উদাহরণ-১১: মহানবী (স) যখন হিজরত করে মদীনা শরীফে গেলেন তখন তিনি হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী (রা) এর বাড়ীতে অবস্থান করলেন। ওই বাড়ীটি দ্বিতলবিশিষ্ট ছিল। হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী (রা) নিজ পরিবার-পরিজন নিয়ে ওপর তলাতে থাকলেন এবং প্রিয়নবী (স) নিচ তলাতে অবস্থান করছিলেন। হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী (রা) রাতের বেলায় ঘুমের ঘোরে ডুবে ছিলেন হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গার পর মনে জাগলো, মহানবী (স) নিচে অবস্থান করছেন আর আমি ওপরে ! এটা তো স্পষ্ট বে-আদবী হয়ে যাচ্ছে! এ অবস্থাতেই অর্ধ-রাতের কালে বিছানা থেকে পৃথক হয়ে কক্ষের দেয়ালের সঙ্গে টেক লাগিয়ে ভোর হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর মহানবী (স) এর কাছে এসে শত-সহস্রবার অনুনয়-বিনয় করে হুযুর (স)-কে ওপর তলায় অবস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজে নিচ তলাতে পরিবার-পরিজনসহ থাকতে লাগলেন।
উদাহরণ-১২: ‘দুররি মানসূর’ কিতাবের বর্ণনা হচ্ছে, একবার হযরত আবূহুরায়রা (রা) এর অপবিত্রতার গোসলের প্রয়োজন দেখা দিল। ওই অবস্থায় হুযুর (স) সেখানে উপস্থিত হলেন। হযরত আবূহুরায়রা (রা) দ্রূত কোথাও লুকিয়ে গেলেন। তারপর গোসল সেরে হুযুর (স) এর সামনে উপস্থিত হলেন। নবীজী (স) জিজ্ঞাসা করলেন , তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে ? তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (স)! আমার গোসলের প্রয়োজন হয়েছিল। সেই অপবিত্র অবস্থায় আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আমার কাছে বে-আদবী মনে হয়েছিল। এখন আমি পাক-পবিত্র হয়ে আপনার খেদমতে উপস্থিত হয়েছি। তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে , একবার হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা) এর সঙ্গে মহানবী (স) মোসাফাহা করতে চেয়েছিলেন , তখন তিনি তাঁর গোসলের প্রয়োজনের কথা ওযর হিসাবে পেশ করলেন।
উক্তসব বর্ণনা থেকে বোঝা যাছে যে, সাহাবাকিরাম (রা) অপবিত্র অবস্থায় মহানবী (স) এর পবিত্র শরীর এর সঙ্গে নিজেদের হাত মেলানোতেও বে-আদবী মনে করতেন।
উদাহরণ-১৩: সাহাবাকিরাম (রা) যখনই মহানবী (স) এর মাহফিলে বসতেন আদবের প্রতি লক্ষ করে নিজেদের মুখমন্ডল নিচু করে রাখতেন। হযরত আনাস ইবন মালেক (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম (স) যখনই আনসার ও মুহাজির সাহাবাদের মাঝে উপবিষ্ট থাকতেন তখন হযরত আবূবকর (রা) ও হযরত উমর (রা) ব্যতীত কেউই নিজ দৃষ্টি উর্ধমুখী করতেন না। আবূ বকর (রা) ও উমর (রা) এর সঙ্গে হুযুর (স) এর সর্ম্পক ছিল বিশেষ-ব্যতিক্রম। প্রিয়নবী (স) তাঁদের প্রতি তাকিয়ে মুচকি হাসতেন এবং তাঁরাও মহানবী (স) এর চেহারা মুবারকের প্রতি তাকিয়ে মুচকি হাসতেন। অনেকটা প্রেম ও ভালোবাসার আন্তরিক আবেগ যেন মুচকি হাসির মাধ্যমে প্রকাশ পেত।
উদাহরণ-১৪: তিরমিযী শরীফে বর্ণিত একটি হাদীসে হযরত আলী (রা) মহানবী (স) এর মজলিসের চিত্র এঁকেছেন এভাবে-
“যখন মহানবী (স) কথা বলা শুরু করতেন তখন তাঁর সাহাবাগণ এমনিভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে নিতেন , যেমন কিনা তাঁদের মাথার ওপর পাখী বসে আছে। যখন হুযুর (স) চুপ হয়ে যেতেন তখন উপস্থিতগণের মধ্য থেকে (প্রয়োজনে) কোন একজন কথা বলতেন। আলোচনার মধ্যখানে কেউ মহানবী (স) এর সঙ্গে কথা বলতেন না।”
পৃথিবীর বড় বড় ক্ষমতাসীনদের অনুষ্ঠানেও তেমন আদব প্রদর্শনের উদাহরণ অনেক বিরল। কেননা আদবের সর্ম্পক হচ্ছে আন্তরিক আস্থা ও প্রেমের সঙ্গে। দুনিয়াদারদের সেই আন্তরিকতা ও সৌভাগ্য জুটবে কোত্থেকে ?
উদাহরণ-১৫: সাইয়্যেদেনা আবূ বকর সিদ্দীক (রা) এর সম্মানীত পিতা হযরত আবূ কুহাফা (রা) তখনও মুসলমান হননি। একবার তিনি হুযুর (স) এর ব্যাপারে সামান্য অশোভনীয় বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন। হযরত আবূ বকর (রা) সেই অশোভনীয় বাক্য শুনে অনেক রাগান্বিত হলেন ; এমনকি নিজ পিতার মুখে চপেটাঘাত করে বসলেন! তিনি মহানবী (স) এর কাছে পুত্রের বিরুদ্ধে নালিশ করলেন। তখন হুযুর (স) আসল বিষয়টি বোঝার জন্য আবু বকর (রা)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কেন এমনটি করলেন ? তিনি উত্তরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (স)! তখন আমার হাতে তরবারী ছিল না ; নতুবা আমি এমন অশোভনীয় উক্তির দরুন তাঁর গর্দান উড়িয়ে দিতাম! তাৎক্ষণিক জিবরাঈল (আ) এ আয়াতটি নিয়ে অবতীর্ণ হয়ে গেলেন-
“আপনি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায়কে পাবেন না, যারা ভালোবাসে তাদেরকে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, হোক না এ বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা,পুত্র, ভাই অথবা এদের জ্ঞাতি-গোত্র। এদের অন্তরে আল্লাহ লিখে দিয়েছেন ঈমান এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে রূহ (নূর/কুরআন) দ্বারা। আর তিনি তাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত ; সেখানে তারা স্থায়ী হবে ; আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম।” (সূরা : আল-মুজাদালাহ্-২২)
উদাহরণ-১৬: একদা হযরত আবূ বকর (রা) মহানবী (স) এর অন্দর মহলে প্রবেশ করে নিজ কন্যা আয়েশা (রা) -কে প্রিয়নবী (স) এর চেয়ে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখলেন। হযরত আবূ বকর (রা) এর নিজ কন্যার নবীজী (স) এর দরবারে এমন বে-আদবীপূর্ণ আচরণ দেখে মারাত্মক ক্রোধের সঞ্চার হয়েছে। যে-কারণে তিনি অনেক জোরে তাঁকে একটি চড় মেরেছেন যে, হযরত আয়েশা (রা) নবীজীর (স) আড়ালে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
উদাহরণ-১৭: একবার মুনাফিকরা হযরত আয়েশা (রা) এর বিরুদ্ধে অপবাদ দিল। হযরত রাসূল (স) হযরত আবূ বকর (রা) এর গৃহে তাশরীফ নিলেন এবং হযরত আয়েশা (রা)-কে সম্বোধন করে বললেন, তুমি যদি এ অপবাদ প্রশ্নে নির্দোষ হয়ে থাক তাহলে মহান আল্লাহ তোমার পবিত্রতার ঘোষণা প্রদান করবেন। আর যদি তোমার কোন পদস্খলন হয়ে থাকে তাহলে তুমি আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তেগফার করতে থাক। কেননা বান্দা যখন তাওবা করে নেয় তখন তার সকল পাপ ধুয়ে-মুছে যায়। প্রিয়নবীর (স) এ নির্দেশ শুনে হযরত আয়েশা (রা) নিজ পিতাকে বললেন, আপনি আমার পক্ষ থেকে নবীজীকে জবাব দিয়ে দিন। হযরত আবূ বকর (রা) এর যদিও নিজ কন্যার পত্রিতা প্রশ্নে দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে ; তারপরও নবীজীর আদবের বিবেচনায় তিনি মুখ খুলতে সাহস পেলেন না। শুধু এটুকু বললেন, “আমি বুঝে উঠতে পারছি না, কি বলবো”।
উদাহরণ-১৮: হযরত আবূ হুরায়রা (রা) কতৃক বর্ণিত, মহানবী (স) আমাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতেন , তারপর তিনি যখন দাঁড়াতেন , আমরা আদব হিসাবে দাঁড়িয়ে যেতাম। (নাসাঈ, আবূ-দাঊদ)
উদাহরণ-১৯: ইমাম বুখারী (র) নিজ গ্রন্থ ‘ আদবুল মুফরাদ’-এ উদ্বৃত করছেন, একবার দু’জন লোক মহানবী (স) এর খেদমতে উপস্থিত হলেন এবং নবীজী (স)-কে ‘নবুওত’ বিষয়টির বাহ্যিক নিদর্শন সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। মহানবী (স) যখন নিদর্শনগুলো বলে দিলেন তখন তারা আদব ও মহব্বত প্রকাশার্থে নবীজী (স) এর দু’হাত ও দু’পায়ে চুমু খেল এবং বললো : “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল্।”
উদাহরণ-২০: হযরত যুরা‘(রা) বর্ণনা করেন যে, আব্দুল-কায়েছ গোত্রের প্রতিনিধি দল যখন মদীনায় এল তখন তারা দ্রুত নিজ নিজ বাহনের আসন থেকে নেমে মহানবী (স) এর বরকতপূর্ণ হাত ও পায়ে চুমু খেতে লাগলো। (আহমদ ও আবূদাঊদ)
উদাহরণ-২১: হযরত ইবন উমর (রা) একবার মসজিদে নববীতে আসলেন এবং মহানবী (স) মিম্বরের যে-স্থানটিতে বসতেন , তা হাত দ্বারা স্পর্শ করে বরকতস্বরূপ সেই হাতকে নিজ মুখমন্ডলে মুছে নিলেন। (শিফা ও তাবাকাতে ইবন স‘াদ)
উদাহরণ-২২: হযরত উমর ফারূক (রা) স্বীয় খেলাফত আমলে রাষ্টীয় কোষাগার থেকে কোন কোন সাহাবীর দৈনন্দিনকার ভাতা নির্ধারণ করতে গিয়ে নিজ পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমরের জন্য তিন হাজার দিরহাম বাৎসরিক ভাতা ধার্য করলেন এবং হযরত উসামা ইবন যায়েদ (রা) এর জন্য নির্ধারণ করলেন তিন হাজার পাঁচশত দিরহাম। হযরত আব্দুল্লাহ নিবেদন করলেন, আপনি উসামা ইবন যায়েদ এর ভাতা আমার চেয়ে অধিক ধার্য করলেন কেন? তিনি জবাব দিলেন, তাঁর পিতা তোমার পিতার চেয়ে এবং তিনি নিজেও তোমার চেয়ে মহানবী (স) এর কাছে অধিক প্রিয় ছিলেন। আমি আমার প্রিয়জনের চেয়ে মহানবীর প্রিয়জনকে অগ্রাধিকার দিয়েছি! নবীপ্রেম ও নবীর প্রতি আদবের কত উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নবী-প্রেমিক সাহাবীগণ রেখে গেছেন! সুবহানাল্লাহ!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন