শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ইসলামবিদ্বেষী সংঘাত ও রাজনৈতিক সমঝোতার পথ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৭ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তির স্বার্থের দ্ব›দ্ব এখন মুসলমানদেরকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন বোমা হামলার পর থেকেই নিওকন শাসিত রাজনীতির মোড়লরা যে ক্রুসেড শুরু করেছিল তা’ এখন চরম আকার ধারণ করেছে। ফিলিস্তিনের উপর পুরনো দখলদারিত্বের ক্ষতের উপর ইরাক,আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনে লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যার বিনিময়ে পশ্চিমারা বিশ্বকে আরো নিরাপদ ও শান্তিময় করে তোলার ঘোষণা দিয়েছিল। নাইন-ইলেভেনের পর তথাকথিত সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ শুরুর দেড়দশকের বেশী সময় পর বিশ্বকে আরো অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হলেও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা হারানো পশ্চিমা পুঁজিবাদ যেন যুদ্ধের অর্থনীতির উপর ভর করেই টিকে থাকার শেষ চেষ্টা করছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশেরই প্রতিবেশীর উপর খবরদারি, আগ্রাসন ও সামরিক উচ্চাভিলাস না থাকলেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে একদিকে তেলের মূল্য কমতে শুরু করে এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ নির্ভর দেশগুলোর আয়ের খাত সঙ্কুচিত হতে থাকে, অন্যদিকে এসব দেশের সামরিক বাজেট হু হু করে বেড়ে যেতে শুরু করে। অর্থাৎ অর্ধশত বছরের বেশী সময়ে তেল বিক্রি থেকে সঞ্চিত শত শত বিলিয়ন পেট্টোডলারের মজুদ পশ্চিমাদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। রহস্যমায় সন্ত্রাসী হামলা এবং তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, পশ্চিমাদের সাজানো আরব বসন্ত, সিয়া-সুন্নী বিরোধ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে এ লক্ষ্যে কাজে লাগানো হচ্ছে। তালেবান, আলকায়েদা, আইএসসহ মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসী গ্রæপগুলোর মদদদাতা হিসেবে পশ্চিমাদের ভ’মিকা এখন আর ঢেকে রাখা যাচ্ছেনা। নানাভাবে এসব বিষয়ের তথ্যউপাত্ত ও ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জি এখন প্রায়শ গণমাধ্যমে উঠে আসছে। ওরা আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের ইতি ঘটিয়ে সেখানে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শাসন কায়েমের প্রতিশ্রæতি দিয়ে সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার টন বোমা ফেলে ইতিহাসের নির্মমতম ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করেছে। ইরাকের জনগনকে সাদ্দাম হোসেনের একনায়কত্ব থেকে মুক্ত করে গণতন্ত্র, শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ইতিহাসের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার গঠিত হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে ইরানে। বিপুল জনসমর্থনে ও ব্যালটে নির্বাচিত সেই মোসাদ্দেক সরকারের পতন ঘটিয়ে সেখানে পুনরায় রেজাশাহ পাহলভির স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ইঙ্গ-মার্কিন গণতন্ত্রের লেবাসের উপর একটি ষড়যন্ত্রপূর্ণ কলঙ্কের ইতিহাস রচনা করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশের পথকে তারা বার বার রুদ্ধ করেছে। গত দশকের শেষদিকে মিশরের হাজার বছরের ইতিহাসের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাগ্রহণ করেছিল। র‌্যাডিকেল ইসলামি দল মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা মোহাম্মদ মুরসিকে ভোট দিয়েছিল মিশরীয়রা। কোন র‌্যাডিকেল ইসলামী জাতীয়তাবাদি দল জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে পশ্চিমাদের সাথে আপস করবেনা, আরেকটু খোলাসাভাবে বলতে চাইলে, তাদেরকে পশ্চিমা বশংবদ হিসেবে ব্যবহার করা অসম্ভব হওয়ার কারণেই মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে সেখানে হুসনি মোবারকের ধারাবাহিকতায় ফাত্তাহ আল সিসি’র মত সামরিক স্বৈরাচারী শাসকদেরকেই মদদ দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে পশ্চিমারা। একদিকে বশংবদ রাজাদের মসনদের নিরাপত্তা অন্যদিকে যে কোন স্বাধীনচেতা গণতান্ত্রিক শক্তির সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে নির্মূল করাই যেন মধ্যপ্রাচ্যে পর্শ্চিমাদের মূল রাজনৈতিক এজেন্ডা। শুধু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর আঘাত করা হয়নি, যে কোন স্বাধীনচেতা, দৃঢ় ও সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রশক্তিকে দাবিয়ে রাখার সব রকম ব্যবস্থাই মধ্যপ্রাচ্যে নির্মমভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। তালেবান, সাদ্দাম, গাদ্দাফি বিহীন আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়াকে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে এখন চরম বিশৃঙ্খল, ব্যর্থ ও অনিরাপদ রাষ্ট্রের তকমা পরতে হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সিরিয়ায় আসাদ এবং ইরানের রিজিম পরিবর্তনের লক্ষ্যে ইতিহাসের নৃসংশতম সামরিক আগ্রাসন চলছে।
¯œায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বে পশ্চিমা কর্পোরেট পুঁজিবাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দি হিসেবে চীনের উত্থান ঘটলেও স্যামুয়েল ফিলিপ হান্টিংটনের মত রাষ্ট্রদার্শনিকরা পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে কোন রাষ্ট্র নয় বরং বিশ্বব্যাপী ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতিকেই প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করেন। বলাবাহুল্য, ¯œায়ুযুদ্ধের সময়কার পশ্চিমা রাজনীতি ও অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশই আবর্তিত হত সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ থেকে সম্ভাব্য আক্রমন ও নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ঘিরে। প্রতিদ্ব›িদ্ব দুই পরাশক্তিই সম্প্রসারণবাদি নীতি গ্রহণ করায় তারা সব সময়ই বিশ্বের কোথাও না কোথাও মুখোমুখি অবস্থানে থাকতো। একদিকে আঞ্চলিক দ্বন্দ-সংঘাত অন্যদিকে পরস্পরের দিকে তাক করে রাখা আন্তমহাদেশীয় পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্রগুলো দুই বøকেই মানুষের ¯œায়ুর উপর বেশ জোরালো প্রভাব সৃষ্টি করতো বলেই তা’ একটি ¯œায়ুযুদ্ধ পরিস্থিতি হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্প, কৃষি ও সামরিক প্রযুক্তি উন্নয়ন ও উৎপাদনব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের হাজার হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ ছিল কয়েকটি ব্যাংকার ও কর্পোরেট শিল্প পরিবারের হাতে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর তাদের অস্ত্র ব্যবসার রমরমা বাজারে যে সমুহ মন্দা দেখা দেয়ার আশঙ্কা ছিল মুসলিম বিশ্বকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে হান্টিংটনের দেয়া সুত্র অস্ত্রব্যবসার বিকল্প বাজার সৃষ্টির অন্যতম কৌশল হিসেবে কাজ করেছে। ত্বাত্তি¡কভাবে ‘ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন’র ব্যাখা-বিশ্লেষণ যাই থাক, মুক্তবাজার অর্থনীতির বিপরীতে চীন-ভারতের মত নব্য অর্থনৈতিক শক্তির উত্থানের বিপরীতে পশ্চিমা ম্যানুফেকচারিং খাতে মন্দা কাটিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকা সচল রাখতে অস্ত্র ব্যবসায় ও যুদ্ধবাদি অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি সবচেয়ে সহজলভ্য বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়। লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে; ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ধর্মীয় সংস্কৃতির ভিত্তিতে বিশ্বসভ্যতাকে আটটি প্রধানভাগে ভাগ করলেও এর মধ্যে ইসলামিক সিভিলাইজেশনে এমন কোন রাষ্ট্রশক্তি ছিলনা যা’ পশ্চিমা স্বার্থের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াতে পারে। পক্ষান্তরে সিনিক বা চৈনিক সভ্যতা ও অর্থনীতির অবস্থান যে কোন অর্থেই পশ্চিমা সভ্যতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যের কোন একক দেশই চীন, ভারত, ব্রাজিল বা জাপানের সমকক্ষ না হলেও ¯œায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থার পুর্নগঠনের লক্ষ্য নিয়ে পশ্চিমারা প্রথমে মুসলিম বিশ্বকেই তছনছ করে দেয়ার সামরিক নীলনকশা গ্রহণ করেছে। নব্বই সালে ইরাকের কুয়েত দখলের পেছনে মার্কিনীদের ইন্ধন ছিল বলে জানা যায়। কুয়েতকে মুক্ত করতে প্রথম গাল্ফ ওয়ারের সমরসজ্জা থেকে মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক যে সামরিক প্লেগ্রাউন্ড শুরু হয়েছে তার সর্বশেষ পরিণতি দেখা যাচ্ছে সিরিয়ায়। প্রায় ৭ বছর ধরে চলা সিরীয় যুদ্ধে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী ও আইএস’র বিরুদ্ধে রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনপুষ্ট বাশার আল আসাদের সরকার পতনের কাছাকাছি অবস্থা থেকে ঘুরে দাড়িয়ে যখন একটি শক্ত ভিত্তি লাভ করতে যাচ্ছে ঠিক তখনি পশ্চিমাদের মরণ কামড় পড়ছে সিরীয় জনগনের উপর। গত ৭ বছরে সিরিয়ায় ৫ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছে এবং প্রায় সবগুলো সমৃদ্ধ নগরী ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছে। ঠিক এই মুহূর্তে সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলেীয় শহর গৌতার নাগরিকরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন। ইতিপূর্বে বিভিন্ন স্থানে পরাজিত ও বিতাড়িত আইএস ও বিদ্রোহীরা গৌতায় আশ্রয় নিয়েছিল। তারা সেখানে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে নানা ধরনের সামরিক তৎপরতার পাশাপাশি সরকারী বাহিনীর উপর চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছিল। সিরীয় বাহিনী দেশের প্রতি ইঞ্চি ভ’মিকে বিদেশী আজ্ঞাবহ বিদ্রোহীমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে গৌতায় সামরিক অভিযান পরিচালনার শুরুতেই বিদ্রোহীরা গৌতার বেসামরিক জনগনকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। সিরিয়ার, সরকারী বাহিনী, বিদ্রোহী এবং পশ্চিমা জোটের ত্রিমুখী আক্রমনে গৌতার ৪ লক্ষাধিক মানুষ এখন ইতিহাসে নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ত্রিমুখী আক্রমন থেকে বাঁচতে ওরা এখন সুড়ঙ্গে অথবা ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকা পড়ে আছে। প্রায় প্রতিদিনই গৌতার কোথাও না কোথাও বোমা হামলার ঘটনা ঘটছে এবং এসব হামলায় মূলত বেসামরিক নাগরিক ও শিশুরা হতাহত হচ্ছে বেশী। ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে উদ্ধার হওয়া শিশুদের ছিন্নভিন্ন দেহাংশের ছবি প্রায় প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। আর এসব শিশুদের উপর নিমর্ম হত্যাকান্ডের দায় নিয়ে চলছে নির্লজ্জ বেøইম গেম।
গত ২রা মার্চে স্ট্রাটেজিক কালচার ফাউন্ডেশন নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে প্রকাশিত অনলাইন জার্নালের এক এডিটরিয়ালের শিরোনাম ছিল, ‘ইন সিরিয়া, দ্য রিয়াল সিজ ইজ বাই দ্য ওয়েস্টার্ন ক্রিমিনাল পাওয়ার্স’। ইতিপূর্বে রাকা, আলেপ্পো ও ইরাকের মসুলেও একই ধরনের মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরী করে পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়াগুলো সিরিয়ার রিজিমের বিরুদ্ধে একতরফা প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে। আগের সপ্তাহে স্ট্রাটেজিক কালচার ফাউন্ডেশনের জার্নালে বৃটিশ সাংবাদিক ফিনিয়ান কানিংহামের লেখা নিবন্ধে সিরিয়া যুদ্ধে পশ্চিমা সরকার, সামরিক মুখপাত্র, কর্পোরেট মিডিয়া এমনকি জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে মিথ্যা অপপ্রচারে সামিল হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। পূর্ব গৌতায় আটকে পড়া ও (তার ভাষায় নারকীয়) মানবিক বিপর্যয় নম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্বিঘœ হওয়া স্বাভাবিক। তবে কানিংহামের প্রশ্ন হচ্ছে, ফিলিস্তিনের গাজায় লাখ লাখ মানুষ বছরের পর বছর ধরে ইসরাইলী অবরোধের কারনে মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। সেখানে তার এবং পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়ার দৃষ্টি ও কণ্ঠ এতটা ক্ষীন কেন? মসুলে যখন মার্কিন বিমান হামলায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল অথবা ইয়েমেনের সানায় যখন সৌদি বিমান হামলায় একই ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তাদের কন্ঠ এতটা উচ্চকিত হয়নি। সিরিয়ায় সাতবছরের যুদ্ধের সূচনা এবং গৌতায় বর্তমান মানবিক বিপর্যয়ের দায় সম্পর্কে খোদ জাতিসংঘ মহাসচিবও পশ্চিমা মিডিয়ার অর্কেস্ট্রেড প্রোপাগান্ডার সাথে সুর মিলাচ্ছেন! মসুল, রাকা, আলেপ্পোতে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী ও আইএস সন্ত্রাসীদের পতনের মুহুর্তে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো মানবিক বিপর্যয়ের জন্য একযোগে সিরিয়ার সরকারী বাহিনীর দিকে বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে কোন অপচেষ্টা বাদ দেয়নি। গৌতায় বিদ্রোহী ও আইএসএর সবর্শেষ অবস্থান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মুহুর্তটিকে সিরিয়ার সাধারণ জনগণ ও সেনাবাহিনী যখন সেলিব্রেট করতে যাচ্ছে তখন সেখানে মানবিক বিপর্যয় রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বদলে বিপর্যয়ের দায় এককভাবে সিরীয় বাহিনীর উপর চাপিয়ে বেøইম গেম এবং আগ্রাসনের ভিন্নতর মাত্রার নতুন অজুহাত খাড়া করার চেষ্টা চলছে। আর সিরিয়ায় পশ্চিমা মদদপুষ্ট বাহিনীগুলোর পরাজয়ের প্রেক্ষাপটে সেখানকার মানবিক বিপর্যয়ের হাল চিত্রগুলোর অতি প্রচার এবং যে সংবেদনশীল ভাবাবেগের জন্ম হচ্ছে তা নিয়েও জনমনে এক ধরনের বিভ্রান্তির জন্ম নিচ্ছে। মিথ্যা নিয়েও মিথ্যা প্রচারনা হচ্ছে। একটি মিথ্যাকে আরেকটি মিথ্যা দিয়ে ঢেকে দেয়ার পশ্চিমা পন্থা শেষ পর্যন্ত হালে পানি না পেলেও প্রতিশ্রæত যুদ্ধবিরতি ভেঙ্গে নারকীয় মানবিক বিপর্যয়ের করাল গ্রাস থেকে রেহাই পাচ্ছেনা সিরিয়ার শিশুরা। তাদেরকে রক্ষা নয় তাদের মানবিক বিপর্যয় নিয়ে বেøইম গেম ও স্বার্থের রাজনীতি করাই পশ্চিমাদের এখনকার মূল লক্ষ্য। এর মূলে রয়েছে মুসলমানদের ভূমিতে পশ্চিমা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখার পথ পরিস্কার রাখা।
আলজেরীয় পন্ডিত, রাষ্ট্রদার্শনিক আমির নূরের একটি নিবন্ধ সম্প্রতি আইসিএইচ অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধের শিরোনাম- ‘ইসলাম অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট: হোয়াট ওয়েন্ট রং অ্যান্ড হোয়াই’। পাঁচ হাজারের অধিক শব্দে লিখিত নিবন্ধে ইসলামের সাথে পশ্চিমা দুনিয়ার দ্ব›েদ্বর যে ঐতিহাসিক রূপরেখা তুলে ধরেছেন তা’ ইতিহাস ও রাজনীতি সচেতন মানুষকে চলমান বিশ্বের সংকটের মূলসুত্র খুঁজতে যথেষ্ট সহায়তা করতে পারে। ইতিহাসের ফ্যাক্টসগুলোকে নিজের প্রজ্ঞা দিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমির নূর মার্কিন রাষ্ট্রচিন্তক নোয়াম চমস্কি, আর্নল্ড টয়েনবি, আলভিন টফলার, নোবেল বিজয়ী বৃটিশ রাজনীতিবিদ ইউনস্টন চার্চিল, এডওয়ার্ড সাঈদ, মালেক বেন্নাবিসহ আরো অনেকের মতামত থেকে উদ্ধৃত করে আলোচনা করেছেন। আরব ও মুসলিমবিশ্বের বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে সঠিকভাবে বুঝতে গত শতকের শুরুর দিকে উসমানীয় সা¤্রাজ্যের ভাঙ্গন এবং ভাগাভাগিতে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর ভ’মিকা বিশেষভাবে আলোচ্য। এ ক্ষেত্রে ১৯১৬ সালে বৃটিশ ও ফরাসীদের মধ্যে সমঝোতা হয় সাইক-পিকো এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে। ২০১৪ সালে ফরাসী ভাষায় প্রকাশিত আমির নূরের লেখা (খ’ঙৎরবহঃ বঃ ষ’ঙপপরফবহঃ ধ ষ’যবঁৎব ফ’ঁহ হড়াঁবধঁ “ঝুশবং-চরপড়ঃ”) এ ক্ষেত্রে একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে কাজ করবে। তবে সমাসাময়িক বিশ্বে মুসলমানদের বাস্তব অবস্থা (যাকে চলমান বিশ্বের চিন্তাশীল মুসলমানরা গেøাবাল ওয়ার এগেইন্সট ইসলাম) বুঝাতে তিনি একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেখানে ১৪০০ বছর আগে রাসূল মোহাম্মদ(সা.) বলেছেন, “এমন এক সময় আসবে যখন বিশ্বের বহুজাতি সবদিক থেকে তোমাদের(মুসলমানদের) বিরুদ্ধে অবস্থান নিবে, যেভাবে একদল ক্ষুর্ধাত মানুষ বড় ডেকচির উপর হামলে পড়ে। আমরা পুনরায় প্রশ্ন করি ইয়া রাসূলুল্লাহ তখন কি আমরা সংখ্যায় অল্প থাকব? তিনি উত্তর দিলেন না, তোমরা সংখ্যায় অনেক বেশীই থাকবে, তবে তোমাদের কোন ঐক্য থাকবেনা, তোমাদের অবস্থা হবে বাণের পানির সাথে ভেসে আসা খড়কুটোর মত যাদের আলাদা কোন ওজন থাকবেনা। অন্যদিকে তোমাদের শত্রæদের অন্তরে কোন ভয়ভীতি থাকবেনা, আর তোমাদের অন্তরে দুনিয়ার প্রতি আসক্তি এবং মৃত্যুভীতি জন্ম নেবে”। লেখক হাদীসের উৎস ও সঠিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন না তুলে হাদীসে উদ্ধৃত অবস্থার সাথে বর্তমান বিশ্ববাস্তবতার হুবহু মিল খুঁজে পেয়েছেন। হান্টিংটনের নাম উল্লেখ না করে ইসলামোফোবিয়া ও ক্লাশ অব সিভিলাইজেশনের ভয়াবহ দিকগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনার পাশাপাশি আমির নূরের বিকল্প প্রস্তাব হচ্ছে ‘ডায়ালগ অব সিভিলাইজেশন’। বিশ্বের প্রতিটি সমস্যার সমাধানে বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চিন্তাশীল মানুষদেরকে একটি সময়োপযোগী সমঝোতায় পৌছাতে হবে। ইসলামের সাথে বাকি দুনিয়ার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধান রাতারাতি হয়তো সম্ভব নয়। তবে দুই বা ততোধিক ভিন্নমতের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সহাবস্থান না থাকলে আমরা সভ্যতার দাবী করতে পারিনা। ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন থেকে শুরু করে আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইনে মুসলমানরা জাতিগত নিধনের শিকার হচ্ছে। এমনকি আমাদের দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতেও আবারো বিভেদ, সংঘাত ও অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে। এহেন বাস্তবতায় প্রধান রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে গঠনমূলক ডায়ালগ ও সমঝোতাই হচ্ছে আপাতত উত্তরণের একমাত্র পথ।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Amirul Islam ৭ মার্চ, ২০১৮, ৭:২১ এএম says : 0
Very right things in writing
Total Reply(0)
শওকত জামান ৭ মার্চ, ২০১৮, ১২:৫৮ পিএম says : 0
ধণ্যবাদ লেখককে
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন