(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাংলাদেশে মাদরাসা তথা ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং তাহজীব-তমদ্দুনের প্রচার-প্রসারে জময়িাতুল মোদার্রেছীন একটি অরাজনৈতিক ও একক প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন হিসেবে আট দশকেরও অধিক কাল একটানা যে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে তা নজিরবিহীন। পূর্বের ন্যায় নীরবে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অতিবাহিত হয়ে গেলেও এর ইতিহাস ঐতিহ্য কখনো ¤øান হয়ে যাওয়ার নয়। এদেশের মাদরাসায় শিক্ষিত আলেম, ওলামা ও মাশায়েখের নিকট জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ঐতিহাসিক অবদান সুপরিচিত। মুসলিম ঘরানাগুলোতে মাদরাসা পড়–য়াদের অভাব নেই। কারও পিতা, ভাই, ছেলে মাদরাসা শিক্ষার সাথে কোন না কোন প্রকারে জড়িত। কেউ শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত, কেউ শিক্ষা অর্জনে ব্যস্ত। দেশে প্রচলিত নানা স্তরের হাজার হাজার মকতব-মাদরাসার শিক্ষকদের সবাই কোন না কোন মাদরাসা হতে শিক্ষা প্রাপ্ত। মসজিদের মোয়াজ্জেন, ইমাম, খতিবসহ বিয়ের কাজী এবং ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত ওয়াজ-তবলীগের খেদমত আনজাম দানকারীদের অধিকাংশই কোন না কোন শ্রেণির ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অল্পবিস্তর লেখাপড়া করেছেন। ইসলামের প্রচার-প্রসার ও ইসলামী শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে নানা স্তরের এ ওলামা সমাজের ভ‚মিকা এ লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যেগুলো বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের অর্ন্তভুক্ত, সেগুলোর সংখ্যাও বিপুল এবং মাদরাসা শিক্ষকদের একক বৃহত্তর সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সদস্যভুক্তদের তালিকা বিশাল। কাজেই বলা যায়, জমিয়াতুল মোদার্রেছীন সকলের অন্তরে, সকলের নিকট পরিচিত।
ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে জমিয়াতের প্রভাব নানাভাবে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। জমিয়াতের ব্যানারে না হলেও সমাজে অন্যায়-অবিচার, ঘুষ-দুর্নীতি, অশ্লীলতা, জুয়া, প্রতারণা, কালো বাজারী, ভেজাল, ধোঁকা, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ইত্যাদি অনৈতিকতা ও সমাজবিরোধী কার্য কালাপ তথা সর্ব প্রকারের পাপাচারের বিরুদ্ধে, যারা মানুষকে সৎ পথে আনার জন্য সর্বদা সোচ্চার, তাঁরা সবাই প্রধানত মসজিদের ইমাম-খতিব ওয়ায়েজ-বয়ানকারী মাদরাসা পড়–য়া আলেমগণ এমনকি তারা ব্যতীত কোন মুসলমানের জানাজা পর্যন্ত হয় না, বিয়ে হয় না এবং নবজাতকের কানে আজানও হয় না। এতদ্ব্যতীত সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যারা প্রকাশ্যে রাজপথে থাকে, তাদের অগ্রভাগেও থাকে মওলবী-মওলানার দল। মানুষকে কোরআন-হাদীস তথা ইসলামের প্রতি আহŸানকারী আলেম-ওলামা এবং রূহানী শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির চালিকাশক্তি যাদের কাছে তারা সবাই হচ্ছেন পীর-আওলিয়া, মাশায়েখ।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের আকাশে যখন কালো মেঘ জমেছিল, জমিয়াত প্রধান এ এম এম বাহাউদ্দীনের যোগ্য নেতৃত্বে ও দূরদর্শিতাপূর্ণ পদক্ষেপ এবং তার কর্মনিষ্ঠ সহকারীদের সক্রিয় সহযোগিতায় তা বিলীন হয়ে যায়। তিনি আত্মনিয়োগ করেন জমিয়াতকে আরো সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে এবং অপূর্ণ দাবিগুলো আদায় করার আন্দোলনে। তিনি সহকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগে অবতীর্ণ হন। তাঁর দাবি-দাওয়ার সমর্থনে এগিয়ে আসতে থাকেন দেশের মাদরাসা ছাত্র-সমাজ, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ এবং বিভিন্ন স্তরের মাদরাসা শিক্ষাদরদী ও জমিয়াত ভক্ত অনুসারীগণ।
দাবি নামার মধ্যে প্রধান ছিল ইসলামী আরবী বিশ^-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। যেহেতু মাওলানা এম এ মান্নান (রহ) এর আজীবন প্রাণের দাবি আদায়ের আন্দোলনের সুফল ঘরে তোলার সময় তাতে পোকা লেগে যায় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও মহল বিশেষের কূট কৌশলে অন্য কথায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থে আরবী শব্দ বাদ দিয়ে শুধু ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় নামে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়, যা কারো কারো মতে ‘ছিনতাই’ হয়ে যায়। মাওলানা মরহুম এঘটনায় দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ ও মনোক্ষুণœ হন। তবে তিনি বলেন যে, ‘এটি মন্দের ভালো। এ দেশের লোকেরাতো একটি ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় পেলো, যা জমিয়াত ও মাদরাসা ছাত্র সমাজের আন্দোলনেরই ফসল।’ কিন্তু গঠিত বিশ^বিদ্যালয়ের নাম হতে কেন আরবী শব্দটি ‘উধাও’ হয়ে গেলো? সুতরাং স্বতন্ত্র আরবী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি পূরণ হয়নি। এ দাবি আদায় করতে হবে। জমিয়াতের সভাপতি হিসেবে তিনি এ দাবি আদায়ের আন্দোলন নতুনভাবে শুরু করেন। এরমধ্যেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়। তাঁর অসুস্থ অবস্থায় এ এম এম বাহাউদ্দীনকে জমিয়াতের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত করায় তারই নেতৃত্বে সর্ব প্রথম যে প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে স্মারকলিপি পেশ করেন, তাতে ইসলামী আরবী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল অন্যতম।
অতঃপর জমিয়াত সভাপতির নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনে দাবিগুলোর মধ্যে স্পষ্ট বলা ছিল, আরবী ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা। এর পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য তিনি রীতিমত অভিযান শুরু করেন। জমিয়াতের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজিসহ অন্যান্য জমিয়াত কর্মকর্তাদের নিয়ে দেশের নানা স্থানে ঝটিকা সফর শুরু করেন এবং সভা-সম্মেলন, অনুষ্ঠান করে আরবী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত আদায় করতে থাকেন এবং ঢাকায় বিভিন্ন সময় একই উদ্দেশ্যে শিক্ষকদের সম্মেলন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রতিটি সম্মেলন জন¯্রােতে পরিণত হয়ে যায়। অপর দিকে সরকারের সাথে দাবি-দাওয়া আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক ও অফিসিয়াল দেনদরবারও চলতে থাকে। এ আন্দোলন দেশের ইসলামী মহলে দারুণ সাড়া জাগায়। বর্তমান শতকের দ্বিতীয় দশকে এ আন্দোলন সর্বত্র সয়লাবের আকার ধারণ করে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সাথে জমিয়াত কর্মকর্তাদের সরাসরি যোগাযোগ সম্পর্ক স্থাপিত হতে থাকে। বহুল আলোচিত এ আন্দোলন নিয়ে অসংখ্য লেখা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, প্রতিবেদন ইত্যাদি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে যার উল্লেখ এখানে নিস্প্রয়োজন।
অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা-প্রচেষ্টায় এবং জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে জমিয়াত কর্মকর্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও কর্ম তৎপরতার ফলে আরবী ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় একটি বাস্তব প্রতিষ্ঠানের রূপ লাভ করে। জাতীয় সংসদে ইসলামী আরবী বিশ^বিদ্যালয় বিল পাস হওয়া থেকে পরবর্তী ধাপগুলো বিস্ময়করভাবে দ্রæত অতিক্রম করে যা এক বিরল ঘটনা। এ বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্বোধন, ক্লাস শুরু ইত্যাদি এত দ্রæত সম্পন্ন হয়েছে যা কল্পনও করা যায় না। বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও অত্যন্ত দ্রæততার সাথে সকল কার্যক্রম শুরু করে আরেক ধাপ এগিয়ে যান। ইসলামী আরবী বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ের আন্দোলন থেকে শুরু করে তার প্রতিষ্ঠা ও চালু করা পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে কার্যকর প্রধান ভূমিকা পালন করেন জমিয়াত প্রধান। তাই একজন মন্ত্রী স্বীকার করে অকপটে বলেছেন, আরবী ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন ইনকিলাব সম্পাদক ও জমিয়াত সভাপতি এ এম এম বাহাউদ্দীন। জমিয়তের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে এসব কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। (সমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন