শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

উন্নয়ন ও বিনিয়োগের নতুন চ্যালেঞ্জ

| প্রকাশের সময় : ২৮ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সম্ভাবনার ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। দেশের এই অর্জনকে সরকার ঘটা করে উৎযাপন করলেও এর মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ আরো কঠিন হয়ে পড়ল বলেই অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, এতদিন এলডিসি বা দরিদ্র দেশ হিসেবে আমদানী-রফতানী বাণিজ্যে যে সব সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছিল উন্নয়নশীলের যোগ্যতা অর্জনের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মত বাজারে তা বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জ আরো কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এলডিসি থেকে ডেভেলপিং কান্ট্রিতে পরিণত হওয়ার নতুন বাস্তবতায় আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে স্থিতিশীলতা ও নতুন গতি নিশ্চিত করতে হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, বাণিজ্য ঘাটতি, রফতানী বহুমুখীকরণ ও নতুন নতুন বাজার সৃষ্টির পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের চলমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকগুলো ধরে রাখার প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা সরকারের কাছে অগ্রাধিকার হিসেবে গণ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের ইমেজ সংকট এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত করাই মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ এবং সব দলের সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মানদন্ড বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে এর বিরূপ ফলাফল দেশের অর্থনীতিকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
প্রায় এক দশক ধরে দেশে বিনিয়োগে মন্দাভাব চলছে। বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব নানা কারণে বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। অনেক বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রত্যাহার করে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশের সামনে যে সব অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ধরা দিয়েছিল তা যদি যথাযথভাবে কাজে লাগানো যেত তাহলে এতদিনে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়া বাংলাদেশের জন্য অসম্ভব ছিলনা। বিশেষত: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মত প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। জননিরাপত্তা ও সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের মত ইস্যুগুলোর রাজনীতিকরণ এবং অতিপ্রচারণা দেশে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী করেছে। সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি এবং পুলিশি ব্যবস্থা দেশে আস্থাপূর্ণ বিনিয়োগ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে তেমন কাজে আসেনি। বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় প্রতিমাসে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। দেশ থেকে টাকা পাচারের বছরওয়ারী পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নির্বাচনের বছর টাকা পাচারের হার দ্বিগুন বেড়ে যায়। চলতি বছরটি নির্বাচনের বছর হওয়ায় এ বছর টাকা পাচারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সমুহ আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচনী রাজনৈতিক সমঝোতা ও বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কেবল দেশের অর্থনৈতিক ও সম্ভাবনা ও ধরে রাখা সম্ভব।
চলতি অর্থবছরের ৭ মাসে দেশের অর্থনীতি গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তারল্য সংকটের সম্মুখীন হয়েছে বলে গতকাল একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। রফতানী কমে যাওয়া, বৈদেশিক রেমিটেন্স কমে যাওয়া এবং আমদানী বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বড় ধরনের তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। গত অর্থবছরের এ সময়ে যেখানে অর্থের ঘাটতি ছিল ৮৯০মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা, সেখানে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাতমাসে এই ঘাটতি ৫.৩৪বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা। দেশের অর্থনীতির জন্য এ এক অশনি সংকেত। অতীতেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি ফাঁকি দিয়েই ভ‚য়া ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়েছে। চলতি বছরের এ সময়ে অস্ব^াভাবিক বাণিজ্য ঘাটতি এবং তারল্য সংকটের পেছনে অন্যান্য বিষয়গুলোর পাশাপাশি ব্যাপক হারে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। নানা সংকট ও প্রতিবন্ধকতা সত্বেও প্রাথমিক মর্যাদা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়ে রেখেছে। রাজনৈতিক কারণে দেশ আবারো অস্থিতিশীল হয়ে পিছিয়ে পড়ার যে কোন আশঙ্কা দূর করার পদক্ষেপ এখনি নিতে হবে। শুধুমাত্র পুলিশ দিয়ে এ সংকট দূর করা যাবেনা। রাজনৈতিক সমঝোতা, নিরাপত্তা ও সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কেবল বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব। বিনিয়োগের প্রতিবন্ধক হিসেবে আমলাতান্ত্রিক অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো বার বার উঠে আসলেও এসব সমস্যা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। নজির বিহিন বাণিজ্য ঘাটতি ও তারল্য সংকট মোকাবেলায় জরুরী উদ্যোগ হিসেবে রফতানী আয় বাড়ানো এবং রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগের কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তবে দেশকে উন্নয়নশীল ও মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার রূপকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষত: সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক একগুয়েমির কারণে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন