়তা নিতে হবে এবং যাতে তাঁরা নিজ নিজ দেশের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন সে কথা তাদের বলতে হবে।
(চ) রোহিঙ্গাদের মেধাবিকাশ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি: রোহিঙ্গাদের মধ্যে হাজার হাজার মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। তাই তাদের উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে তাদের মেধার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ দিতে হবে এবং তাদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিভা ও নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবেÑ যাতে তারা ভবিষ্যতে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার আদায় করতে সক্ষম হয়।
(ছ) মিশনারি এনজিওদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুরাতন রোহিঙ্গা হাফিজে কুরআনের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কিছু কিছু মিশনারি এনজিও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের অশুভ তৎপরতা চালাচ্ছে। বিশেষ করে ঈসায়ী জামাত নামক একটি মিশনারি সংস্থা স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে প্রায় ষাটটি পরিবারকে ধর্মান্তকরণের প্রতি প্রলুব্ধ করেছে এবং এ ব্যাপারে গোপন তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। তাই এ ব্যাপারে সরকারকে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
(জ) কারিগরি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা: বেকারত্বই সমাজে সর্বপ্রকার অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। কর্মক্ষম মানুষের জন্য বেকারত্ব একটি অভিশাপ। রোহিঙ্গাদের এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। তাদের মধ্যে হাজার হাজার কর্মক্ষম যুবক-যুবতী ও নারী-পুরুষ রয়েছে। তাদের বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের জীবনমান উন্নত করতে পারে। আর বর্তমানে তাদের জন্য সীমিত পরিসরে হলেও কিছু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
(ঝ) দেশাত্ববোধ জাগ্রতকরণ: নির্যাতিত ও নিপীড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশকে নিজের জন্য নিরাপদ আশ্রয় মনে করছে। ফলে তারা আর মিয়ানমার না যাওয়ার মনোভাব পোষণ করছে। বিভিন্ন শ্রেণির শরণার্থীদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য উঠে এসেছে। তাই তাদের মন থেকে সর্বপ্রকার ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক দূর করতে হবে এবং দেশাত্ববোধের প্রেরণা ও বীজ বপন করতে হবে।
৪. উলামায়ে কেরামের করণীয়: রোহিঙ্গাদের সহায়তায় দেশি-বিদেশি সংস্থা এবং সরকারের পর বেসরকারি ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে সর্বাধিক এগিয়ে রয়েছেন আলেম সমাজ, ইমাম সাহেবান ও বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ। জুলুম-নির্যাতন ও ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ ছাড়াও এর পেছনে হিজরত ও নুসরতের মহান বিষয়টি জড়িত। তাই তাঁরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার পাশাপাশি সমাজের দানশীল ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণ করে শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আলেম সমাজ রোহিঙ্গাদের সার্বিকভাবে ত্রাণ ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। খাদ্য এবং নগদ অর্থ ছাড়াও বাসস্থান, স্যানিটেশন, মসজিদ ও মক্তব প্রতিষ্ঠা এবং টিউবওয়েল স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া আরো কিছু প্রস্তাব হলো এই-
১. একটি ঐক্যবদ্ধ বা সমন্বিত উদ্যোগ অথবা দেশি-বিদেশি কোনো ইসলামী এনজিওর মাধ্যমে মসজিদের ইমাম ও মক্তবের শিক্ষকের বেতনভাতার ব্যবস্থা করা।
২. রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেক আলিম-উলামা, মুফতি-মুহাদ্দিস এবং শিক্ষক রয়েছেন। তেমনি মক্তব থেকে নিয়ে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত শিক্ষারত শতশত ছাত্র-ছাত্রী আছেন। তাই সরকারের অনুমতি নিয়ে স্থানভেদে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত ৪/৫টি পুরুষ ও মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা- যাতে ছাত্র ছাত্রীদের দ্বীনী শিক্ষার পথ উন্মুক্ত হয় এবং রোহিঙ্গা উলামায়ে কেরামও দ্বীনী খেদমত করার সুযোগ পান। এসব মাদরাসাগুলোর আসবাবপত্র, বেতনভাতা ও সার্বিক পরিচালনার ব্যবস্থা করা।
৩. মসজিদ, মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি স্থানে স্থানে প্রাইমারি লেভেলের ইসলামি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা, যেগুলোতে ইসলামি ও আধুনিক কারিকুলামের সমন্বয় থাকবে। অন্যদিকে ইউনিসেফ বা এনজিও পরিচালিত স্কুলগুলোতে ইসলামবিরোধী কোনো শিক্ষা দেয়া হচ্ছে কি না- সেদিকে নজর রাখা।
লেখক: শিক্ষাসচিব, জামেয়া দারুল হুদা সিলেট ও আল-হুদা আইডিয়াল একাডেমি এবং গ্রন্থকার ও অনুবাদক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন