শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসম্মেলন প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

ড. মাওলানা এ কে এম মাহবুবুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

(গতকাল প্রকাশিতের পর)
২৭ জানুয়ারি, ২০১৮ এর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জমিয়তের মহাসম্মেলন কী উপহার দিয়েছে
১. এ দেশের হাজার হাজার পীর-মাশায়েখ, লক্ষ লক্ষ আলেম-ওলামা, খতীব, ইমাম, হাফেজ, ক্বারী, ইসলামী চিন্তাবিদ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকীহ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠি জমিয়তের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ। এ ঐক্য যে শীশা ঢালা প্রাচীরের মতো তার প্রমাণ এ মহাসম্মেলন।
২. জমিয়তকে উপেক্ষা করে কোন সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার চিন্তা করা অসম্ভব এ বাস্তবতা জাতিকে জানান দিয়েছে।
৩. মাদরাসা শিক্ষা বিদ্বেষী, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নামের কলঙ্ক, অর্থনীতিবিদ নামের মাদরাসার দোষ খোঁজার অবার্চীন কীটদের জন্য এ সম্মেলন যে এক হুঁশিয়ারী ও সতর্কবাণী তাতে সন্দেহ নেই।
৪. জমিয়তকে ভাগ করে ফায়দা লুটার অশুভ স্বপ্ন কোন দিন বাস্তবায়িত হয়নি এবং ভবিষ্যতেও যে হবে না তা কুচক্রীদের জানান দিয়েছে এ সম্মেলন।
৫. ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে, আউলিয়ায়ে কেরামের এই দেশে বিজাতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি এ দেশের আলেম, শিক্ষক ও মুসলিম জনগোষ্ঠির রয়েছে তার বার্তা সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে এ সম্মেলন।
৬. জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জমিয়তের নেতৃত্বে আলেম সমাজ অতীতে যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে ভবিষ্যতেও কাউকে ইসলামের নামে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গীবাদী সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলতে দেয় হবে না এ হুঁশিয়ারী দেয়া হয়েছে এ সম্মেলনে।
৭. জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাসচিবসহ শিক্ষা পরিবার মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে যে অবদান রেখেছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সরকার ও আলেম ওলামাদের মাঝে এক সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছে এ মহাসম্মেলন।
৮. মাদকের সয়লাব, দুর্নীতিতে জর্জরিত বাংলাদেশকে মাদক ও দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে এ দেশের আলেম-ওলামাদের সার্বিক সহযোগিতা ও প্রত্যয়ের ঘোষণা দেয়া হয়েছে এ সম্মেলনে।
৯. মাদরাসা শিক্ষা যে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জমিয়ত সভাপতির ঘোষণা মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের এ সকল বিষয়ে আরো অধিক ভ‚মিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করেছে এ সম্মেলন।
১০. জমিয়ত সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীন, ফুলতলী দরবারের কণ্ঠস্বর আল ইসলাহ সভাপতি মাওলানা হুসাম উদ্দীন চৌধুরী ও চরমোনাই দরবারের প্রতিনিধি সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ মাদানীসহ অনেকের বক্তব্য জমিয়তের সমর্থন ব্যতীত এদেশের মাটিতে সরকার গঠন সম্ভব নয় এ বাস্তবতার জানান দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন সমগ্র বিশ্বে এক অনন্য সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে আড়াই লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী, সত্তর লক্ষ শিক্ষার্থী এবং কয়েক কোটি অভিভাবকের আন্তরিক সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে দীনি শিক্ষার তথা মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন, শিক্ষক-কর্মচারীগণের উন্নয়ন, দীনি ভাবধারার উন্নয়ন সাধনে, নীতিবান দেশপ্রেমিক নাগরিক উপহার দানে বিপ্লবী ভ‚মিকা পালন করে আসছে। দাবি আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক, স্থিতিশীল পরিবেশ ঠিক রেখে জমিয়ত অতীতেও আন্দোলন করেছে। সরকার যেন লক্ষ লক্ষ পীর-মাশায়েখ, আলেম-ওলামা, শিক্ষক-কর্মচারীদের রাজপথে নামতে বাধ্য না করেন এ বার্তা সরকারের প্রতি বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে।
এ মহা সম্মেলনের প্রত্যাশা
১. এ সম্মেলন শুধুমাত্র ২ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারীদের সম্মেলন নয়, এর সাথে রয়েছে দেশের প্রতিষ্ঠিত শর্ষিনা, ফুলতলী, নেছারাবাদ, ফরাজীকান্দি, সোনাকান্দা, আঞ্জুমানে রহমানিয়া, তৈয়ব শাহ রহ., তাহের শাহ দরবার, মাইজভান্ডারী, আড়াইবাড়ী, দারুল আমান, ফান্দাউক, চান্দ্রা, চরমোনাই দরবার সহ হাজার হাজার পীর-মাশায়েখ দেশের ১৬ হাজার মাদরাসার প্রায় তিন লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী, ৮০ লক্ষ ছাত্র/ছাত্রী, কোটি কোটি অভিভাবক ও দীনদার মুসলমান। এ সম্মেলন মুখপত্র হিসেবে যৌক্তিক দাবি উপস্থাপন করেছে। ইবতেদায়ীসহ এমপিওভুক্ত ও নন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ করতে হবে। সরকার শতকরা ১০০ ভাগ বেতন দিচ্ছে, হাউজগ্রান্ট, চিকিৎসা ভাতা দিচ্ছে, ইনক্রিমেন্ট, উৎসবভাতা সরকারি চাকরিজীবিরা পেলেও বেসরকারি চাকরিজীবিরা পাচ্ছেন না। ঈদ বোনাসও আংশিক দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের স্বপদে বহাল থেকে চাকরির স্বীকৃতি ও মর্যাদা দান করলে অতি অল্প খরচেই সরকার শিক্ষক-কর্মচারীদের মন কেড়ে নিতে পারবে। তাই জমিয়ত আগামী ১৪ মার্চ, বুধবারের মধ্যে এ যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
জমিয়ত মনে করে শত বছরের দাবি ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা, বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, বিনামূল্যে বই বিতরণের মতো পদক্ষেপ যে প্রধানমন্ত্রী উদারতার সাথে নিতে পেরেছেন, পদ্মা সেতুর মতো অসাধ্য সাধন করেছেন সে শিক্ষা বান্ধব প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এ দাবি মেনে নিবেন। শিক্ষকগণও অতীতের মতো ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখবে। ১৪ মার্চ গোটা জাতি শুকরিয়া দিবস পালন করবে। লক্ষ লক্ষ শিক্ষক কর্মচারীদের আন্দোলনে যেতে হবে না, এটাই মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রত্যাশা।
২. ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণ ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি : মাধ্যমিক স্কুলের ফিডার ক্লাশ হিসেবে ১২৬৬১৫টি প্রাইমারি স্কুল, হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন ও মিশনারী স্কুল রয়েছে। ৯৩১৫টি দাখিল মাদরাসার জন্য মাত্র ১২৫৯৮টি সংযুক্ত ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা চালু আছে। ২২ হাজার ইবতেদায়ী মাদরাসা মঞ্জুরীপ্রাপ্ত হলেও এমপিওভুক্ত না হওয়ায় বর্তমানে মাত্র ৩৬১৮টি সরকারি তালিকাভুক্ত রয়েছে। বাকী সবগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যার ফলে মাদরাসায় শিক্ষার্থী সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। তা ছাড়া স্কুলে উপবৃত্তি ও টিফিনের ব্যবস্থা থাকলেও মাদরাসায় এ ব্যবস্থা না থাকায় পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে না। বিগত ২০/৪/২০১১ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকদের বেতনভাতা প্রদানের আশ্বাস প্রদান করেন। দীর্ঘ ৭ বছরেও এর সুরাহা হয়নি। আরও দুঃখজনক বিষয় হলো বিগত ১৭/১১/২০০৮ থেকে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী স্থগিত রাখা হয়। দীর্ঘ ৭ বছর একটি ইবতেদায়ী মাদরাসাও মঞ্জুরী পায়নি। যার ফলে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চরম ছাত্র সংকটের সম্মুখীন, তাই মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অর্জনকে রক্ষা করতে হলে ইবতেদায়ী মাদরাসাসমূহকে জাতীয়করণ করতে হবে এবং নতুন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার বন্ধ দরজা খুলে দিতে হবে।
৩. শিক্ষক-কর্মচারীদের বয়সসীমা ৬৫ বছর করা: শিক্ষাঙ্গনে অভিজ্ঞ জনবলের অভাব অত্যন্ত প্রকট। মানসম্মত প্রশাসন ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে অভিজ্ঞ লোকদের বয়সসীমা বৃদ্ধি করে ৬৫ বছর করা যুক্তিযুক্ত।
৪. জমিয়ত পেশকৃত জনবল কাঠামো দ্রুত বাস্তবায়ন: মাদরাসায় ইবতেদায়ী, দাখিল, আলিম, ফাযিল, ফাযিল অনার্স, কামিল ও মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। ইবতেদায়ী পর্যায়ে ৫টি শ্রেণি হলেও শিক্ষক রয়েছে মাত্র ৪ জন। দাখিল পর্যায়ে নতুন কারিকুলামে ইংরেজি ১৫০, বাংলা ১৫০ করা হয়েছে। এ পর্যায়ে ইংরেজি, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, হাদিস, কুরআন, আকাঈদ ও ফিকহ, বিজ্ঞান, শরীর চর্চা, ক্যারিয়ারসহ ১৭০০ নম্বর পড়ানোর জন্য মাত্র ৬ জন শিক্ষক রয়েছেন। আলিম পর্যায়ে শিক্ষক সংকট বিরাজমান, ফাযিল স্তরে ২১০০ নম্বরের জন্য রয়েছে মাত্র ১ জন আরবি প্রভাষক! কামিল পর্যায়ে প্রতি বিষয়ে ১১০০ নম্বর পরীক্ষা দিতে হয়, এ পর্যায়ে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ২ জন। ফাযিল অনার্স পর্যায়ে ৩২০০ নম্বরের জন্য কোন শিক্ষক নেই। তাই জমিয়ত ন্যূনতম যা দরকার তার প্রস্তাব দিয়ে জনবল কাঠামোর রূপরেখা মাদরাসা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। নানা অজুহাতে তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ফাযিল, ফাযিল অনার্স ও কামিল শ্রেণির পাঠদান মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। তাই অতিদ্রুত জনবল কাঠামো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। স্কুলের কামিল পাশ যে স্কেলে বেতন পাচ্ছেন, মাদরাসার কামিল পাশ সহকারী মৌলভী তা থেকে একধাপ নিম্নে বেতন পাচ্ছেন। প্রস্তাবিত জনবল কাঠামোতে সমতা বিধানের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে উচ্চতর শিক্ষাকে মানসম্মত পর্যায়ে উন্নীত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আশা করছি। এ ক্ষেত্রে কলেজের মতো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দান করে সমস্যার সমাধান করা সময়ের দাবি।
আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদরাসা শিক্ষার প্রতি পূর্বের ন্যায় আন্তরিকতা দেখিয়ে বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে আদর্শ, সুনাগরিক গড়ার মাদরাসা অঙ্গণকে তার কাঙ্খিত মানে উন্নীত করবেন। আর লক্ষ লক্ষ পীর-মাশায়েখ ও আলেম-উলামার দোয়া পেয়ে নিজেকে ধন্য করবেন। এটাই গোটা জাতির প্রত্যাশা।
লেখক: যুগ্ম-মহাসচিব, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন