সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

পিতা-মাতার নৈতিক ও আইনী অধিকার

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২৭ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

\ শেষ \
(খ) পিতা-মাতার বা দায়িত্বপ্রাপ্তদের অধিকার রয়েছে যে, তাদের ইচ্ছানুযায়ী সন্তানকে শিক্ষা প্রদান এবং ভবিষ্যতের জন্য গঠন করা নৈতিক মূল্যবোধ এবং শরী‘আহ- এর মূলনীতির আলোকে। (গ) পিতা-মাতা উভয়ই সন্তান-এর নিকট হতে অনুরূপ অধিকার রয়েছে এবং আত্মীয়দেরও তাদের পরম্পরের নিকট হতে শরী‘আহ্-এর আলোকে অধিকার রয়েছে।
ও.আই.সি.-ভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সম্মেলনে শিশুদের অধিকার বর্ণনা করা হয়েছে এবং সন্তানের পক্ষ থেকে পিতা-মাতার জন্যও অনুরূপ অধিকার রয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। শিশুদের জন্য অধিকার রয়েছে তার পিতা-মাতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের করা হয়েছে। শিশুদের জন্য অধিকার রয়েছে তার পিতা-মাতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিকট হতে, অনুরূপভাবে পিতা-মাতার জন্যও তাদের নিকট হতে অধিকার রয়েছে। কেননা বিদ্যমান আইনে শুধু আর্থিক দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে পৃথক পৃথক ৬ মাস বা ১ বছর কারাদন্ড অথবা আর্থিক দন্ড কিংবা উভয় দন্ডের বিধান রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আইনের ৫নং ধারার (১) উপধারায় “উক্ত অপরাধের জন্য ছয় মাস থেকে এক বছরের কারাদন্ড বা এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবে” সংযুক্ত করা যেতে পারে।
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইনটির শিরোনাম “পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ ও সদাচরণ আইন” করা যেতে পারে, সদাচরণ এর সংজ্ঞায় “শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান প্রদর্শন, আনুগত্য করা, শারীরিক ও মানসিকভাবে কষ্ট না দেওয়া, উচ্চ স্বরে ও কর্কশ ভাষায় কথা না বলা, যে কোন কথা বা কাজ দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কষ্ট না দেওয়া, তাদের প্রতি অবহেলা না করা”- যে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিদ্যমান আইনের ৩নং ধরার ৪নং উপধারা এর সাথে নিম্নোক্তভাবে সংযুক্ত করা যেতে পারে, ৩ (৪) “অথবা কোন সন্তান তার পিতা-মাতার প্রতি এমন আচরণ করবে না, যাতে পিতা বা মাতা বা উভয়ে স্বেচ্ছায় সন্তানের বাসস্থান থেকে আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য হন।” বিদ্যমান আইনের ৩নং ধারায় ৭নং উপধারায় বর্ণিত “সন্তান তার মাসিক আয় বা বাৎসরিক আয় হইতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা বা উভয়কে প্রদান করবে” এর সাথে অন্য একটি উপধারা যুক্ত করে ‘যুক্তিসঙ্গত’ পরিমাণ অর্থ এর ব্যাখ্যা দেয়া যায় এভাবে যে, “যা দ্বারা তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যয় বহনের ন্যূনতম অর্থ সংকুলান হয়”। যে সকল পিতা-মাতার সন্তান নেই বা সন্তানের কর্মসংস্থান নেই বা সন্তান আয় রোজগার করতে অক্ষম বা বিকলাঙ্গ তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সরকার কর্তৃক গ্রহণ করার জন্য বিধি প্রণয়ন করা। সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থার সকল স্তরের পাঠ্যসূচিতে পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের গুরুত্ব, নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, পিতা-মাতার প্রতি উত্তম আচরণের ধর্মীয় নির্দেশনা, পরকালীন জবাবদিহিতা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা এবং উল্লিখিত বিষয়সমূহ সরকারের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম ও বেসরকারি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার করার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধিকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ। বিদ্যমান আইনের ৬নং ধারার আমলযোগ্যতা, জামিন যোগ্যতা ও আপোষযোগ্যতার ক্ষেত্রে নমনীয়তা পরিহার করে আরো কঠোরতা আরোপ করা এবং বিচারিক আদালতের পরিধি ১ম শ্রেণী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সীমাবদ্ধ না রেখে এর পরিধি বৃদ্ধি করা। বিদ্যমান আইনের ৩নং ধারার উপধারা (৩) এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ সহায়ক আইন প্রণয়ন করা। যথা: সরকারি স্বায়ত্বশাসিত বা বেসরকারি কর্মক্ষেত্রসমূহের কর্মরতদের মধ্যে ক্ষেত্র অনুযায়ী তাদের পিতা-মাতার সঙ্গে বসবাস বা চিকিৎসার সুবিধার্থে তাদের অনুকূল বিভাগ, জেলা, থানা বা কর্মস্থলে পদায়ন (Posting)-এর বিধি প্রণয়ন করা।
সন্তানের জন্য পিতা-মাতার হলেন আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহ। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে সন্তানের লালন-পালন ও তাদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠার ক্ষেত্রে পিতা-মাতার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষপটে ‘পিতা-মাতার গুরুত্ব ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে পিতা-মাতার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, বিনয়ী আচরণ ও তাদের জন্য ব্যয় করার বিষয়ে ইসলাম দিক নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষভাবে বৃদ্ধ বয়সে তাদের প্রতি ভালো আচরণ, সেবা-যত্ন, সময় দান করা এবং আল্লাহ্র নিকট তাদের জন্য দু‘আ করার শিক্ষা ইসলাম প্রদান করেছে। তবে ইসলাম তাদের প্রতি সদ্ব্যবহারের জন্য আইন নির্দিষ্ট করে দেয়নি। রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে প্রয়োজন অনুযায়ী পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ বাস্তবায়নের জন্য শরী‘আহ্সম্মত পদ্ধতিতে কুরআন ও সুন্নহ্র ভিত্তিতে বিধান প্রণয়ন করতে পারবে। ইসলামে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। মূলত পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ যতটা না আইনগত তার চেয়ে বেশি নৈতিক ও ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধ-এর সাথে সম্পৃক্ত। মৌলিক অবক্ষয়ে জর্জরিত ও নৈতিক স্খলনে পতিত কোন সমাজে আইন দিয়ে নৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য জনসাধারণকে বাধ্য করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সমাজের সর্বস্তরের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অনুশীলন সামাজিক সচেতনতা। তাই আইন প্রণয়নের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের নৈতিক, ধমীয় মূল্যবোধ ও জবাবদিহিতার অনুশীলন প্রয়োজন। শিক্ষা ব্যবস্থার সকল স্তরে বিষয়টি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্তকরণ এবং রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা খুবই জরুরী। পাশাপাশি এ বিষয়ে আইনটি আরো সময়োপযোগী ও কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তাহলে সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত হবে, র্নিবিঘ্ন হবে তাদের অধিকার প্রাপ্তি।
লেখকঃ শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন