সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

পিতা-মাতার নৈতিক ও আইনী অধিকার

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

\ সাত \
অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। পিতা মাতা যদি তোমাকে আমার সাতে এমন বিষয়কে শরীক স্থাপন করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে জ্ঞাত করবো। “আল কুরআন ৩৯:১৪-১৫।” উপরোক্ত আয়াতের বিশ্লেষন করলে আমরা দেখতে পাই, প্রথমত আল্লাহ তা’আলা উক্ত আয়াতে সন্তানের জন্য মায়ের কষ্টের বর্ণনা, বিশেষ করে তাকে কত কষ্টে তার মা গর্ভে ধারণ করেছেন তা বর্ণনা, সন্তানের প্রতি মায়ের অনুগ্রহ, সন্তানকে দুধ পান করানো ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আয়াতে আমার প্রতি ও তোমার পিতা মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও’ দ্বারা আল্লাহর কৃতজ্ঞতার পরপরই পিতা মাতার কৃতজ্ঞাতার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত: আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতা প্রকাশ পায় এমন কোন নির্দেশ পিতা মাতা প্রদা করলে তার আনুগত্য করা যাবে না। তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাব রেকে সহঅবস্থানের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলার নির্দেশিত প্রতিটি কাজের মধ্যেই সওয়াব ও কল্যাণ রয়েছে। আল্লাহর অনুগত্যের মাধ্যমেই তার নৈকট্য অর্জরা করা যায়। এত সব আমলের মধ্যে পিতা মাতার প্রতি সদাচরণকে রাসূলুল্লাহ স. আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল বলে ঘোষনা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন আমি নবী স. কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় আমল কোনটি? তিনি বলেন: পিতা মাতার সাথে সদাচার। আমি বললাম তারপর কোনটি? তিনি বললেন: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি আমাকে এসব বিষয়ে বললেন। আমি আরো জিজ্ঞেস করলে তিনি অবশ্যই আমাকে আরো বলতেন। “ইমাম বুখারী, আস-সহীহ (অনুবাদ ও সম্পাদনা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৫ ঢাকা) অধ্যায়: শিষ্টাচার, অনুচ্ছেদ: আল বিররি ওয়াস সিলাহ, হাদীস নং-৫৪৩২,খ,৯.পৃ.৩৮৯, ইমাম বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ, প্রাগুক্ত, হাদীস নং ১ পৃ.৩৩।” পিতা মাতার সাথে কোমল ব্যবহার এবং নম্র ভাষায় বিনয়ী হয়ে কথা বলার নির্দেশ দেওয়ার কারণ হলো বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হলে তারা অনেক সময় স্বাভাবিক আচরণ নাও করতে পারেন। তখন তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেতে পারে বা কোন বিষয়ে অধৈর্য হয়ে পড়তে পারেন। সেই অবস্থায় ও সন্তানকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং কোমল ভাষায় কথা বলতে হবে। তায়সালা ইবনে মায়্যাস রহ. বলেন, আমি যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত ছিলাম। আমি কিছু পাপকাজ করে বসি, যা আমার মতে কবীরা গুনাহর শামিল। আমি তা ইবনে উমার রা. এর কাছে উল্লেখ করলে তিনি জিজ্ঞেস করেন, তা কী? আমি বললাম, এই ব্যাপার। তিনি বললেন, এগুলো কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত নয়। কবীরা গুনাহ নয়টি: (১) আল্লাহর সাথে শরীক করা, (২) নরহত্যা, (৩) জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন, (৪) সতী সাধ্বী নারীর বিরুদ্ধে যিনার মিথ্যা অপবাদে রটানো, (৫) সুদ খাওয়া, (৬) ইয়াতীমের মাল আত্মসাৎ করা, (৭) মসজিদে ধর্মদ্রোহী কাজ করা, (৮) ধর্ম নিয়ে উপহাস করা, (৯) সন্তানের অসদাচরণ যা পিতা মাতার কান্নার কারণ হয়। ইবনে উমার রা. আমাকে বলেন, তুমি কি জাহান্নাম থেকে দূরে থাকতে ও জান্নাতে প্রবেশ করতে চাও? আমি বললাম আল্লাহর শপথ! আমি তাই চাই। তিনি বলেন, তোমার পিতা মাতা কি জীবিত আছেন? আমি বললাম, আমার মা জীবিত আছেন। তিনি বলেন আল্লাহর শপথ! তুমি তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বললেও ভরণ পোষন করলে তুমি অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদি করীরা গুনাহসমূহ থেকে বিরত থাকো। “ইমাম বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ, অনুচ্ছেদ: পিতা মাতার সাথে নম্র ভাষায় কথা বলা, প্রগুক্ত হাদীস নং ৮পৃ.৩৫।” পিতা মাতা সন্তানের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমতস্বরুপ। সন্তানের জন্য পিতা মাতা দু’আ কবুল হয়। তাই তাদের দু’আ নিতে হবে এবং বদদু’আ থেকে বাঁচতে হবে। বদদু‘আ থেকে বাঁচার উপায় হলো তাদের প্রতি অসদাচরণ না করা। আবু হুরায়রা রা. বলেন রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন: তিনটি দু‘আ অবশ্যই কবুল হয়, এতে কোন সন্দেহ নেই। (১) মজলুম বা নির্যাতিতের দু‘আ, (২) মুসাফিরের দু‘আ এবং (৩) সন্তানের জন্য পিতা মাতার দু‘আ। “ইমাম বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ অনুচ্ছেদ: দা’ওয়াতিল ওয়ালিদাইন, প্রাগুপ্ত হাদীস নং ৩২.পৃ.৪৪।”
ইসলাম পিতা মাতার প্রতি আচরণকে এতই গুরুত্ব প্রদান করেছে যে, তাদের মৃত্যুর পরও তাদের প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর তা হলো, তাদের জন্য দু‘আ করা, তাদের বৈধ ওসিয়ত পূর্ণ করা, তাদের বন্ধু-বান্ধবগণের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের দিক থেকে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে এমন আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা। উসাইদ রা. বলেন, আমরা নবী স.- এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এক ব্যক্তি বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার কোন অবকাশ আছে কি? তিনি বলনে: হ্যাঁ, চারটি উপায় আছে। (১) তাদের জন্য দু‘আ করা, (২) তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, (৩) তাদের প্রতিশ্রুতিসমূহ পূর্ণ করা এবং (৪) তাদের বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করা ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করা, যারা তাদের মাধ্যমে তোমার আত্মীয়। “ইমাম বুখারী, আল-আদাবুদ মুফরাদ, অনুচ্ছেদ: বিররিল ওয়ালিদাইনি বা‘দা মাওতিহিমা, প্রাগুক্ত, হাদীস নং-৩৫, পৃ. ৪৬”। ও.আই.সি-এর উদ্যোগে ১৯৯০ সালের ৩১ জুলাই থেকে ৫ আগষ্ট পর্যন্ত ৬ দিন ব্যাপী ও.আই.সি. ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের পররষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্টিত হয়। সম্মেলনের সর্বশেষ দিন ৫ আগষ্ট The Cairo Declaration of Human Rights In Islam” সর্বসম্মত মতের ভিত্তিতে অনুমোদন করা হয়। উক্ত ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ৭ এ সন্তান ও পিতা-মাতার অধিকার সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ: ৭ (ক) জন্ম গ্রহণের প্রাক্কালে, প্রত্যেক শিশুর তার পিতা-মাতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষ হতে যথাযথ পরিচর্যা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসম্মত যত্ন এবং নৈতিক তত্তাবধান পাবার অধিকার রয়েছে। ভ্রূণ এবং মা অবশ্যই সুরক্ষিত এবং বিশেষ যত্নে থাকবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন