শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

পিতা-মাতার প্রতি আদব-০১

মুফতী মোঃ আবদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২৮ জুন, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ্ রাব্বুল-আলামীন স্বীয় ‘রহমত’ গুণটির ছায়া-প্রভাব পিতা-মাতার অন্তরে এমনভাবে ঢেলে দিয়েছেন যে, তাদের সন্তানদের প্রতি মহব্বত, স্নেহ, প্রেম-ভালবাসা, দয়া-মায়া স্বভাবজাত গুণে পরিণত হয়ে গেছে। সেই দয়া-মায়ার নিদর্শন পশু-পাখি,জীব-জন্তুদের মাঝেও দৃষ্টিগোচর হয়। চড়ইপাখি একটি ছোট্র প্রাণী। কিন্তু সেও নিজের জন্য ও তার বাচ্চার জন্য বাসা তৈরি করে থাকে। দানা-পানি, আহার যোগাড় করে থাকে। নিজ ঠোঁটে পানি ভর্তি করে করে নিয়ে আসে এবং বাচ্চাদের পান করায়। মোরগের প্রতি লক্ষ করে দেখুন! একটি কত দূর্বল প্রাণী, কিন্তু নিজ বাচ্চাদের রক্ষার্থে বিড়ালের সঙ্গেও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আর মানুষ তো অবশ্যই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। বুদ্ধি-বিবেকের জ্যোতি দ্বারা জ্যোতিস্মান। তার তো সন্তানের সঙ্গে স্নেহ,দয়া-মায়া হওয়া একটি আল্লাহপ্রদত্ত ও বুঝে আসার মত ব্যাপার। এই মহব্বতের কারণেই পিতা-মাতা নিজের সব কিছুই সন্তানদের জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। একটু চিন্তা করলে, এ বিষয়টি একবারে স্পষ্ট হয়ে যায যে, যেখানে পিতা-মাতা নিজ সন্তানের লালন-পালনের ক্ষেত্রে কোন রকম ত্রæটি করেন না সেখানে সন্তানের জন্যও জরুরী যে, মাতা-পিতার পরিপূর্ণ আদব-সম্মান রক্ষা করা এবং তাঁদের সেবা-যত্ন ও আনুগত্যে কোন রকম ত্রুটি না করা। সবগুলো আসমানী কিতাবে এ বাস্তবতা অত্যন্ত ভালোরকম স্পষ্ট করা হয়েছে। যার কয়েকটি নিম্নরূপ:-
আল্লাহ্র নির্দেশ তাওরাতে:
* তাওরাত কিতাবে বান্দার হকের আলোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে,“তুমি স্বীয় পিতা-মাতাকে সম্মান প্রদর্শন করো, তা হলে এ জগতে তোমার যে-বয়স তোমার প্রভু দিয়ে থাকেন, তা তিনি বৃদ্ধি করে দেবেন।”
* আরেক স্থানে তিনি বলেন,“তোমাদের সকলেই যেন পিতা-মাতাকে ভয় করে চলে।(আহবার:৩-১৮)
* অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন,“আর যে-কেউ তার পিতা ও মাতাকে অভিশাপ-গাল-মন্দ করবে তাকে হত্যা করা হবে। যে নিজ পিতাকে বা নিজ মাতাকে অভিশাপ দিলো, সে জন্য তার রক্ত নিজেই বৈধ করে ফেললো।”
আল্লাহ্র নির্দেশ ইনজিলে:
* ইনজিলের ‘মথি’-অংশে রয়েছে, হযরত ঈসা (আ) বলেছেন,“ আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, নিজ মাতা-পিতাকে সম্মান করো। যে মাতা-পিতাকে অভিশাপ দেয়, অসম্মান করে, তাকে হত্যা করা হবে। কিন্তু তোমরা এমনটি বলে থাকো যে, যে নিজ বাবা-মা’কে বলে,আমার যা কিছু তোমাদের দেওয়া ওয়াজিব, তা আল্লাহ্র নামে দেওয়া হয়ে গেছে। আর কেউ যদি নিজ পিতা-মাতাকে সম্মান না করে, সে যেন আল্লাহ্র নির্দেশকে প্রত্যাখ্যান করলো।”
পূর্ববর্তী নবীগণের অবস্থা:
(১) ইমাম গাযালী (র) স্বীয় গ্রন্থ ‘মুকাশাফাতুল কুলূব’-এ লিখেন, আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত মূসা (আ)-কে বলেন,“হে মূসা! যে পিতা-মাতার আনুগত্য করলো; কিন্তু আমার আনুগত্য করলো না। তারপরও আমি তাকে পুণ্যবানদের মধ্যে লিখে দেই। তবে যে আমার আনুগত্য করার পরও, তার পিতা-মাতার প্রতি অবাধ্য থাকে, আমি তাকে না-ফরমানদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করি।”
(২) একবার হযরত ইয়াক‚ব (আ) তাঁর পুত্র হযরত ইউসুফ (আ) এর গৃহে এলেন, এতে তিনি পিতার অভ্যার্থনা-সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে দাঁড়ালেন না। আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত ইউসুফ (আ)-এর প্রতি ওহী নাযিল করে জানিয়ে দিলেন, আপনি আপনার প্রতি আদব প্রদর্শনে ত্রæটি করেছেন। আমি আমার ইজ্জত ও জালালিয়াত এর কসম করে বলছি ভবিষ্যতে আমি আপনার ঔরষে কোন নবীর জন্ম দেব না। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, মাতা-পিতার সঙ্গে বে-আদবীর প্রভাব ভবিষ্যত বংশ-খান্দানের ওপরও পড়ে থাকে। (সীরাতুন্নবী: আল্লামা শিবলী নো‘মানী)
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্র নির্দেশ:
(এক) আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “ আপনার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে ও পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ’ বলবে না এবং তাদেরকে ধমক দিবে না; তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলবে। মমতাবশে তাদের প্রতি ন¤্রতার পক্ষপুট অবনমিত করবে এবং বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।’(১৭:২৩-২৪)
আল্লামা ইবনে কাসীর (র) লিখেন, এখানে “ক্বাদ্বা”-শব্দের অর্থ হচ্ছে, নির্দেশদান। আল্লাহ্র তাকিদপূর্ণ নির্দেশ যা কখনো টলবে না, হেরফের চলবে না। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলার ইবাদত করো এবং নিজের মাতাপিতার আনুগত্য করো। এ বরকতপূর্ণ আয়াতে পিতামাতার প্রতি পাঁচটি আদব শিক্ষাদান করা হয়েছে।
আদব নং-১: আল্লাহ তা‘আলার বাণী “তাদেরকে ‘উফ’ও বলবে না”Ñতাফসীরে ‘বয়ানুল-কুরআন’এ ‘ঊফ’-এর ব্যাখ্যা ‘উহ্’ দ্বারা করা হয়েছে। কোন কোন তাফসীরবিদ এর মতে, ‘উফ’ বলে উদ্দেশ্য হচ্ছে, এমন কোন শব্দ/বাক্য বলা যাতে পিতামাতা কষ্ট পায়। এমনকি মাতাপিতার কোন কথা শুনে এমনভাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া, যা দেখে পিতামাতা অসন্তোষ প্রকাশ করেন, তা-ও ‘উফ’-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স) ইরশাদ করেছেন, কষ্ট দেয়ার ক্ষেত্রে যদি ‘উফ’-এর চেয়েও নূন্যতম আরও কোন কিছু থাকতো, তা-ও মহান আল্লাহ্ অবশ্যই বলে দিতেন। হযরত মুজাহিদ (র) আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন, যদি পিতামাতা বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হন এবং তোমাদেরকে তাঁদের প্র¯্রাব-পায়খানা ধোয়া-পরিস্কার করার প্রয়োজন পড়ে, তা হলে সে-ক্ষেত্রেও ইসফিস করবে না। নিজেই চিন্তা করে দেখো, ছোটবেলায় যখন তাঁরা তোমার পেশাব-পায়খানা পরিস্কার করেছেন, তাঁরাও ইসফিস করতেন না।
আদব নং-২: তারপর ইরশাদ করেন, “ এবং তাদেরকে ধমক দিবে না;”পিতামাতা যদি এমন কোন বিষয় চান বা দাবী করেন যা শরীয়তের সীমা ও শর্তের ভেতরেই হয়ে থাকে এবং সন্তান কমবেশী কষ্ট করে হলেও, সেই দাবী পূরণ করতে পারে;তা হলে সে-ক্ষেত্রেও মাতাপিতার দাবী প্রত্যাখ্যান করবে না। সন্তানের প্রচেষ্টা এটাই হওয়া চাই যে, মাতাপিতাকে যে-কোনো বৈধ কাজে, সর্বত্র,প্রতি-উত্তরে সর্বদা হ্যাঁ শব্দ মুখ থেকে বের করবে। যদিও নিজের অবস্থা ও সামর্থ মোতাবেক ‘না’ শব্দটি মুখে এসে যাওয়ার কথা।
আদব নং-৩: তারপর ইরশাদ করেন, “ তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলবে”।
মুসলিম উম্মার বিশেষজ্ঞগণ হতে , “ সম্মানসূচক কথা ”Ñএর ব্যাখ্যায় নি¤েœাক্ত বিবরণ বর্ণিত হয়েছে।
* হযরত হাসান (র)-কে কেউ প্রশ্ন করলো, ‘সম্মানজনক কথা’ মানে কি? তিনি জবাবে বললেন, “তঁদেরকে ‘আম্মা’, ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করবে, নাম ধরে ডাকবে না।”
* হযরত যুবায়ের ইবন মুহাম্মাদ (র) ‘সম্মানসূচক কথা’-এর তাফসীরে বলেছেন,
“বাবা-মা যখন তোমাকে ডাকেন, তখন জবাবে বল, ‘উপস্থিত আছি , সাড়াদানে প্রস্তুত আছি’।
* হাফেয ইবনে কাসীর (র) বলেন, বে-আদবীপূর্বক তাঁদের প্রতি হস্ত প্রসারিত করবে না; বরং ইজ্জত-সম্মান ও আদবসহ তাঁদের সঙ্গে কথা বলবে; ন¤্র ও ভদ্রভাবে কথা বলবে;তাঁদের সন্তুষ্টি সামনে রেখে সব কাজ করবে এবং তাঁদের মনে কষ্ট হতে পারে এমন কিছু করবে না, ইত্যাদি
* হযরত সাঈদ ইবনুল-মুসাইয়্যাব (র)-কে কেউ জিজ্ঞাসা করলো, পবিত্র কুরআনে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ তো বেশ কয়েকটি স্থানে রয়েছে; তা আমার বুঝে এসেছে। তবে ‘সম্মানসূচক কথা’-এর ব্যাখ্যা বুঝে আসেনি। তিনি জবাবে বললেন, মনিব যদি অত্যন্ত পরাক্রমশালী ও কঠোর স্বভাবস¤পন্ন হয় তা হলে যেভাবে তার অপরাধী ক্রীতদাস অত্যন্ত বিনীত ও ন¤্রভাবে কথাবার্তা বলে থাকে; ঠিক সেভাবে মাতাপিতার সঙ্গে কথাবার্তা বলবে।
* ‘দুররে মানসূর’ গ্রন্থে হযরত কাতাদা (র) থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, তার অর্থ হচ্ছে- “ন¤্র ও সহজ-সরলভাবে তাঁদের সঙ্গে কথা বলবে”।
সুতরাং পিতামাতার সঙ্গে কথা বলার সময় বিনয় ও আদবের প্রতি সার্বক্ষণিক লক্ষ রাখতে হবে। ‘সহজ-সরল’ এ কারণে বলা হয়েছে যে, পিতামাতার সঙ্গে কথা বলবে এমনভাবে যেন তাদের বার বার জিজ্ঞাসা করতে না হয়Ñকী বললো? কী অর্থ? অর্থাৎ তাঁরা যেন কোনরকম পেরেশানীর মুখোমুখী না হয়।
আদব নং-৪: মহান আল্লাহ্ বলেছেন, “ মমতাবশে তাদের প্রতি ন¤্রতার পক্ষপুট অবনমিত করবে”। উম্মতের বিশেষজ্ঞগণের কাছ থেকে আয়াতটির নি¤েœাক্ত ব্যাখ্যা-বিবরণ বর্ণিত হয়েছে।
* তাফসীরে ইবনে কাসীরে রয়েছে, মাতাপিতার সামনে বিনয়, কাকুতি-মিনতি, ন¤্র-ভদ্র ও অবনমিত ভাব-ভঙ্গিসহ অবস্থান করবে। কথাবার্তা বলার সময় তাদের সামনে হাত উপরে-নিচে উঠাবে না; যেমনটি সম-বয়সীদের সঙ্গে বসে বাক্যালাপ কালীন করা হয়।
* তাফসীরে ‘দুররে মানসূর’ গ্রন্থে হযরত যুবায়ের ইবন মুহাম্মদ (র)-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে যে,“পিতামাতা যদি তোমাকে গালমন্দ করে এবং বকাঝকা করে, তা হলে জবাবে এ টুকু বলবে,“আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার প্রতি দয়া করুন”!
* হযরত উরওয়া (র)-কে কেউ জিজ্ঞাসা করলো, পবিত্র কুরআনে পিতামাতার সম্মুখে‘অবনমিত’ হওয়ার যে-কথা বলা হয়েছে, তার অর্থ কি? তিনি জবাবে বললেন,“তাঁরা যদি কোন কথা তোমার বিরক্ত হওয়ার মতো বলে থাকেন, সেক্ষেত্রেও তুমি তাদের প্রতি আড়চোখে তাকাবে না”।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Md. Abul Futuh ৪ জুন, ২০২১, ১০:১৯ পিএম says : 0
চমৎকার আলোচনার জন্য ধন্যবাদ।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন