বাংলাদেশের মাটিতে আমাদের জন্ম, এ মাটিতেই আমাদের বেড়ে ওঠা। কিন্তু গোটা এ দেশটি সবার দেখা ও জানা হয়নি। সারাদেশে গোটা দু’চারেক গবেষক হয়তো আছেন যারা এ দেশটাকে ঘুরেফিরে দেখেছেন, জেনেছেন। বাকিরা, মানে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ নিজের দেশটাকে চেনেন না, জানেন না। তাই এ দেশ ও দেশের ঐতিহ্য, এমন বহু কিছু দেখার-জানার বাইরে রয়ে গেছে। এখানে বলতে হয়, মানব সমাজের বড় অংশটিই চিরকাল ঘরকুনো স্বভাবের, তাই তারা নিজের ঘর-সংসার-সমাজের বাইরে পা ফেলতে তেমন আগ্রহ বোধ করে না। আমাদের মধ্যেও সে স্বভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। মনে হয়, আমাদের দেশে নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ উদযাপনের বিশদ রূপটি দেখা বা জানা হয়নি আমাদের বেশিরভাগ মানুষের।
বাংলাদেশে বৈশাখকে বরণ ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এ ঐতিহ্য সম্পূর্ণরূপেই বাঙালি ঐতিহ্যের অন্তর্গত। এ দিনটি উদযাপনের সাথে ভিন্ন কিছু যোগ হওয়ার অবকাশ নেই। বাংলাদেশে শিক্ষিত মানুষদের সবাই প্রচলিত ভাষায় আমরা যাকে বলি ইংরেজি সন, সেটাই ব্যবহার করেন। সরকারি নির্দেশে দাপ্তরিক চিঠিপত্রে বাংলা সন-তারিখ ব্যবহারের প্রচলন আছে বটে, তবে কেউই প্রয়োজন থেকে তা করেন না বলে তা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। কারণ এটা স্বীকৃত যে, বাংলা সন তারিখ জনজীবনে প্রায় কোনো কাজেই লাগে না। ব্রিটিশ রাজত্বে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে পাকিস্তান আমলের শেষ পর্যন্তও গ্রামীণ মানুষের মধ্যে শিক্ষিতরা বাংলা পঞ্জিকা ব্যবহার করতেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধে হিন্দু সমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত ও ব্যবহৃত ছিল লোকনাথ পঞ্জিকা ও মুসলমানদের মধ্যে মোহাম্মদী পকেট পঞ্জিকা। নববর্ষের অব্যবহিত আগে এসব পঞ্জিকা ছাপা হয়ে বইয়ের দোকান, ভিপিপি পোস্ট বা ক্যানভাসারের মাধ্যমে লোকজনের কাছে পৌঁছে যেত। এই পঞ্জিকা ছিল বাংলা নববর্ষের সাথে সম্পৃক্ত।
আগে বাংলা নববর্ষ উদযাপন ছিল সম্পূর্ণরূপেই গ্রামীণ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। গ্রামীণ বাংলার আবহ আজ ক্রমবিলীয়মান। যেখানে যেটুকু গ্রামবাংলা আজো টিকে আছে তার অনেক স্থানেই পয়লা বৈশাখ উদযাপিত হয়। বস্তুত, বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ আবহমানকাল ধরেই জড়িয়ে আছে গ্রামীণ জীবনের সাথে। কিন্তু একালের পয়লা বৈশাখ উদযাপনের মূল ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে নগর, দেশবাসীর সব মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে নগর জীবনের নববর্ষ উদযাপন। বিগত বছরগুলোতে রাজধানী ঢাকা হয়ে উঠেছে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু। একদিকে রমনা বটমূলে (রমনা অশত্থতল কিভাবে যেন বটমূল হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত হয়ে গেল) সকালের প্রথম আলোয় সাঙ্গীতিক আবাহন অন্যদিকে চারুকলা থেকে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা আর কৃত্রিম পান্তা-ইলিশ আহার এখন হয়ে উঠেছে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রতীক। গ্রামবাংলায় যে নববর্ষ উদযাপন করা হয়, তার চারিত্র্যের সাথে নগর জীবনের নববর্ষ উদযাপনের চারিত্র্য মেলে না। বাংলাদেশের যেসব প্রান্তে পয়লা বৈশাখ উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয় তার বিশদ বা পরিচিতিমূলক কোনো বিবরণ রচিত হয়েছে কি না জানি না, তবে তার সার্বিক চারিত্র্য নাগরিক উদযাপনের চেয়ে আলাদা।
গ্রামবাংলায় পয়লা বৈশাখ উদযাপনের চল কি শতাধিক বছর না আরো বেশি সময়ের পুরনো তা সঠিক জানা যায় না। কলকাতা যখন প্রায় দুশ’ বছর উপমহাদেশের রাজধানী ও বাংলাভাষীদের প্রাণকেন্দ্র ছিল, সেখানেও বাঙালির বাংলা নববর্ষ উদযাপনের খবর সেকালের পত্র-পত্রিকায় পাওয়া যায় না। যতটুকু জানা বা বোঝা যায় তা হলো বাংলা নববর্ষ আভাষিত হতো পয়লা বৈশাখ হিসেবে। এ পয়লা বৈশাখ আজকের মতো এমন নাগরিক উৎসবমুখর ছিল না। আগের দিনে নববর্ষে দু’টি প্রথার সূচনা ঘটে। তার পালন ক্রমশ ঐতিহ্যে পরিণত হয়। প্রথা দু’টির একটি হলো জমিদারের পুণ্যাহ উৎসব, আরেকটি বাংলার বেনিয়া সমাজের হালখাতা উৎসব। জানা যায়, প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে নবাব, জমিদার, ভ‚স্বামীরা একপর্যায়ে বাংলা সনের প্রথম দিনটি নির্ধারণ করেন। এ দিনটির নাম দেয়া হয় পুণ্যাহ। এ দিনে কৃষকসহ সর্বস্তরের প্রজাগণ জমিদারের কাচারিতে এসে বকেয়া খাজনা পরিশোধ করত। এ সময় প্রাপকের ঘর ভরে উঠত ধনে, আনন্দ হিল্লোল বয়ে যেত তাদের মনে। কিন্তু যারা খাজনা দিত তাদের বহুজনের দুঃখ-কষ্ট-কান্না-বেদনার ছাপ তাতে জড়িয়ে থাকত। আবার নানা কার্য-কারণে যারা খাজনা পরিশোধে অসমর্থ হতো তাদের জন্য দিনটি ভালো হতো না। যাহোক, এ দিনটিতে আগত প্রজাদের করার জন্য কোনো কোনো জমিদার কিছু আনন্দ-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতেন। ব্রিটিশ আমলে এ রকম আয়োজনের মধ্যে মোরগ লড়াই, পুতুল নাচ, যাত্রা ইত্যাদির কথা জানা যায়। দেখা যায়, এ পুণ্যাহ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রথম উৎসব। তবে পুণ্যাহ আজ স্মৃতি বা ইতিহাস। এ বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য যে গত শতকে পঞ্চাশের দশকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে জমিদারের খাজনা আদায় প্রথারও বিলুপ্তি ঘটে। প্রজারা পরিণত হয় জনগণে। আর খাজনা গ্রহণের মালিকানা বর্তায় সরকারের ওপর। তহশিল অফিসের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা চালু হয়। সম্ভবত গোটা বংলাদেশে একমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের বোমাং সার্কেলেই পুণ্যাহ শব্দটি টিকে আছে। পয়লা বৈশাখে দ্বিতীয় যে প্রথাটি নববর্ষের বৈশিষ্ট্য জ্ঞাপক হয়ে ওঠে তা হলো হালখাতা। এখনো নববর্ষ মানেই হালখাতা। ব্যবসায়ে বাকি প্রথার চল আছে। বছরজুড়ে ব্যবসার বকেয়া পরিশোধের দিন এ পয়লা বৈশাখ। এদিনে বাকি গ্রহীতারা সব বকেয়া পরিশোধ করেন। নতুন খাতা খোলা হয়, শুরু হয় নতুন হিসাব। তবে ধীরে ধীরে এ চলটিও কমে আসছে। আধুনিককালে প্রযুক্তির উৎকর্ষ আগের সব চারিত্র্য পাল্টে দিচ্ছে। এখন বহু বড় ব্যবসাতে আর খাতা কলমের ব্যবহার নেই, সে জায়গা দখল করেছে কম্পিউটার। এ ব্যবসায়ী সমাজে পয়লা বৈশাখ অপাঙক্তেয়।
গ্রামীণ এলাকায় পয়লা বৈশাখ আজো সরব মেলার মধ্যে। ঢাকার মতো গ্রামবাংলায় সঙ্গীতের আবাহনে কেউ পয়লা বৈশাখকে স্বাগত জানায় না। সাধারণত কোনো কোনো এলাকায় এ উপলক্ষে স্বল্প পরিসরে মেলার আয়োজন করা হয়। সেখানে চোখে পড়ে গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ। পয়লা বৈশাখের মেলা মানে খৈ-মুড়ি, বাতাসা, খোরমা, কদমা, ছাঁচের মিষ্টি, জিলাপিসহ নানা রকম মিষ্টি, ঝুড়ি-ডালিসহ বাঁশ থেকে তৈরি নানা জিনিস (এক সময় পাওয়া যেত বেতের তৈরি ধামা-কাঠা, সের (চাল মাপার জন্য)সহ বিভিন্ন জিনিস, খেজুর পাতার পাটি, কাঠের তৈরি নানা জিনিসপত্র, বাঁশি-বেলুন, মাটির খেলনা (এক সময় মাটির হাঁড়ি, পাতিল, মালসা, ঢাকনা, কলস, ঝাঁঝর প্রভৃতি জিনিসের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এখন তা বিলুপ্তপ্রায়) ইত্যাদির উপস্থিতি। আজো কমবেশি এসব জিনিস মেলে। রাতের বেলা কোথাও কোথাও যাত্রাপালা কিংবা লোকগানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। সময়ের আবর্তনে অনেক কিছুই আজ হারিয়ে গেছে।
সময় অনেক কিছুই কেড়ে নেয়। অনেক কিছুতে পরিবর্তন ঘটে। কোনো কিছুই অপরিবর্তিত থাকে না। গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে সবচেয়ে দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেছে নদীপ্রবাহে। মানুষের জীবন-জীবিকা-পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর পড়েছে তার ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব। মানুষের আচার-আচরণেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের ছোঁয়া নিয়েই টিকে আছে বাংলা নববর্ষ। আগের মতো নেই। পুরনোর বদলে এসেছে নতুন কিছু। পুণ্যাহ হারিয়ে গেছে। খাজনা দিতে না পারলে প্রজার ঘরছাড়া, জমিছাড়া, নির্যাতনের শিকার হওয়ার দিন চলে গেছে। পয়লা বৈশাখ এখন আধুনিক চেতনা ও জীবনবোধের অনুষঙ্গে দীপ্ত, গতিময়। এখন রমনা বটমূলে ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত আয়োজনের সাথে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরও সঙ্গীত আয়োজনে মুখর হচ্ছে। ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে চলেছে পয়লা বৈশাখের ভোরে হাজারো কন্ঠে গীত গানের অনুষ্ঠান। স্বীকার করতেই হবে যে, এটি পয়লা বৈশাখের প্রণোদনা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে সংস্কৃতির এই প্রসার ও বিকাশ জনসমাজের কিছু অংশকে বিমুগ্ধ-আমোদিত করে বটে- কিন্তু সর্বপ্লাবী কোনো প্রভাব বিস্তার করে না যাতে জাগ্রত হয় ন্যায়, বিবেক, শুভবুদ্ধি, মানবতা। নববর্ষের আলোক উদ্ভাস আমাদের ভেতরের তিমিরলোকে আলো ফেলতে পারে কই?
বাংলাদেশের জনসমাজে পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ সর্বজনীন উৎসব। মূলত লোকায়ত, তবে নাগরিক বৈশিষ্ট্যময় অপচ্ছায়া তাকে গ্রাস করতে চলেছে। এ গ্রাসে আবৃত হয়ে অথবা আগামীতে হয়তো গ্রামীণ ও নাগরিক- এ উভয় প্রকার চারিত্র্য নিয়েই উদযাপিত হতে থাকবে পয়লা বৈশাখ। বাঙালির উৎসব হিসেবে এটি যেভাবে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে ও পাচ্ছে তাতে বোঝা যায় যে, উৎসব হিসেবে তা দীর্ঘস্থায়িত্ব পাবে।
নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ তার নিজস্ব রঙে-রূপে রসে-বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের মানুষকে আনন্দোদ্বেল ও প্রাণচঞ্চল করে রাখুক। কলুষ-কালিমা দূর করে দিক, দেশের মানুষকে নতুন আশা ও প্রত্যয়ে দীপ্ত করুক আর সব আবর্জনা একেবারে ধুয়েমুছে দিক। শুভ হোক বাংলা নববর্ষ, মঙ্গল হোক দেশবাসীর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন