(৮ ডিসেম্বর প্রকাশিতের পর)
প্রতি মাসে অবশ্যই কয়েকটি রোজা রাখবে। নিজের নফসের হেফাজত করবে, তাকে গোলাম করে নেবে (বশীভূত করবে), তার গোলাম হওয়া যাবে না। সঠিক কাজে লোকদের অনুসরণ করবে, ভুল কাজে নয়। যদি কোনো ক্ষমতাবান প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী লোককে দেখ সে দ্বীনের ক্ষতি সাধন করতে পারে এমন কোনো কাজে লিপ্ত, তাহলে তাকে সতর্ক করে দেবে তার প্রভাব-প্রতিপত্তির বিন্দুমাত্র পরোয়া করবে না। আল্লাহ তোমার মদদগার, সাহায্যকারী। তিনি তাঁর দ্বীনের সাহায্যকারী, মদদগার। একবার যদি তুমি এ কাজ করে ফেলো, তাহলে এসব লোক তোমাকে ভয় করতে থাকবে এবং আর কেউ তোমার সামনে বেদআত-কুসংস্কারের কথা প্রকাশে সাহসী হবে না।
যদি ক্ষমতাসীন সুলতানকে দ্বীন বিরোধী কোনো কাজ করতে দেখ তবে তুমি তার অধীনস্থ চাকর হলে তাকে তার ভুল জানিয়ে দাও। নিশ্চয় সে তোমার চেয়ে অনেক শক্তিশালী; তাকে বলে দাও আমি আপনার একান্ত অনুগত এবং শুভাকাক্সক্ষী। কিন্তু আপনার এ কাজটি দ্বীনের পরিপন্থী। যদি তার দ্বারা পুনরায় সে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে, তাকে নিরিবিলিতে বুঝানোর চেষ্টা করো। গ্রহণ করলে ভালো কথা, না মানলে আল্লাহর কাছে দো’আ করো, যেন তুমি তার কাছ থেকে নিরাপদে থাকতে পারো। মৃত্যুকে স্মরণ করবে। নিজের ওস্তাদ গুরুজনদের জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকবে। নিজের কার্যাবলির মধ্যে কবর জিয়ারতকে অন্তর্ভুক্ত রাখবে। উচ্চাভিলাষীদের সাথে উঠাবসা করবে না। তবে হ্যাঁ, দ্বীনের দাওয়াত ও সঠিক পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে (তা করা যাবে)। তা না হলে তিরস্কার ও গালিগালাজ হতে বিরত থাকবে। আজান শুনা মাত্র মসজিদের দিকে ধাবিত হবে। কৃপণতা হতে বাঁচবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় পরিধান করবে। নিজের বসবাস ও চালচলনে ঐশ্বর্যের প্রকাশ করবে। অভাব-দারিদ্র্য নয়, চাই তুমি দরিদ্র-অভাবী হও না কেন, নিজের মধ্যে উচ্চ সাহস ধারণ করবে। পথচলার সময় ডানে বামে তাকাবো না।
এ ঐতিহাসিক হেদায়েত নামার শেষদিকে হজরত ইমাম আজম (রহ.) তার প্রিয়তম ইমাম কাজী আবু ইউসুফ (রহ.)কে উপদেশ প্রদান করেন এইভাবে: দুনিয়াকে অধম ও নিকৃষ্ট মনে করবে। দুপুর ও সন্ধ্যে বেলায় গোসল করবে না। শিক্ষার মজলিসে রাগান্বিত হবে না। বেপরোয়া ও বক্র আচরণ করবে না। লোকের কাছ থেকে কেচ্ছা-কাহিনী শুনাবে না। কারো কাছ থেকে কোনো কাজ নিতে হলে সাধারণ লোকদের চেয়ে তাকে কিছুটা অতিরিক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করবে। বেহুদা এবং অসৎ লোকদের সাথে কথাবার্তা বলবে না। কোনো লোকের গোপন কথা অপরের কাছে প্রকাশ করবে না।
রাজপ্রাসাদের আশপাশে নিজের বাড়িঘর বানাবে না। কোনো বিষয়ে কেউ যদি তোমার কাছে পরামর্শ চায়, তাহলে সম্ভব হলে উত্তম পরামর্শ দেবে। লোভ-লালসা হতে আত্মরক্ষা করবে, দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হবে না। মিথ্যা কথা বলবে না। লোভ দেখাবে না। সর্বস্তরে লোকদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করবে না। তুমি যদি নিজের সাহসকে দুর্বল মনে করো, নিজেও উচ্চ সাহসী হতে পারবে না। দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে করবে।
রাজা-বাদশাহদের জুলুম-নির্যাতনের সময় তুমি সেখানে উপস্থিত থাকবে না, তবে উপস্থিত থাকলে, তুমি যদি কোনো কথা বলো কিংবা সঠিক পরামর্শ প্রদান করো, তা মেনে নেয়া হবে বলে মনে করবে। যদি রাজা-বাদশাহদের জুলুম-নির্যাতন তুমি নীরবে দর্শন করতে থাকো এবং তুমি দেখেছো, অথচ বাধা প্রদান করোনি তাহলে তোমার এ আচরণের ফলে লোকেরা মনে করবে যে, কাজটি ন্যায়ভিত্তিক হয়েছে।
আমাকে তোমার নেক দো’আর মাধ্যমে স্মরণ করবে, আমার এ উপদেশ গ্রহণ করবে। আমার এ উপদেশ নামা তোমার এবং সমগ্র মুসলিম উম্মার কল্যাণের জন্য নিবেদিত।
হজরত ইমাম কাজী আবু ইউসুফ (রহ.) স্বীয় ওস্তাদের এ চিরন্তন উপদেশনামায় বর্ণিত সকল বিষয় নিজের বাস্তব জীবনে প্রতিফলনে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি সা¤্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিচার বিভাগের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় এ হেদায়েত নামার অনুসরণ করেন। বিশেষভাবে তিনি আব্বাসীয় খলিফা আমিরুল মোমেনীন হারুনুর রশীদের আস্থাভাজন ভক্ত হওয়ায় রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক সময় প্রত্যক্ষভাবে খলিফাকে অনুরূপ বহু উপদেশ প্রদান করে সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। খলিফা আমিরুল মোমেনীন হারুনুর রশীদের আমলে প্রধান বিচারপতি ইমাম কাজী আবু ইউসুফের (রহ.) এর ওস্তাদ হজরত ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন প্রসদ্ধি মাজহাব চতুষ্টয়ের অন্যতম হানাফী মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা, যার অনুসারী দুনিয়ার অধিকাংশ মুসলমান, তার যুগ হিজরী ৮০-৬৯ খ্রিস্টাব্দ ১৫০ হিজরী- ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দ। তার প্রকৃত নাম নোমান ইবনে সাবেত ইবনে যাওতী, আবু হানিফা তার কুনিয়াত বা উপনাম এবং এ নামেই তিনি সুপরিচিত। তিনি ছিলেন একজন তাবেঈ। কয়েকজন সাহাবীর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছিলেন। একজন বিজ্ঞ আলেম ফকীহ মোজতাহেদ মুফতী এবং ইমামুল মুসলিম হিসেবে সুপরিচিত।
ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের শাসনামলে কুফার হিজরী ৮০ সালের মোতাবেক ৬৯৯ সালের ৪ আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেন। এবং আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুরের শাসনামলে হিজরী ১৫০ সালে মোতাবেক ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২ আগস্ট কারাবন্দি অবস্থার বাগদাদে ইনতেকাল করেন। বাগদাদের ‘খায়যুবান’ নামক কবরস্থানের পাশে মসজিদ সংলগ্নে তার মাজার অবস্থিত। তার নাম অনুসারে অঞ্চলটির নাম ‘আজমিয়া’ নামে খ্যাত।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর ওস্তাদগণের তালিকায় সাতজন সাহাবী ও তিরানব্বইজন তাবেঈর নাম রয়েছে। হাদীসসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রয়েছে। কুফায় উমাইয়া শাসনকর্তা ইয়াজীদ ইবনে উমর ইবনে হোবায়রা ইমাম সাহেবকে কাজীর পদ গ্রহণের প্রস্তাদ দিলে তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তীকালে আব্বাসীয় খলিফা মনসুর তাকে কাজীর পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেন, কিন্তু তিনি তা গ্রহণে রাজি না হলে খলিফা রাগান্বিত হয়ে তাকে কারাবন্দি করেন এবং কারাগারেই তিনি ইনতেকাল করেন। কাজির পদ গ্রহণের প্রস্তাবে ইমাম সাহেব বলেছিলেন যে, তিনি এ পদের জন্য অযোগ্য। তখন মনসুর বলেছিলেন, আপনি মিথ্যা বলছেন। জবাবে ইমাম সাহেব বলেন, তাহলে মিথ্যাবাদীকে তো বিচারকের ন্যায় এরূপ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা যায় না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাগদাদ শহরের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ইমাম আবু হানিফা (রহ.)কে খলিফা মনসুর কারাগারে নিক্ষেপ করেন।
ইমাম কাজী আবু ইউসুফ (রহ.): নাম- ইয়াকুব, কুনিয়াত- আবু ইউসুফ। জন্ম: ১১৩ হিজরী, ওফাত- ১৮২ হিজরী। তিনি কুফায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র। হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর নিকট শিক্ষা লাভ করতে যেতেন। এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়ে থাকে যে, একদিন তার পিতা তাকে বললেন, তুমি ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর নিকট গমন করো না, তিনি অত্যন্ত মালদার ব্যক্তি, তুমি এক দরিদ্র পিতার সন্তান। আবু ইউসুফ পিতার নির্দেশ পালন করেন এবং ইমাম আবু হানিফার (রহ.) নিকট আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেন। খোদ আবু ইউসুফ বলেন, আবু হানিফা (রহ.) আমাকে ডেকে পাঠান এবং তখন পরিস্থিতির কারণ জানতে চান। আমি পিতার নির্দেশ ও ঘরের অভাব এবং আর্থিক দুর্যোগের কথা খুলে বললাম। আবু হানিফা (রহ.) আমাকে বিদায় কালে একশ দেরহাম ভর্তি একটি থলি প্রদান করেন এবং বলেন, শিক্ষার জন্য আসতে থাকবে এবং আরো বলেন, যখন এটি শেষ হয়ে যাবে তখন আরেকটি থলে (ব্যাগ) নিয়ে যাবে। কিছুদিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর তিনি খোদ আমাকে একশ দেরহাম করে প্রদান করতে থাকেন, চাওয়ার সুযোগই হতো না।
তিনি ছিলেন ইমাম আজমের বিশিষ্ট শাগরিদগণের মধ্যে সেরা। তিনিই সর্বপ্রথম উসূলে ফেকা প্রণয়ন করেন। এ সম্বন্ধে হেলাল ইবনে ইয়াহহিয়া বলেন, কাজী আবু ইউসুফ (মাগাজী ও আরবের ইতিহাস ব্যতীত) হানাফী মাজহাবের হাফেজ ছিলেন এবং ফেকা তো তার গৃহের বাতি ছিল। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইয়াহহিয়া ইবনে মুঈন ছিলেন তার শাগরিদ। তার এবাদত বন্দেগী ও সাধুতার অবস্থা ছিল এই যে, বিচারপতি হিসেবে নিয়োজিত থাকার যুগেও তিনি দৈনিক দুইশ রাকাত নামাজ পড়তেন। আল্লামা ইবনে আবদুল্লাহ এবং ইবনে খাল্লেকান লিখেছেন, তার যুগে তিনি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যাকে প্রধান বিচারপতির উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
কাজী আবু ইউসুফের অমর বাণী গুলোর কয়েকটি হচ্ছে: যে বেপরোয়া লাগামহীনভাবে হাদীস সংকলনের ধান্ধায় পড়েছে, সে মিথ্যার শিকার হয়েছে। যে কিমিয়া বা রসায়নের মাধ্যমে অর্থের সন্ধান করেছে সে দরিদ্র হয়েছে এবং যে কালাম শাস্ত্র তথা যুক্তি বিদ্যার দ্বারা দ্বীনের আকীদা বিশ্বাসগুলো শেখার চেষ্টা করেছে, সে জিন্দিক অর্থাৎ নাস্তিক হয়েছে। সামান্যতম জ্ঞানও তোমরা লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা নিজেদের সর্বাত্মকভাবে তার কাছে সমর্পণ করবে।
কাজী আবু ইউসুফের প্রসিদ্ধ রচনাবলীর মধ্যে কিতাবুল (খরাজ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটি রচনা করেন আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশীদের পরামর্শ অনুযায়ী। এতে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের বহু হাদীস ও সন্নিবেশিত হয়েছে।
(সমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন