১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহি মহা বিদ্রোহের ¯েøাগান ছিল ইনকিলাব-জিন্দাবাদ। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে মহাবিপ্লবের সূচনা করল ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকা। এই পত্রিকা প্রকাশিত হলো আলহাজ মাওলানা এম এ মান্নানের দ্বারা। মাওলানা মান্নান বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে। বর্তমান চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার অধুনা ইসলামপুর গ্রামের এক ফরিদগঞ্জ উপজেলার অধুনা ইসলামপুরের বিখ্যাত পীর পরিবারে। তাঁর আব্বাজান সুফী ইয়াসিন ছিলেন ফুরফুরা শরীফের পীরে কামেল মুজাদ্দেদে জামান হযরত মাওলানা আমিরুশ শরিফত কুদওয়াতুস সালেকীন জোবদাতুল আরেফিন। আলহাজ আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহ আলাইহির খলিফা। বর্তমান লেখকের আব্বা হুজুর কেবলা হযরত মাওলানা কুতবুল আলম শাহ সুফী তোয়াজ উদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহও ছিলেন ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দেদে জামানের অন্যতম প্রধান খলিফা। সেই সুবাদে তাঁর সাথে বর্তমান লেখকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এক সময় মাওলানা মান্নান ঢাকার বংশাল রোডে একটি বাসায় জায়গীর থাকতেন। বর্তমান লেখকের আব্বা হুজুর কেবলার এক খাস মুরিদ সুফী আলহাজ মঈনুদ্দিন সাহেবের বাসা ছিল ওটা। সেই বাসায় আমার আব্বা হুজুর কেবলা মাঝে মধ্যে উঠলে মাওলানা মান্নান আমার আব্বা হুজুর কেবলার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন।
মাওলানা মান্নান মুজাদ্দেদে জামানের অন্যতম খলিফা শর্ষিনার পীর মাওলানা নেছার উদ্দিন আহমদের মহব্বত লাভ করেন এবং শর্ষিনা মাদ্রাসার উন্নয়নে প্রভূত অবদান রাখেন। মাওলানা মান্নান সত্যিকার অর্থে একজন কর্মবীর ছিলেন। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি আইয়ুব খানকে শর্ষিনার ইসালে সওয়াব মহফিলে দাওয়াত করে নিয়ে যান। আইয়ুব খান শর্ষিনা মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য বিরাট অংকের অনুদান বরাদ্দ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, শর্ষিনা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠায় ফুরফুরার মুজাদ্দেদে জামানের নির্দেশনা কাজ করে। শর্ষিনার পীর মাওলানা নেছার উদ্দিন ফুরফুরা শরীফে গিয়ে মুজাদ্দেদে জামানের দোয়া নিয়ে এ মাদ্রাসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। এটা সর্বজনবিদিত যে, বাংলা ভাষায় পত্রিকা প্রকাশনায় পৃষ্ঠপোষকতায় মুজাদ্দেদে জামানের প্রভ‚ত অবদান ছিল। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ‘দৈনিক সুলতান’সহ প্রায় অর্ধ শতাধিক পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সেকালে এ দেশের মুসলমানের মুখপত্র হিসেবে ‘দৈনিক আজাদ’ অত্যন্ত জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল। মাওলানা মান্নান তার আব্বা হুজুরের পীর সাহেব কেবলার আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি দেশকে ভালোবাসতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ঈমান’ অর্থাৎ দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। সেই বিশ্বাসে তিনি একটি আধুনিক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ জন্য তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের অফিসের পাশে একখÐ জমি কয়েক গুণ দাম বেশি দিয়ে খরিদ করেন। পত্রিকার নাম দেন ‘দৈনিক ইনকিলাব’। এই পত্রিকা প্রকাশের প্রারম্ভে তিনি দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং বিভিন্ন স্তরের গুণীজনের সমাবেশ ঘটান সোনারগাঁও হোটেলে এবং পত্রিকার বিভিন্ন বিভাগের জন্য সম্পাদক বাছাই করেন। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল গফুরকে ফিচার এডিটর হিসেবে বাছাই করেন। ১৯৮৬ সালের ৪ জুন ‘দৈনিক ইনকিলাব’ বের হলে বাংলাদেশে রীতিমতো সাড়া পড়ে যায়। মুসলিম মননশীলতা ও ইসলামী মূল্যবোধে সমৃদ্ধ ‘দৈনিক ইনকিলাব’ রাতারাতি লক্ষাধিক গ্রাহকে সমৃদ্ধ হয়। এই পত্রিকায় নতুন নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়, যেমনÑ নামাজের সময়। অন্যান্য পত্রিকাও দৈনিক ইনকিলাবের অনুকরণ করে। এর ফিচার পাতাগুলো পাঠক-পাঠিকা মহলকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। এর ধর্ম ও দর্শন পাতা ফোরামের তফসির কলাম, সাহিত্য পাতা, আদিগন্ত পাতা, আওলিয়াদের জীবনী কলামসহ অন্যান্য ফিচার পাতা। এর ফিচার এডিটর ভাষাসৈনিক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল গফুরের পরশে মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে। মাওলানা আব্দুল মান্নান শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন অবদান রেখেছেন তেমনি জনকল্যাণমূলক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। গাউসুল আজম কমপ্লেক্স, কুষ্টিয়া-যশোর সীমান্তে অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সেসবের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি জেনারেল এরশাদের আমলে ধর্মমন্ত্রী ছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে ১৯৮৬ সালের মহা বন্যার সময় মানুষের দোরগোড়ায় রিলিফ সামগ্রী দ্রæত পৌঁছানোর জন্য ৮টি হেলিকপ্টার ইরাকের তদানীস্তন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছ থেকে আনা হয়।
মাওলানা আব্দুল মান্নানের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মাওলানা আব্দুস সালামের সঙ্গে বর্তমান লেখকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনিও একটা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন এবং সিলসিলা-এ ফুরফুরা শরীফের একনিষ্ঠ খাদেম ছিলেন। মাওলানা আবদুল মান্নান ইলমে তাসাউফের শ্রেষ্ঠ তরিকা তরিকায়ে কাদেরীয়া এর একনিষ্ঠ অনুশীলনকারী ছিলেন। তাঁর মতো আশেকে রাসূল মেলা ভার। তিনি লেখকও ছিলেন। তাঁর মলফুজাত সত্যের সন্ধানে একটি হৃদয়প্রাহী গ্রন্থ। এই গ্রন্থের অনুলেখক ছিলেন মাওলানা ফারুক। মূলত গ্রন্থখানি বিভিন্ন সময় প্রদত্ত খুৎবার সংকলন তাসাউফপন্থীদের জন্য এটা খুবই উপকারী গ্রন্থ। পাকিস্তান আমলে যে ৩ জন হক্কানী আলেম ছিলেন তার অন্যতম হচ্ছেন মাওলানা এম এ মান্নান। অন্য দুইজন হচ্ছেন হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম এবং অন্যজন হচ্ছেন ফরিদপুরের মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ:)। এ তিনজনের সঙ্গেই বর্তমান লেখকের ঘনিষ্ঠতা ছিল নিবিড়। আলহাজ মাওলানা এম এ মান্নান ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রæয়ারি ইন্তেকাল করেন। তাঁর নির্মিত গাউসুল আজম কমপ্লেক্সে অবস্থিত তাঁর মাজার শরীফ জেয়ারতে বহু ভক্তজনের সমাবেশ ঘটে। তিনি মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রাণের সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি মূলত মাদ্রাসা শিক্ষকদের নয়নমণি ছিলেন।
লেখক : মুফাস্সিরে কুরআন, পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন