শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে রোজা

মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ | প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রমজান মাসের রোজা ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম। রমজানের রোজা মুসলমানের উপর ফরয করা হয়েছে। রোজার ব্যাপারে কুরআন-হাদিসে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলামের পূর্ব রোজার প্রচলন ছিল। কিন্তু অবাধ স্বাধীনতার ফলে রোজার ভাবমূর্তি ও প্রাণশক্তি নষ্ট করা হয়েছিল। আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যমকে অন্তঃসারশূণ্য করে নিছক এক অনুষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছিল। এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করে আবার আত্মিক ও নৈতিক ইবাদতে পরিণত ও সুন্দর করে উম্মতে মোহাম্মদীর উপর ফরয করে দেন আল্লাহ তাআলা। আল কুরআনুল কারীমে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রমজান মাসের রোজা ফরয করা হয়েছে। যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা: ১৮৩)। আল্লাহতাআলা আরো বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস (রমজান) পাবে তারা যেন সিয়াম সাধনা করে।’ (সুরা বাকার: ১৮৫)।
চলমান আলোচনায় ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা না করে ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে রোজার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে। কেননা, বিজ্ঞানসম্মত এ ইবাদতকে অযৌক্তিকভাবে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে দেখা যায়। অনেকের ধারণা রোজা বিজ্ঞানসম্মত নয়। রমজানের রোজা রাখার সুফল পাওয়া যায় না মূলত খাদ্যাভ্যাসের কারণে। সেহরি-ইফতার যদি ক্ষতিকর খাবার হয় তাহলে ক্ষতি তো হবেই।
বাংলাদেশের মানুষ ইফতার ও সাহরীতে সহজপাচ্য খাবার গ্রহণ না করে মুখরোচক মশলাদার খাবার গ্রহণ করে। এতে পাকস্থলীর এসিডিটি, আলসার, বদহজম আরো বেড়ে যায়।
তিরমিজি শরীফে এসেছে রাসূল (সা.) মাগরিবের নামাজের পূর্বে কয়েকটি তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। খেজুর না থাকলে কয়েক কোশ পানিই পান করতেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। কেন না এতে বরকত রয়েছে। যদি খেজুর না পায় তবে যেন পানি দ্বারা ইফতার করে। কারণ পানি হলো পবিত্রকারী।’ আসল বিষয় হলো রমজানের উদ্দেশ্য পূরণে রকমারি খাবার আয়োজন রোজার সুফলকে ম্লান করে দেয়। রোজার অর্থ হলো বিরত থাকা। ইসলামী পরিভাষায় সুবহে ছাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রী সংঘম থেকে বিরত থাকাকে সিয়াম বা রোজা বলে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নত গবেষণার ফলে জানা যায়, রোজার নানাবিধ উপকারিতার কথা। রোজা পালন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। বরং রোজা রোগমুক্তির বিশেষ অষুধ এবং সুস্থ্য হওয়ার বিরাট নিয়ামত।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে সুস্থ্য জীবনের জন্য কম খাওয়া আবশ্যক।
প্রখ্যাত চিকিৎসক ইবনেসিনা তাঁর রোগীদের ৩ সপ্তাহের জন্য উপবাস পালনের নির্দেশ দিতেন। কারণ, বছরে ১ মাস রোজা রাখার কারণে মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গের বিশ্রাম ঘটে। সকল বিষয়ে বিশ্রাম অনিবার্য। মানুষের শরীরে এক প্রকার জৈব বিষ জমাট হয়। এই জৈববিষ দেহের স্নায়ু এবং অন্যান্য জীবকোষকে দুর্বল করে দেয়। এক মাসের রোজার ফলে এই জৈববিষ দূর হয়ে যায়। রোজা দেহের রক্ত প্রবাহকে পরিশোধন করে। রোজা মানুষের হাইপারটেনশন কমাতে সাহায্য করে।
রাশিয়ার শরীর বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডাক্তার ডি. এন. নাকিটন বলেছেন, ‘তিনটি নিয়ম পালন করলে শরীরের বিষাক্ত দ্রব্যাদি বের হয়ে যাবে এবং বার্ধক্য থামিয়ে দিবে। তা হলো, অধিক পরিশ্রম করা, অধিক পরিমাণে ব্যায়াম করা এবং প্রত্যেক মাসে একদিন উপবাস থাকা।’
ড. ডিউই জোর দিয়ে বলেছেন, ‘রোগাক্লিষ্ট মানুষের পাকস্থলী থেকে খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে ফেল, দেখবে রুগ্ন মানুষটি উপবাস থাকছে না, উপবাস থাকছে তার শরীরে বাসা বেঁধে থাকা দীর্ঘদিনের রোগটি।’
চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক ডাক্তার হিপ্পোক্রিট্যাস বহু শতাব্দি পূর্বে বলেছেন, ‘অসুস্থ্য দেহে যতই খাবার দিবে ততই রোগ বাড়তে থাকবে।’
মুসলিম গবেষকগণ বলেন, পেপটিক আলসার রোজার কারণে তাড়াতাড়ি ভালো হয়। রোজার কারণে পাকস্থলী খাদ্যমুক্ত থাকে। এ সুযোগে পাকস্থলীর ক্ষতস্থান বা আলসার নিরাময়ে লেগে যায়। পাকস্থলী খালি হওয়া মাত্রই তার ক্ষয় পূরণ এবং পুনঃগঠনের কাজ শুরু হয়। এভাবে দীর্ঘ এক মাসের রোজা মানুষের পেপটিক আলসার রোগ নিরাময় করতে সাহায্য করে। অনিয়মিত খাবার, অত্যধিক চা পান, ধূমপান, দুঃশ্চিন্তা ও টেনশন পেপটিক আলসার সৃষ্টি করে। নিয়মিত রোজা পালনের কারণেই পেপটিক আলসার থেকে মানুষের মুক্তি পাওয়া সম্ভব। নিয়মিত পেট খালি রাখলে এবং নিয়মিত আহার করলে পেটে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যাতে আলসার বা ক্ষত শুকাতে সহায়ক হয়।
ডাক্তার ক্লীভ তার পেপটিক আলসার নামক গবেষণামূলক পুস্তকে লিখেছেন- ভারত, জাপান, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ নাইজেরিয়াতে অন্যসব এলাকার তুলনায় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পেপটিক আলসার রোগের প্রকোপ অনেক কম। কেননা তারা সিয়াম পালন করে থাকেন। তাই তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘সিয়াম কোন রোগ সৃষ্টি করে না’।
১৯৫৮-১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ডাক্তার মুহাম্মদ গোলাম মুয়ায্যমসহ কয়েকজন ডাক্তার ঢাকা ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজে রোজার বিভিন্ন দিক নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেন। এ গবেষণায় দেখা যায় যে, শতকরা প্রায় ৮০ জন রোজাদারের বেলায় গ্যাস্ট্রিক এসিড স্বাভাবিক পাওয়া গেছে। শতকরা প্রায় ৩৬ জনের অস্বাভাবিক এসিডিটি স্বাভাবিক হয়েছে। প্রায় শতকরা ১২ জন রোজা পালনকারীর এসিড একটু বেড়েছে, তবে কারো ক্ষতিকর পর্যায়ে যায়নি। সুতরাং রোজায় পেপটিক আলসার হতে পারে এমন ধারণা ভুল ও মিথ্যা।
বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডাক্তার আলেক্স হেইগ বলেছেন, ‘সিয়াম হতে মানুষের মানষিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়, স্মরণ শক্তি বাড়ে, মনোযোগ ও যুক্তি শক্তি পরিবর্ধিত হয়, প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। ঘ্রানশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি বেড়ে যায়। রোজা খাদ্যে অরুচি ও অনিহা দূর করে। সিয়াম শরীরের রক্তের প্রধান পরিশোধক। রক্তের পরিশোধন এবং বিশুদ্ধি সাধন দ্বারা দেহ প্রকৃতপক্ষে জীবনশক্তি লাভ করে। যারা রুগ্ন তাদেরকেও রোজা পালন করা উচিত’।
ইউরোপের ঘরে ঘরে ইদানীং রোজা করার হিড়িক পড়েছে। সবার মুখে এক কথা, শরীরটাকে ভালো রাখতে চাওতো রোজা কর। এ ধরনের চেতনা সৃষ্টির পিছনে সত্তর দশকে প্রকাশিত একটি বইয়ের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বইটি হচ্ছে প্রখ্যাত জার্মান চিকিৎসাবিদ ড. হেলমুট লুটজানার-এর The Secret of Successful Fasting অর্থাৎ উপবাসের গোপন রহস্য। বইটিতে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের গঠন ও কার্যপ্রণালী বিশ্লেষণ করে নিরোগ, দীর্ঘজীবী ও কর্মক্ষম স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে বছরের কতিপয় দিন উপবাসের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ড. লুটজানারের মতে, খাবারের উপাদান থেকে সারাবছর ধরে মানুষের শরীরে জমে থাকা কতিপয় বিষাক্ত পদার্থ (টকসিন), চর্বি ও আবর্জনা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র সহজ ও স্বাভাবিক উপায় হচ্ছে উপবাস। উপবাসের ফলে শরীরের অভ্যন্তরে দহনের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে শরীরের ভিতর জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থসমূহ দগ্ধীভূত হয়ে যায়। আর আরবি ‘রামাদান’ শব্দটি ‘রমদ’ ধাতু থেকে উৎপত্তি যার অর্থ দহন করা, জ্বালিয়ে দেয়া ও পুড়িয়ে ফেলা। এভাবে ধ্বংস না হলে, ঐসব বিষাক্ত পদার্থ শরীরের রক্তচাপ, একজিমা, অন্ত্র ও পেটের পীড়া ইত্যাদি বিভিন্ন রোগব্যাধির জন্ম দেয়।
রোজা পালনের ফলে মানুষের শরীরে কোন ক্ষতি হয় না বরং অনেক কল্যাণ সাধিত হয়, তার বিবরণ কায়রো থেকে প্রকাশিত Science Calls for Fasting গ্রন্থে পাওয়া যায়। ড. ডিউই বলেছেন, ‘রোগজীর্ণ এবং রোগক্লিষ্ট মানুষটির পাকস্থলী হতে খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে ফেল, দেখবে রুগ্ন মানুষটি উপবাস থাকছে না, বরং সত্যিকাররূপে উপবাস থাকছে রোগটি।’
পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন, The power and endurance of
the body under fasting conditions are remarkable: After a fast properly taken
the body is literally born afresh. অর্থাৎ রোজা রাখা অবস্থায় শরীরের ক্ষমতা ও সহ্যশক্তি উল্লেখযোগ্য: সঠিকভাবে রোজা পালনের পর শরীর প্রকৃতপক্ষে নতুন সজীবতা লাভ করে।
রোজা একই সাথে দেহে রোগ প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। রোজা পালনের ফলে দেহে রোগ জীবাণুবর্ধক জীর্ণ অন্ত্রগুলো ধ্বংস হয়, ইউরিক এসিড বাধাপ্রাপ্ত হয়। দেহে ইউরিক এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন প্রকার নার্ভ সংক্রান্ত রোগ বেড়ে যায়। রোজাদারের শরীরের পানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে চর্মরোগ বৃদ্ধি পায় না।
আধুনিক যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোজার ব্যবহারিক তাৎপর্য উপলব্ধি করেই জার্মান, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ব্যবস্থাপত্রে রোজার কথা বলা হয়।
ডা. জুয়েলস এমডি বলেছেন, ‘যখনই একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকে, তখনই দেহ সেই মুহূর্তটিকে রোগমুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে।’ ডা. এ, এম গ্রিমী বলেন, ‘রোজার সামগ্রিক প্রভাব মানব স্বাস্থ্যের উপর অটুটভাবে প্রতিফলিত হয়ে থাকে এবং রোজার মাধ্যমে শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে।’
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড নারায়াড বলেন, ‘রোজা মনস্থাত্তি¡ক ও মস্তিষ্ক রোগ নির্মূল করে দেয়। মানবদেহের আবর্তন-বিবর্তন আছে। কিন্তু রোজাদার ব্যক্তির শরীর বারংবার বাহ্যিক চাপ গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। রোজাদার ব্যক্তি দৈহিক খিচুনী এবং মানসিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয় না।’
ডা. আর, ক্যাম ফোর্ডের মতে, ‘রোজা হচ্ছে পরিপাক শক্তির শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।’
ডা. বেন কিম তাঁর এক প্রবন্ধে বেশ কিছু রোগের ক্ষেত্রে উপবাসকে চিকিৎসা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ (হাঁপানী), দীর্ঘদিনের মাথাব্যথা, অন্ত্রনালীর প্রদাহ, ক্ষতিকর নয় এমন টিউমার ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে তিনি বলেন, উপবাসকালে শরীরের যেসব অংশে প্রদাহজনিত ঘা হয়েছে তা পূরণ এবং সুগঠিত হতে পর্যাপ্ত সময় পেয়ে থাকে। বিশেষত খাদ্যনালী পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাওয়াতে তার গায়ে ক্ষয়ে যাওয়া টিস্যু পুনরায় তৈরি হতে পারে।
প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. জন ফারম্যান এক প্রবন্ধে সুস্বাস্থ্য রক্ষায় উপবাস এবং খাবার গ্রহণের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে উপবাসের স্বপক্ষে মত দিয়েছেন।
বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম বলেছেন, ‘রোজা মানুষের দেহে কোন ক্ষতি করে না। ইসলামে এমন কোন বিধান নেই, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। গ্যাস্ট্রিক ও আলসারের রোগীদের রোজা নিয়ে যে ভীতি আছে তা ঠিক নয়। কারণ রোজায় এসব রোগীর কোন ক্ষতি হয় না বরং উপকার হয়। রমযান মানুষকে সংযমী ও নিয়মবদ্ধভাবে গড়ে তুলে। ১৯৫৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডা. গোলাম মুয়াযযম সাহেবের নেতৃত্বে ‘মানব শরীরের উপর রোজার প্রভাব’ সম্পর্কে যে গবেষণা চালানো হয়, তাতে প্রমাণিত হয় যে, রোজার দ্বারা মানব শরীরের কোন ক্ষতি হয় না। কেবল ওজন সামান্য কমে। ১৯৬০ সালে তার গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে, যারা মনে করে রোজা দ্বারা পেটের শূলবেদনা বেড়ে যায়, তাদের এ ধারণা নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক। কারণ উপবাসে পাকস্থলীর এসিড কমে এবং খেলেই এটা বাড়ে। এ অতি সত্য কথাটা অনেক চিকিৎসকই চিন্তা না করে শূলবেদনার রোগীকে রোজা রাখতে নিষেধ করেন। ১৭ জন রোজাদারের পেটের রস পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, যাদের পাকস্থলীতে এসিড খুব বেশি বা খুব কম রোজার ফলে তাদের এ উভয় দোষই নিরাময় হয়েছে। ১১ জন রোজাদারের হৃদপিন্ড অত্যাধুনিক ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম যন্ত্রের সাহায্যে (রোজার পূর্বে ও রোজা রাখার ২৫ দিন পর) পরীক্ষা করে দেখা গেছে রোজা দ্বারা তাদের হৃদপিন্ডের ক্রিয়ার কোনই ব্যতিক্রম ঘটে নাই।’
ডা. আব্রহাম জে হেনরী বলেছেন: রোজা হলো পরমহিত সাধনকারী ওষুধ বিশেষ।
ডা. এফ. এম গ্রিমী বলেন: রোজার সামগ্রিক প্রভাব মানব স্বাস্থ্যের ওপর অনড়, অটল, অটুটভাবে প্রতিফলিত হয়ে থাকে এবং রোজার মাধ্যমে কেবল শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর ক্লান্তিই দূর করে না, বরং দেখা গেছে যে, এগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
ডা. আর ক্যামফার্ড বলেন, রোজা হচ্ছে পরিপাক শক্তির শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী কিংবা পরিপাক শক্তির অন্তরঙ্গ বন্ধু।
ডা. লিউ ফার্ট বলেছেন: দেহের জন্য রোজা একটা অত্যন্ত হিতকর টনিক। রোজাদাররা বেশ কয়েকটি রোগ থেকে মুক্ত থাকেন।
ডা. লইস ডি ফ্রন্ট বলেছেন, ‘রোজা পালনে মানবদেহে যথেষ্ট পুষ্ট এবং বলিষ্ঠ হয়ে থাকে। মুসলমানরা নিশ্চয় রোজার মাসকে সুস্বাস্থ্যের মাস হিসাবে গণ্য করে থাকেন।’
ডা. ফারাদেই আজিজি এবং ডা. শিয়াকোলা ডায়াবেটিস রোগীদের উপর এক বিশেষ জরিপ চালান। সেখানে কিছু রোগীকে রোজা রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয় এবং কিছু রোগীকে অনুৎসাহিত করা হয়। তিনি তার ওয়েব সাইটে তার রোগীদের জন্য বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন।
১৯৯৪ সালে মরোক্কোর ক্যাসাব্লঙ্কায় আন্তর্জাতিক কন্ফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে সারাবিশ্ব থেকে বহু মুসলিম ও নন-মুসলিম মেডিক্যাল রিসার্চারগণ উপস্থিত হন। সেখানে ৫০টি রিসার্চ পেপার উপস্থাপন করা হয়। আর রমজানে রোজার এই বেনিফিটগুলোকে সমর্থন করা হয়।
জর্ডানের আম্মান ইউনিভারসিটি হসপিটালের ডা. সোলেমন ১৯৮৪ সালে রমজানের পুরু একমাস ১৫-৬৪ বছর বয়সের ৪২ জন পুরুষ এবং ১৬-২৮ বছর বয়সের ২৬ জন মহিলার মধ্যে পরীক্ষামূলক গবেষণা চালিয়ে এই উপকারিতাগুলোর প্রমাণ পান। সৌদি মেডিক্যাল জার্নালে একদল রিসার্চার ২০০৩ সালে গবেষণা করে এই উপকারিতার সত্যতা প্রমাণ করেছেন। মনগড়া যুক্তি দিয়ে অবান্তর কথায় মেডিক্যাল রিসার্চে প্রমাণিত নয় বলে মানুষকে রোজার উপকারিতা থেকে দূরে রাখা জ্ঞানীর কাজ নয়।
অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে রোজাদার নয় যে কারোর সমস্যা হতে পারে। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ ইসলাম ধর্ম বা বিজ্ঞান কোনটাই সমর্থন করে না। রমজানে অতি মুনাফালোভীরা খাদ্য সামগ্রী দীর্ঘক্ষণ মচমচা রাখার জন্য গাড়ির পোড়া মবিল পোড়া তেলের সঙ্গে ব্যবহার করে। এগুলো খেয়ে কেউ অসুস্থ হলে রোজাকে দায়ী করা বুদ্ধিমান চিকিৎসকের কাজ নয়?
গাইনী, শিশু, কিডনি, মেডিসিন, লিভার ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন: পোড়া তেল ও পোড়া মবিল সংমিশ্রণে তৈরি সিঙ্গারা, সমুচা, জিলাপী, বেগুনি, পুরিসহ নানা খাদ্যসামগ্রী খেলে ক্যান্সার, কিডনী ও লিভারসহ মরণব্যাধি হবেই এবং মায়ের পেটের বাচ্চা বিকলাঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই সমস্যাটি আমাদের সামাজিক ও নাগরিক সমস্যা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতার কারণে, রোজার কারণে নয়।
ইসলামে রোজা রাখার ব্যাপারে, কোথাও অতি ভোজনের উল্লেখ নাই। সব সময় পরিমিত ও পুষ্টিকর খাবারের কথা বলা হয়েছে। হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেছেন, পেটের তিনভাগের একভাগ খাবার, একভাগ পানীয় দিয়ে পূরণ করতে। অপর ভাগ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখতে বলেছেন। আর বর্তমান মেডিক্যাল সাইন্সও সেই কথাই বলে। রমজানে সারাদিন অভুক্ত থেকে কেউ কেউ অতিরিক্ত এবং বাজে খাবার খেয়ে ক্ষেত্র বিশেষে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর এই সুযোগটিই কাজে লাগান কিছু মানুষরূপী জ্ঞানপাপী শয়তান। আর একে কেন্দ্র করে রোজার ক্ষতিকারক দিকগুলো প্রচার করে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়। রমজান এলেই অনেক ক্ষেত্রে খাবারগুলো আমাদের দেশে তৈরি হয়, সেগুলো মোটেই স্বাস্থ্য সম্মত নয়। আর অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে যে কেউ অসুস্থ হবে সেটাই স্বাভাবিক। ঐ খাবারগুলো যদি রমজান মাস বাদে অন্য কোন মাসে খাওয়া হয় তাহলে ঐ ব্যক্তি অসুস্থ্ হয়।
এ আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, রোজা ফ্যাট বা কোলেস্টেরল কমায়, এজিং প্রসেস ব্যাহত করে। শরীরের ডিটক্সিফিকেশন করে ও ইম্যুনিটি বৃদ্ধি করে, হজমতন্ত্রের এসিড নিঃসরণ কমায়, কিডনি স্টোন হওয়ার ঝুঁকি কমায়, নন ইনসুলিন ডিপেন্ডেন্ট ডায়াবেটিস কমায়, হার্ট আর্টারি প্রেশার এবং লিভার আর্টারি প্রেশার কমায়। রোজা রোগ প্রতিরোধ ও সুস্থ থাকার অন্যতম উপায়।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন