রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

রাজনীতি, জোট ও নির্বাচন

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ৭ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

 

আমার অবসর জীবনের বয়স বাইশ বছরের অধিক। আমি পত্রিকায় কলাম লিখি প্রায় একুশ বছর ধরে। এই একুশ বছরে, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত কলামগুলোর মধ্য থেকে নির্বাচিত গুরুত্বপূর্ণ কলামগুলোর ৭টি সংকলন পাঁচজন ভিন্ন প্রকাশক গত পনেরো বছরে প্রকাশ করেছেন। অপরপক্ষে মোটামুটিভাবে মৌলিক বিষয়ে আমার নিজের লেখা বইয়ের সংখ্যাও ৭টি। এই মোট ১৪টি বইয়ের মধ্যে ১১তম বইয়ের নাম ‘মিশ্রকথন’; প্রকাশক অনন্যা। এই মিশ্র কথনের সর্বশেষ তিনটি অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ আছে, আমি কেন রাজনীতিতে প্রবেশ করলাম, আমি কেন দল করলাম এবং আমার মোটামুটি রাজনৈতিক দর্শন কী? আমি একজন ক্ষুদ্র ব্যক্তি, একটি ছোট দলের চেয়ারম্যান; অতএব, আমার চিন্তাভাবনা আরেকজনকে জানতেই হবে এমন কথা অবান্তর। কিন্তু যদি কোনো ব্যক্তির মনে আগ্রহ থাকে, সেজন্যই কথাটি বলে রাখা। বাংলাদেশের অনলাইন বইবিক্রেতাদের কাছ থেকেও এই বইটি পাওয়া যাবে এবং ই-বুক হিসেবেও পড়া যাবে। রাজনীতিতে প্রবেশ তথা সূর্যোদয় তথা আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ। প্রতিষ্ঠালগ্নেই দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র প্রকাশ বা উপস্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তী আট-নয় মাস আমি সারাদেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় সফর করেছিলাম দলের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্ত ও বিস্তৃত করার জন্য। আট-নয় মাসে, ২৭ হাজার কিলোমিটারের বেশি সফর করেছিলাম নিজের গাড়ি নিয়ে, সবসময় কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে। অতঃপর নির্বাচন কমিশনের কাছে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিলাম। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমরা নিবন্ধন পাই; নিবন্ধন নম্বর ০৩১ এবং দলীয় মার্কা হাত-ঘড়ি। এই মার্কা নিয়ে আমরা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি, ৩৬টি আসনে প্রার্থী দিয়ে। সব আসনেই আমাদের দলের প্রার্থীরা পরাজিত হন। পরাজিত হবো, এটা নির্বাচনে যাওয়ার আগেই আমরা আঁচ করেছিলাম; তারপরেও খুশি মনে নির্বাচনে গিয়েছিলাম। নির্বাচনে যাওয়ার জন্য, আমাদের দল পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না; তথাপি আমরা নির্বাচনে গিয়েছি। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ ছিল। কারণটি হলো, অভিজ্ঞতা অর্জন। নির্বাচন হলো, রাজনীতির প্রাণের স্পন্দনের মতো। নির্বাচনবিহীন রাজনীতি মৃতপ্রায় নদীর পানির মতো। এখন ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে আমরা আবারো একটি পার্লামেন্ট নির্বাচনের মুখোমুখি। সমাগত পার্লামেন্ট নির্বাচনে ২০ দলীয় জোট বা বিএনপি বা বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি অংশগ্রহণ করবে কি করবে না, সেটার উত্তর এক কথায় বা এক বাক্যে দেওয়ার উপযুক্ত সময় এখন না, বা উপযুক্ত স্থান আজকের এই কলামটি নয়।

২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের মিটিং মাঝেমধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়; কোনো কোনো সময় দুই-তিন সপ্তাহ পর পর, কোনো কোনো সময় দুই-তিন মাস পর পর, কোনো কোনো সময়ের এইরূপ মাঝামাঝি গ্যাপে। ঈদুল ফিতর হয়েছে ১৬ জুন ২০১৮ তারিখে। ঈদের পর ষষ্ঠদিনে ২২ জুন তারিখে, সকাল ১১টায় বিএনপির চেয়ারপার্সন কার্যালয়ে শীর্ষ নেতাদের বৈঠক ছিল; এই বৈঠকটির উপস্থিতি বেশি উজ্জ্বল ছিল না। উজ্জ্বল না থাকার কারণ, সম্ভবত ঈদের ছুটি ও ঈদ-পরবর্তী আধা-সামাজিক, আধা-রাজনৈতিক ব্যস্ততা। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওইদিন (২২ জুন ২০১৮) উপস্থিত থাকতে পারিনি কারণ আমি আমার নির্বাচনী এলাকা (চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলা)-তে ছিলাম। ওইদিন উপস্থিতি যেমন অনুজ্জ্বল ছিল, আলোচনার উপসংহারগুলোও অসমাপ্ত ছিল। এইদিন আলোচিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জন্য ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী নির্বাচন বা প্রার্থী মনোনয়ন। ২২ জুন তারিখে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ২০ দলীয় শীর্ষ নেতাদের আগামী বা পরবর্তী বৈঠকে এটা স্থির করা হবে। এই প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ জোটের মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনার জন্য বিগত ২৭ জুন তারিখে বিকালবেলা সোয়া চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সময়টিতে, ঢাকা মহানগরের গুলশানে অবস্থিত বিএনপির চেয়ারপার্সন কার্যালয়ে, এইরূপ একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিতি উজ্জ্বল ছিল, আলোচনা প্রাণবন্ত ছিল, উপসংহার সুসংগঠিত ও সুসংহত ছিল। এই মিটিংটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল; অন্তত আমার কাছে মনে হয়েছে। কারণ এমন কিছু কিছু বিষয় এই মিটিংয়ে আলোচিত হয়েছে যেগুলো সচরাচর হয় না।
তিনটি সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন হবে, এমন ঘোষণা নির্বাচন কমিশন দিয়েছে বেশ কয়েকদিন আগেই। অতএব প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল খুবই স্বাভাবিকভাবে, মেয়র প্রার্থী বেছে নেওয়ার কাজটি সময়মতো শুরু করে দেয়। আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে যাবো না। বিএনপি, নিজস্ব প্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত প্রক্রিয়ায় কাজটি শুরু করে। বরিশাল এবং রাজশাহীর মেয়র প্রার্থী বেছে নেওয়ার পরই নামগুলো ঘোষণা করে দেয়। কিন্তু সিলেটের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি, কারণ প্রার্থী বেছে নেওয়ার কাজটি সময় নিচ্ছিল; এইরূপ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজে সময় লাগাটাও স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে ২৬ জুন ২০১৮ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়; নির্বাচনের গুণাগুণ নিয়ে এই কলামের পাঠককে নতুন করে আমার পক্ষ থেকে কিছু বলার নেই। যা বলবো তা পুরানো কথা। নতুন কথা হলো, ভোট কেন্দ্র দখল, অবৈধ ভোট প্রদান, পোলিং এজেন্টকে বিতাড়িত করা ইত্যাদি কাজের কিছু নতুন ধারা বা নমুনা ২৬ তারিখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কূট-কৌশলের সৌজন্যে। সিলেটের মেয়র প্রসঙ্গে আসি। গাজীপুর নির্বাচনের পরের দিন ২৭ তারিখ মোটামুটি দুপুরবেলার দিকে, বিএনপির পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সম্মেলন বা প্রেস ব্রিফিং করা হয় এবং সেখানে বিএনপির পক্ষ থেকে সিলেটের মেয়র প্রার্থী হিসেবে আরিফুল হকের নাম ঘোষণা করা হয়। কলামের ঠিক এ পর্যায়ে, আমার পক্ষ থেকে জনাব আরিফুল হককে অভিনন্দন, কারণ উনার দল উনাকে বেছে নিয়েছেন এবং আমার মতে তিনি একজন সংগ্রামী জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন। ২৭ তারিখের বিএনপির একই প্রেস ব্রিফিংয়ে গাজীপুর নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করা হয়, নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতাসমূহ তুলে ধরা হয়; এগুলো আমাদের এবং আমারও মনের কথা। একই প্রেক্ষাপটে এটাও ঘোষণা করা হয় যে, বিএনপি আগামীতে অনুষ্ঠিতব্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করবে। এই প্রেক্ষাপটেই ২৭ জুন তারিখ বিকালবেলা সোয়া চারটার পর ২০ দলীয় জোটের মিটিংয়ে আলোচনাটি ওঠে। আলোচনার গুরুত্বের দুইটি আঙ্গিক আছে। প্রথম আঙ্গিক এই যে, একইদিনে কয়েক ঘণ্টা পূর্বে বিএনপির প্রেস ব্রিফিংয়ে দিয়ে দেওয়া ঘোষণাগুলো ২০ দলীয় জোটের মিটিংয়ের পরে দিলে ভালো হতো এবং রাজনৈতিক-কৌশলগতভাবে মর্যাদাপূর্ণ হতো। দ্বিতীয় আঙ্গিকটি হচ্ছে আলোচনার পর, উপস্থিত ২০ দলীয় নেতৃবর্গ, তিনটি সিটি কর্পোরেশনের জন্য বিএনপি কর্তৃক মনোনীত মেয়র প্রার্থীদের অনুকূলে সর্বসম্মত সমর্থন প্রকাশ করেন। তবে একটি নোট এখানে রাখতেই হয়; ২৭ জুন তারিখ বিকালবেলার ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের এই গুরুত্বপূর্ণ মিটিংটিতে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি শুরুর দিকে ৫ মিনিট মাত্র উপস্থিত ছিলেন; সভাপতির অনুমতি নিয়ে বা সভাপতিকে অবগত করেই, জরুরি কাজের প্রয়োজনে তিনি অব্যাহতি নেন; অতএব সর্বসম্মত সিদ্ধান্তটি হয়েছে জামায়াতের প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে। তবে সর্বসম্মতভাবে আশা প্রকাশ করা হয় যে, বিএনপির উচ্চতম পর্যায়ের সঙ্গে জামায়াতের উচ্চতম পর্যায়ের আলোচনার মাধ্যমে সিলেটের মেয়র প্রার্থী নিয়ে উভয় দলের মধ্যকার বিদ্যমান মতপার্থক্য নিরসন করা হবে বা করা সম্ভব হবে।
যদিও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের ২৭ জুন তারিখের বৈঠকের দু’চার ঘণ্টা আগেই জাতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছিল যে, বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করবে, তথাপি শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের এডভান্টেজ ও ডিসএডভান্টেজগুলো তথা অংশগ্রহণের পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তিগুলো তথা অংশগ্রহণের রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধাগুলো আলোচিত হয়। ওই আলোচনায় অংশগ্রহণকারীগণ বিশ্বাস করেননি বা আশাও করেননি যে, ২৭ জুন তারিখ বিকালবেলার আলোচনার মাধ্যমে ২৭ জুন তারিখ সকালবেলার সিদ্ধান্ত রদবদল করা হবে। ২৭ তারিখ বিকালবেলায় আলোচনায় অংশগ্রহণকারীগণ এটুকু আশা করেছেন যে, বিষয়টা সম্পর্কে যেন একটা স্বচ্ছ ধারণা উপস্থাপিত হবে। এবার একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এখানেই তুলে ধরবো। আলোচনার এক পর্যায়ে, একটি কথা বলা হয়। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে যেমন প্রার্থী ছিল, তেমনই জামায়াতের পক্ষ থেকেও প্রার্থী ছিল। অনেক আলাপ-আলোচনার পর, মোটামুটি উদ্বেগপূর্ণ সময় পার করার পর, জামায়াতের প্রার্থী তাঁর প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছিলেন, বিএনপি প্রার্থীর অনুকূলে। ২৭ জুন তারিখে বিকালবেলা ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে একাধিক নেতা এই কথাটি আলোচনায় আনেন এইরূপভাবে: মনোয়নপত্র দাখিলের আগেই জোটের মধ্যে সিদ্ধান্ত হওয়া প্রয়োজন; এটা সম্ভব না হলে জোটের ভেতরে এবং জোটের ভোটার ও শুভাকাক্সক্ষীগণের মধ্যে একটা উদ্বেগ ও দ্যেদুল্যমানতা কাজ করে। অর্থাৎ গাজীপুরের মতো পরিস্থিতি যেন সিলেট বা রাজশাহী বা বরিশালে না হয়, এটাই ছিল আলোচকদের কামনা। ঠিক এই সূত্র ধরেই, একাধিক আলোচক জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গটি আনেন। পরের অনুচ্ছেদে কথাটি ব্যাখ্যা করছি।
গাজীপুর নির্বাচনের শুরুতে যেমন জোটের মূল শরীকের প্রার্থী এবং জোটের অন্যতম শরীক জামায়াতের ইসলামীর প্রার্থীকে নিয়ে দ্ব›দ্ব বা ডায়লেমা বা সংকট ছিল, ওইরূপ সংকট বা ডায়লেমা বা দ্ব›দ্ব যেন জাতীয় নির্বাচনে, বিভিন্ন নির্বাচনী আসনে না হয়, তার জন্য কী করা যায়, এই আলোচনা শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে উঠে আসে। আলোচকগণ বলেন, সময় থাকতেই এই বিষয়ে ২০ দলীয় জোটে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নিতে পারলে ভলো। আলোচকগণ বলেন, মাননীয় দেশনেত্রীর মুক্তির জন্য আন্দোলনই হলো প্রথম অগ্রাধিকার, কিন্তু যুগপৎ অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া চালু থাকতেই পারে। এই কথার পিঠে বা এই কথার সূত্র ধরেই আরও মজার কথা উঠে আসে। মজার কথা না বলে, গুরুত্বপূর্ণ কথাও বলা যায়। সেই মজার কথা বা গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হলো, বিএনপি বা ২০ দলীয় জোট আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা, করা উচিত কিনা। যদি অংশগ্রহণ করে, তাহলেই মাত্র জোটের একাধিক দলের একাধিক প্রার্থীর মধ্যে সংকট বা ডায়লেমা ফুটে উঠতে পারে। যদি অংশগ্রহণ না করে, তাহলে এই সংকট বা এই ডায়লেমা প্রসঙ্গটি অবান্তর। সম্মানিত পাঠক, আপনি নিজেকে নিজে, বিগত জুন মাসের ২৭ তারিখ বিকালবেলা নিয়ে যান, নিজে মনে করুন ২০ দলীয় জোটের একজন অন্যতম শীর্ষ নেতা আপনি এবং আপনি আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন অথবা আলোচনা শ্রবণ করছেন। কলামের শুরুতেই বলেছিলাম, ২৭ জুন ২০১৮ তারিখের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তথা ব্যতিক্রমীভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি দুইটি শব্দ ব্যবহার করেছি, ব্যতিক্রমী এবং গুরুত্বপূর্ণ। ব্যতিক্রমী এই জন্য যে, কয়েকজন আলোচক এবং সেই আলোচকগণের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে, আলোচনা সভার সভাপতি তথা বিএনপির সম্মানিত সংগ্রামী মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০১৪ সালের আগে-পরের জাতীয় পর্যায়ের ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কিঞ্চিত ব্যাখ্যা করেন এবং বর্তমান (২০১৮) জাতীয় পর্যায়ের ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেন। একাধিক আলোচক আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে আলোচনা করেন এবং সেই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি মহাসচিব মহোদয় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। এরকম কিঞ্চিত আত্মসমালোচনামূলক, কিঞ্চিত ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে সচারচর হয়নি। আরও একটি কারণে ব্যতিক্রমী শব্দটি ব্যবহার করেছি; ওই বিকালবেলার সভায় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা নির্ধারিত ছিল না। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আলোচনা করতে গিয়ে জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গটি আসে; এবং আসায় ভালো হয়েছে, আসায় লাভ হয়েছে, আসার কারণে অদূর ভবিষ্যতে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের শুভাকাক্সক্ষীগণ গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা পাবেন বলে আমার মনে হয়েছে। এই কলামে তথা আজকে আমি এর বেশি ব্যাখ্যা দেওয়াটা উপযুক্ত মনে করছি না; অদূর ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ আলোচনা করবো। ২৭ জুন বিকালবেলার ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের আলোচনার প্রসঙ্গে কেউ যেন মনে না করেন যে, শুধুই নির্বাচনে যাওয়া বা না যাওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কম হোক বেশি হোক, সরকারের বাইরে বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা জোটগুলোর সঙ্গে বিএনপির বা ২০ দলীয় জোটের একাত্মতার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়াকে জেলখানা থেকে মুক্ত করার জন্য আইনী লড়াইয়ের বাইরে বা আইনী লড়াইয়ের অতিরিক্ত, রাজপথের আন্দোলন সম্বন্ধেও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ২০ দলীয় জোটের বাইরের সম্ভাব্য রাজনৈতিক মিত্র বা দেশনেত্রীর মুক্তির আন্দোলন নিয়ে এখানে আজকে আর কিছু লিখছি না।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই কোনো কোনো সময় তথা স্থান-কাল-পাত্র মোতাবেক, নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। ঢালাও কোনো নীতিমালা প্রযোজ্য নয়। এই অনুচ্ছেদের আলোচনা এইরূপ উভয় দিকের। নির্বাচনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা পেতে হলে, অপেক্ষা করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা মানে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ডিসেম্বর ২০০৮ সালের নির্বাচনে যদি অংশ না নিতাম, তাহলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরবর্তী সুযোগ হতো ২০১৩ সালের শেষে অথবা ২০১৪ সালের শুরুতে। বাস্তবে ওই নির্বাচনটি ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়। ২০ দলীয় জোট, জোটগতভাবেই ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষমতাসীন অঙ্গন থেকে, যথেষ্ট প্রত্যক্ষ এবং কৌশলগত আহবান পাওয়া সত্তে¡ও, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিসহ কয়েকটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, ২০ দলীয় জোটের প্রতি আনুগত্যে অবিচল থেকেছিল। এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এরা অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু, ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতাম, প্রস্তুতি নেই এই অজুহাতে- তাহলে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির জন্য কথাটা দাঁড়াত এ রকম যে, এই দলটি সাড়ে আট বছরে কোনোদিন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হয়নি। লোকে বলত, এরা কাগজে-কলমে দল, মাঠে ময়দানের দল নয়; নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সাথে সুপরিচিত থাকার কারণে, আমি বা আমার দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা নির্বাচন প্রসঙ্গে কোনো আলোচনায় হাওয়ার ওপরে মন্তব্য করিনি। চাপাবাজি করতে হয় না, বাস্তবসম্মত গঠনমূলক কথা বলতে পারি এবং সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারি। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সাথে সুপরিচিত থাকার কারণে, গত তিন-চার বছরে যত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যথা: সিটি করপোরেশন নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সবগুলিতেই আমরা গঠনমূলকভাবে সম্পৃক্ত থাকতে পেরেছি। সেজন্য আমার একটা শিক্ষা হলো, গঠনমূলক অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সুযোগ আসা মাত্রই সে সুযোগ গ্রহণ করা উচিত। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই সুযোগ বারবার আসে না।
একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে, মানসিকভাবে আমি উদ্বিগ্ন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এবং আংশিকভাবে হতাশও। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের এক জায়গায় বলেছেন, ‘লা তাকনাতু মির-রাহমাতিল্লাহ’ অর্থাৎ ‘তোমরা আমার রহমত থেকে নিরাশ হইও না’। আমার চিন্তা জগতের গভীরে, আমার মনের নিভৃতে টিম টিম করে একটি আশা, একটি সম্ভাবনার কথা এখনো প্রজ্বলিত। আমি এখনো অনুভব করি যে, কোনো না কোনো দিন, আল্লাহ তায়ালা বাংলাদেশিদের প্রতি এবং বাংলাদেশের প্রতি দয়া করবেন। এ প্রসঙ্গে, দয়ার অনেকগুলো মানে হতে পারে; একটি মানে হলো সৎ, মেধাবী, সাহসী ও দেশপ্রেমিক মানুষ রাজনীতির মাধ্যমে দেশসেবার সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশে এখন মেধাবী, সাহসী ও দেশপ্রেমিক মানুষরা রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হতে মোটেই আগ্রহী নন। বিভিন্ন নিয়মে, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়, বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে, রাজনীতি নামক পেশা বা কর্মযজ্ঞকে এমন দূষিত, পঙ্কিল, দুর্গন্ধময় এবং দেশের জন্য এমন অনুৎপাদনশীল করে ফেলা হয়েছে যে, সৎ বা দুর্নীতিবিরোধী, মেধাবী ও দক্ষ এবং সাহসী ব্যক্তিরা রাজনীতিকে ঘৃণা করেন। দুর্নীতিবাজরা রাজনীতির মাধ্যমে, উন্নয়ন কর্মকাÐের ছদ্মবেশে, ব্যবসার ছদ্মবেশে অথবা চাকরির ছদ্মবেশে অথবা ছদ্মবেশ ছাড়াই বাংলাদেশকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। মাদকের ছোবলে, চোরাকারবারিদের কষাঘাতে এবং অপসংস্কৃতির তুফানে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা, সামাজিক নৈতিকতা এবং সৎ কর্মের মূল্যবোধ এখন ত্যাজ্য বিষয় হয়ে গেছে। বাংলাদেশ শাসনকারী বর্তমান সরকার এই প্রক্রিয়ায় যুগপৎ অংশীদার ও অনুঘটক। গত ৪৭ বছরের বিভিন্ন সরকার বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য দায়ী তথা অবদান রেখেছেন এটা যেমন নিরেট সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে, এই বহুমুখী অবনতি প্রক্রিয়ায় বর্তমান সরকার এসব নেতিবাচক বিষয়কে শীর্ষে নিয়ে গেছে। বর্তমান সরকারের আমলে ক্রমান্বয়ে বাজেটের আকার যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, যেমন মেগা প্রজেক্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, যেমন জিডিপি উন্নত হয়েছে, তেমনই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিকে অবনতিও হয়েছে অতি লক্ষণীয়। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া প্রয়োজন। মহান আল্লাহ তায়ালা দয়া করলে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার কারণে এই পরিবেশ ও পরিস্থিতি বদল হতেও পারে, এটাই মনের ভেতরে আশা। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে, আমি রাজনীতিকেই পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছি। আমি সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিদের প্রতি আহবান ও আবেদন রাখছি, রাজনীতিতে যদি গুণগত পরিবর্তন চান, তাহলে রাজনীতি মনষ্ক হোন, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল করাটা ফরজ নয়; নফল হতে পারে। আগামী এক-দুই সপ্তাহের মধ্যেই জোটের রাজনীতি বা নির্বাচনমুখী রাজনীতি নিয়ে ইনশাআল্লাহ লিখবো।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
নাসির ৭ জুলাই, ২০১৮, ৪:০৫ এএম says : 0
এখনই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
Total Reply(1)
নাসরিন ৭ জুলাই, ২০১৮, ৪:০৬ এএম says : 4
একদম ঠিক কথা বলেছেন। আরও দেরি করলে ঐক্যবদ্ধ হয়েও কোন লাভ হবে না।
সাইফ ৭ জুলাই, ২০১৮, ৪:০৭ এএম says : 1
কোনো না কোনো দিন, আল্লাহ তায়ালা বাংলাদেশিদের প্রতি এবং বাংলাদেশের প্রতি দয়া করবেন।
Total Reply(0)
Md Sumon Hoshen ৭ জুলাই, ২০১৮, ৩:২৫ পিএম says : 0
আজও আমি বাতাশে সাধারন ছাত্র ছাত্রি দের ওপর নিজ্জাতন ও হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে হার বাংগার সব্দ পাই মনে হচ্চে আমার দেশে আমি নিজেই রহিংগা
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন