(পূর্বে প্রকাশিতের পর) যখন হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে আসছিল তখন মক্কার কোরায়শরা ওই চুক্তির মেয়াদ পুনঃ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আবূ সুফিয়ানকে নির্বাচিত করে পাঠালেন। আবূ সুফিয়ান কোরায়শদের দূত হিসাবে পবিত্র মদীনা নগরীতে পৌঁছলেন এবং নিজ কন্যা উম্মে হাবীবা (রা) এর গৃহে উপস্থিত হলেন। একটি চৌকির ওপর মহানবী (স) এর বরকতপূর্ণ বিছানা বিছানো ছিল। আবূ সুফিয়ান যখনই তার ওপর বসতে চাইলেন তখনই হযরত উম্মে হাবীবা (রা) বিছানাটি সরিয়ে ফেলে নিজ পিতাকে খালি চৌকির দিকে ঈঙ্গিত করে বললেন, আব্বাজান বসুন! আবূ সুফিয়ান পরিস্থিতি সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেননি, তাই মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ বিছানা কি আমার বসার যোগ্য নয়, না কি আমি তার ওপর বসার যোগ্য নই ? উম্মে হাবীবা (রা) বললেন, আব্বাজান ! এটা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (স) এর বিছানা! আবূ সুফিয়ান বললেন, তাতে কি হয়েছে, সে তোমার স্বামী আর আমি তো তোমার পিতা। মুমিন জননী উত্তর দিলেন, তাতো ঠিক বটে ; কিন্তু আপনি তো এখনও মুশরিক অবস্থায় আছেন অথচ প্রিয়নবী (স) এর বিছানাটি পবিত্র। যে-কারণে আমার মনে সায় দিচ্ছে না যে, আপনার অপবিত্র দেহ আমার মনিব (স) এর বিচানায় লাগুক। এ ঘটনা থেকে অনুমান করা যায় যে, নবীপ্রেম ও নবীর ভালোবাসা কাকে বলে ?
উদাহরণ-৬ মসজিদে নববীতে খোৎবাদানের জন্য কাঠের একটি মিম্বর বানানো হয়েছিল ; যার তিনটি সিঁড়ি ছিল। মহানবী (স) যখন খোৎবা দিতে দাঁড়াতেন তখন সবচেয়ে ওপরের সিঁড়িতে বসে মধ্যের সিঁড়িতে পা মুবারক রাখতেন । হযরত আবূ বকর (রা) যখন খলীফা নিযুক্ত হলেন তখন খোৎবাদানের জন্য মধ্যের সিঁড়িতে বসতেন এবং নিচের সিঁড়িতে পা রাখতেন । হযরত উমর ফারূক (রা) খলীফা নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি খোৎবাদানের জন্য একেবারে নিচের সিঁড়িতে বসতেন এবং মেঝেতে পা রাখতেন। হযরত উসমান গনী (রা) এর সময় যখন এল তখন তিনি মিম্বর এর সিঁড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি করে দিলেন এবং খোৎবাদানকালে তিনি নতুন বৃদ্ধিকৃত অংশের প্রথম সিঁড়িতে দাঁড়াতেন। খোলাফায়ে রাশেদার উক্ত কর্মপন্থা অবশ্যই আদব প্রশ্নে উম্মতের জন্য দলিল হিসাবে গণ্য।
উদাহরণ-৭ ইন্তেকালের পূর্বে যখন মহানবী (স) এর রোগযন্ত্রণা বেড়ে গেল তখন তিনি নির্দেশ দিলেন যে, “আবূ বকর সিদ্দীক (রা) মসজিদে লোকজনকে নিয়ে নামাযের ইমামতি করবেন।” যে কারণে মহানবী (স) এর জীবদ্দশায় হযরত আবূ বকর (রা) এর (১৭) সতের ওয়াক্ত নামায পড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে। ওফাত শরীফের দু’দিন পূর্বে যোহরের নামাযে হযরত আবূ বকর (রা) ইমামতি করছিলেন , এমতাবস্থায় কঠিন রোগাক্রান্ত হওয়া সত্তে¡ও মহানবী (স) হযরত আলী (রা) ও হযরত আব্বাস (রা) এর কাঁধে ভর দিয়ে মসজিদে জামাতে শরীক হতে উপস্থিত হলেন। হযরত আবূ বকর (রা) যখন বিষয়টি আঁচ করতে পারলেন যে, সাইয়্যেদুল মুরসালীন (স) তাশরীফ এনেছেন তখন তিনি নামাযের ভেতরেই ইমামতের মুসাল্লা হতে পিছনে সরে আসতে উদ্দত হলেন। মহানবী (স) হাতের ইশারায় তাঁকে সরে আসতে নিষেধ করলেন। অতপর মহানবী (স) হযরত আবূ বকরের পাশে বসে নামায পড়তে শুরু করলেন। হযরত আবূ বকর (রা) মহানবী (স) এর ইক্তেদা করে এবং অন্য সকল সাহাবী হযরত আবূ বকরের ইক্তেদা করে -এভাবে ওই নামায সম্পাদিত হলো। নামায শেষে হুযূর (স) হযরত আবূ বকরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি নামাযের মধ্যে পিছনে সরে এলেন কেন ?” তিনি উত্তরে বললেন: “আবূ কুহাফার পুত্রের পক্ষে এটা শোভনীয় নয় যে, মহানবী (স) এর সামনে নামায পড়বে”! হযরত আবূ বকর (রা) নিজ কর্মের দ্বারা এটি প্রমাণ করে দিলেন যে, সাহাবাগণ- “ তোমরা আল্লাহ্ ও রাসূলের সামনে কোনো বিষয়ে অগ্রণী হয়ো না”- মহান আল্লাহর উক্ত নির্দেশকে কত নির্দি¦ধায় কার্যত আমল করে দেখিয়েছিলেন।
উদাহরণ-৮ একদা হযরত ফাদীলাহ ইবন উবায়দ আসলামী (রা) ও হযরত ইবন ওরা‘ (রা) পরস্পর তীর প্রশিক্ষণ প্রতিযোগিতায় রত ছিলেন। কোন কারণে মহানবী (স) ওই স্থান অতিক্রম করেন। হুযুর (স) হযরত ফাদীলা (রা)-কে বললেন, “হে ইসমাঈল-বংশধর! তুমি তীর প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাও! তোমাদের পিতাও ভালো তীরশিকারী ছিলেন। তুমি তীর চালাতে থাকো, আমি কিন্তু ইবনে ওরা‘ এর পক্ষে আছি।” -এ বাক্য শুনেই হযরত ফাদীলা তীর-ধনুক রেখে দিলেন এবং আরজ করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল (স)! আপনি যদি ইবনে ওরা‘ এর সঙ্গে থাকেন তাহলে আদবের দাবী মোতাবেক আমি তীর প্রতিযোগিতায় আর তীর নিক্ষেপ করতে পারি না। অর্থাৎ প্রতিযোগিতা তো অবস্থানগত সমান পর্যায়ে হতে পারে। আমার পক্ষে কিভাবে শোভনীয় হতে পারে যে,আমি আপনার সমান্তরালে দাঁড়াবো, হোক তা তীর নিক্ষেপ প্রশ্নেই।”(বোখারী শরীফ)
উদাহরণ-৯ হযরত হুযায়ফা (রা) বলেন, আমরা যখন হুযুর (স) এর সঙ্গে দস্তরখানে উপস্থিত থাকতাম তখন ওই সময় পর্যন্ত খাবারে হাত লাগাতাম না যে পর্যন্ত মহানবী (স) শুরু না করতেন। যেহেতু মনিবের উপস্থিতিতে একজন দাসের কোন কাজে প্রথমে কিছু করতে যাওয়া বে-আদবী মনে করা হয় সে-কারণে সাহাবাকিরাম (রা) খাবার গ্রহণেও প্রথমে শুরু করতেন না।
উদাহরণ-১০ হযরত আবূ মাহযূরা (রা) এর মাথার সম্মুখভাগের কেশগুচ্ছ এ পরিমাণ লম্বা ছিল যে, যখন তিনি মাটিতে বসে চুল মেলাতেন তখন তা মাটি স্পর্শ করতো। একবার কেউ তাঁকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি চুলগুলো কেটে ফেলছেন না কেন ? তিনি জবাবে বললেন, আমার এ স্থলের চুলগুলো একবার মহানবী (স) সস্নেহে হাত দ্বারা ধরেছিলেন। তারপর থেকে এগুলো কাটা আমি পরিহার করে যাচ্ছি! এক্ষেত্রেও চরম আদব ও প্রেমাবেগ লক্ষ্যণীয়। একজন সাধারণ মানুষ ভাসা-ভাসা দৃষ্টিতে তাকালে তার কাছে বিষয়টি সাধারণ কিছু বলেই প্রতিভাত হবে ; কিন্তু আদব ও সম্মানবোধ বিষয়টির সংজ্ঞা-সীমায় অনেক প্রশস্ততা বিদ্যমান। যে- কারণে প্রতিটি মানুষই তার ভাগ্যগুণে আদব-সভ্যতার অংশীদার হয়ে থাকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন