শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

উন্নয়নের প্রধান শর্ত দারিদ্র্য দূর করা

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

বিশ্বায়নের যুগে মানুষের, বিশেষ করে অনুন্নত দেশের গরিব মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে বলতেই হয়, দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণায় বোধহয় নতুন করে ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। মানুষের চাহিদা মনস্তাত্তিক অবস্থার সঙ্গে যে সম্পর্কিত তা অস্বীকার করার উপায় নেই। চাহিদার মনস্তাত্তি্ আলোচনার আগে উন্নয়ন কী হচ্ছে তা আগে দেখে নেওয়া যাক। উন্নয়নের প্রধান শর্ত নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।
দেশজুড়ে উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়ন না-হলে মানুষ এত আধুনিক হচ্ছেই বা কী করে? শিক্ষা-সংস্কৃতি-রোজগার সবই উন্নয়নের মুখ দেখছে। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ হচ্ছে। প্রতিযোগিতায় লাফিয়ে লাফিয়ে মানুষ ছুটছে। কারো পিছন পানে ফিরে তাকাবার সময় নেই। ব্যস্ততা বাড়ছে। কারো সাথে যে দু-এক দণ্ড বসে বা দাঁড়িয়ে কথা বলবে সে সময়ও মানুষ পাচ্ছে না। এই একবিংশ শতাব্দীতে উপনীত হয়ে উন্নয়নের পরিধি যেন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মাটির রাস্তায় পিচ পড়ছে, পিচ ভাঙলে আবার পিচ হচ্ছে, শপিং মল হচ্ছে, রাস্তায় রাস্তায় ইন্টারনেট, সাইবার ক্যাফে, যোগাযোগের জন্য হাতে-হাতে মোবাইল। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার হাতে মোবাইল। মোবাইল চালু রাখতে কার্ড ক্রয় করার অসুবিধার জন্য কেউ পিছিয়ে যাচ্ছে না। উন্নয়ন তাড়া করছে। এক কথায় উন্নয়নের বাজার গরম। দ্রব্যমূল্য যতই বৃদ্ধি পাক, কোনো দ্রব্যই পড়ে থাকছে না ক্রেতার অভাবে। পেটে ভাত নেই অথচ হাতে মোবাইল কেন? এ কথা বলার সাহস কারো নেই। কারো সাহস নেই ছেলে-মেয়েদের বলতে, হেঁটে চলতে পারো না, বাবা? মোটর সাইকেল আর নানাজাতের কারে কোণঠাসা রাস্তাঘাট। বলতে পারবে না, কারণ উন্নয়ন হচ্ছে।
এ কথা নিশ্চয়ই বলতে হবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নয়ন ঘটছে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও হচ্ছে জোরদার। এতক্ষণ উন্নয়নের কথা বললাম। এত কিছু সাফল্যের পরও বলতে হয়, এ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সব নাগরিকের সমস্যা দূর করে সুখের স্বর্গে পৌঁছে দিয়েছে তা কিন্তু নয়। দারিদ্র্য দূর করতে পারেনি। সত্যিকার দারিদ্র্যে পীড়িত মানুষের সংখ্যা কত তা এখনো জানা যায়নি। তবে অবাক করার কথা শোনা যায়- এখনো কিছু কিছু অঞ্চলের অধিবাসীরা শাক-পাতা সিদ্ধ করে খেয়ে জীবন বাঁচায়। পানীয়জল নেই। ডোবা-নালা-খালের পানি খেয়ে রোগাক্রান্ত হয়। নেই স্বাস্থ্য সেবা, বিদ্যুৎ, শৌচাগার, রাস্তা। শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে। অপুষ্ট মাতৃজাতির সংখ্যা অসংখ্য। বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট দেখা গেল, তাতে উল্লেখ আছে, গরিবদের মধ্যে খাদ্য গ্রহণের হার কমেছে। পুষ্টিকর সুষম খাদ্য না খাওয়ায় ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের সংখ্যা পঞ্চাশ শতাংশ। এটা কিন্তু আমার কথা নয়। সরকার ও বিশেষজ্ঞ মহলের কথা।
আগে বলেছিলাম উন্নয়নের প্রথম শর্ত কী তা নিয়ে আলোচনা করার। উন্নয়নের প্রধান শর্ত হল, দারিদ্র্য দূর করা। দারিদ্র্য নির্মূল না হোক, অন্তত যারা দরিদ্র্যসীমার নিচে আছে তাদের কিছু উপরে টেনে তোলা। বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট থেকে বোঝা গেল পুষ্টিকর খাবারদাবারের একটা বিষয় রয়ে গেছে। সুতরাং পুষ্টি সংক্রান্ত প্রয়োজনের কথা মনে রাখা দরকার। আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য যা প্রয়োজন সেটা আগে ভাবা দরকার। পুষ্টির মাপকাটি বিচার করলে এদেশে দারিদ্র্যের হার কত শতাংশ হতে পারে, তা পাঠকই অনুমান করে নিতে পারেন।
মানুষের চাহিদা সর্ম্পকিত মানসিকতার অর্থাৎ মনস্তাত্তিক অবস্থার সঙ্গে উন্নয়ন ও দারিদ্র্যের সম্পর্ক কী তা নিয়ে যদি আলোচনা করি, তাহলে বলতে হয় হাতে হাতে মোবাইল, মোটর সাইকেল, টিভি ইত্যাদি থাকলেই যে সেই ব্যক্তি বা পরিবার দারিদ্র্য জর্জরিত নয় তা কিন্তু নয়। মনস্তাত্তিক বিচারে বা দারিদ্রেজর্জরিত মানুষের যে ভোগবাসনা চরিতার্থ করার ইচ্ছা জাগবে না তা বলাও উচিত নয়। মানসিক চাহিদা পুষ্টি সংক্রান্ত প্রয়োজনের কথা মাথায় না রেখেই চলে। সুতরাং, সত্যিকারের দারিদ্র্য মাপা বড় কঠিন আজ। আর এ কথাও সত্য, যারা খুব দরিদ্র, তাদের পুষ্টির সমস্যা দেখা দেয় ক্রয়ক্ষমতার অভাবে। তাই বলে দরিদ্র মানুুষজন না খেয়ে-দেয়ে লোক দেখানো অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনে, এটা বলা ঠিক নয়। বরং বলা যায়, যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্ব উন্নয়ন, সেই উন্নয়নের প্রক্রিয়া বড় রকমের প্রভাব ফেলেছে মানুষজনের মানসিকতার উপর। যারা সচ্ছল তারা আরো একটু স্বাচ্ছন্দ্য পেলেই সেই সচ্ছলদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। গরিব মানুষ একটু স্বাচ্ছন্দ্য পেলেই সেই ভোগান্মাদনায় মেতে উঠছে। খাদ্যে ক্যালরি বৃদ্ধি হোক বা না হোক, মোটর সাইকেল, গাড়ি, সেল ফোন ইত্যাদি ভোগ করার মানসিকতা কে ছাড়ে। কোন কোন সচ্ছল পরিবারের কর্তাকে বলতে শোনা যায়, গাড়ি-বাড়ি-ছেলে-মেয়ের পড়াশুনার বিষয়ে প্রচুর টাকা খরচ করে ঋণগ্রস্ত। ব্যাংকের ঋণ দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। গাড়ির চাবি হাতে তুলে দিতে গাড়ি সরবরাহকারী উদগ্রীব হয়ে আছে। মোবাইল ফোনে খুব পরিচিত একটি ছেলে বলল, বড় ভাই যে কোনো একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিন, অসুবিধায় আছি। পারিবারিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। মা-বাবা দুজনের শারীরিক অবস্থা খারাপ। ডাক্তারের ভিজিট-ওষুধের যা দাম, কী যে করব বুঝতে পারছি না। বললাম, ‘দেখি কী করা যায়। তবে তোমাকে জানাব কী করে?’ কেন, আমার মোবাইলে ফোন করে নেবেন। জানলাম তার কাজের প্রয়োজন এবং একটি মোবাইল ফোনও আছে। এটা হতে পারে সে না-খেয়ে আছে, এই অবস্থায় তার নিজস্ব মোবাইল ফোন থাকাটা ঠিক নয় বলাটাও যুক্তিসঙ্গত নয়।
গ্রামের বাড়িতে দেখতাম আশপাশের অত্যন্ত গরিব ঘরের ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা টিভিতে সিনেমা দেখতে এসে ভিড় করত। হয়তো পেটে কিছু পড়েনি। নিতান্ত গরিব। খেলেও দেহপুষ্টির অনুপাতে কিছু পড়ে না পেটে। তাই বলে কি বলা যাবে তাদের টিভিতে সিনেমা বা সিরিয়াল দেখা ঠিক নয়?
মনস্তাত্বিক বিচারে প্রতিটি বিষয়ে প্রভাব থাকে। বিষয়ের প্রভাব কখনো বিচার করে না কার ক্ষমতা কতটুকু। বিশেষ করে আধুনিক কালচারের বিস্তার ঘটাচ্ছে টিভি। সেই কালচার ধনী-দরিদ্রের সামাজিক অবস্থান মেপে সম্প্রসারণ হয় না। স্বাধীনতা সংগ্রামে নিহত জহির রায়হানের কোন ছবি দেখে সাধারণ কিংবা নিতান্ত দরিদ্র মানুষ তাদের জীবন যাত্রাকে খাপ খাওয়াতে পারে বটে, তাদের জীবন ব্যর্থ এই ধারণা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে বটে, কিন্তু বর্তমান কালের সব পরিচালক তো আর জহির রায়হান নন, ভোগ-বিলাস, সুখ-ঐশ্বর্য জীবনের বাড়তি উপাদান ছেড়ে সত্যিকার জীবন নিয়ে ছবি করবেন। এখন প্রশ্ন হল, যে সব গরিব ছেলে-মেয়ে টিভিতে সিনেমা ও সিরিয়াল দেখছে তাদের জীবন যাত্রার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কি আমোদ উপভোগ হচ্ছে? বর্তমানে বেশির ভাগ ছবি বা সিরিয়াল ধনী মানুষের উপভোগের বিষয়। টিভির স্ক্রিনে চোখ রাখা ছেলে-মেয়েগুলো বাড়িতে গিয়ে যখন ঘর-আসবাবপত্র ও খাওয়া-দাওয়ার বিষয়গুলো মিলাতে পারবে না তখন মানসিক অবস্থা কী হবে? তাই বলে ওদের বঞ্চিত করে রাখা কি ঠিক? যে বাড়িতে বসে তারা টিভি দেখছে, বাড়ির মালিক তো তাদের ডেকে আনেননি। তাদের আমোদ-প্রমোদের চাহিদাই তাদের টেনে আনে। বিশ্বায়নের প্রভাব তাদের মধ্যে কীভাবে পড়ল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যুগবার্তা কেউ কানে কানে ঘোষণা করে না। যুগবার্তা আপনাতেই পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে। এই প্রভাবেই মানুষ ঘর থেকে বাইরে, বাইরে থেকে বহু বাইরে বিস্তার লাভ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
কথা হচ্ছিল দারিদ্র্য কীভাবে দূর করা যায়? উন্নয়নের প্রধান শর্ত যে দারিদ্র্য দূর করা, তাও বলা হয়েছে। ক্রয় ক্ষমতা না-থাকলেই দরিদ্র যদি বলা হয়, তাহলে সেই ক্রয় ক্ষমতা কোন কোন বিষয়ের উপর ন্যস্ত তা-তো বলা হয়নি। আমরা ধরে নেই দৈনন্দিন জীবনযাপনে ন্যূনতম যেসব বস্তু অত্যন্ত জরুরি, সেগুলো ক্রয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে যে পারে সে দরিদ্র নয়। ন্যূনতম কী কী বস্তু অতি সহজলভ্য? যদি সাদা ভাত ও ডাল বা ভাতে আলু-সিদ্ধ হয়, অবশ্য তেল-লবন-মশলা-আগুন ইত্যাদিরও প্রয়োজন আছে, তাহলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে গরিবের ন্যূনতম বস্তু ক্রয় করার ক্ষমতা কতটুকু তা কে বিচার করবে? অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দেবার মালিক সরকার। গরিবদের এই ন্যূনতম পাঁচটি বিষয়ের ওপর সরকার নজর দিয়ে গরিবি দূর করবে। ন্যায্যমূল্যে অন্ন অর্থাৎ চাল দেবে সরকার। শুধু চাল খাবে কি গরিব মানুষ? পরিধানের বস্ত্র কে দেবে? হয়তো বাসস্থানের ব্যবস্থা হল। চাল ও বাসস্থান পেলেই গরিবি দূর হয়ে যাবে- তাও তো নয়। ক্রয় ক্ষমতা থাকতেই হবে। সেই কারণেই প্রত্যেকের প্রয়োজন অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জন। কী করে আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন করা যায় সেদিকে আগে নজর দিতে হবে। ন্যায্যমূল্যে চাল আর বাসস্থান দিলেই যে দেশ থেকে গরিবি চলে যাবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। তা ছাড়া, ওই সব বণ্টন ব্যবস্থায় চলে দুর্নীতি। এই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ের মরহুম ভাইস চ্যান্সেলর ওসমান গণীর মনস্তাত্বিক একটি কথা মনে পড়ে, কাউকে সাহায্য করলে দেখতে হবে সে সেই সাহায্যের দ্বারা নিজেকে স্বাবলম্বী করার দিকে মনোযোগী কি না। তা না-হলে সেই সাহায্য ব্যর্থ। দিনের পর দিন সাহায্য করে যাবো, অথচ সেই লোকটি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে না, সাহায্যের আশায় বসে থাকবে- এভাবে পরনির্ভরতা সমস্যার সমাধান হয় না।
এই বিশ্বায়নের যুগে এ গরিব দেশের মানুষের শ্রেণিবিন্যাসে মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত মানুষের প্রাচীন অবস্থা আর নেই। এখন এ দেশের নাগরিকরা হতদরিদ্র-দরিদ্র-উচ্চবিত্ত ও অতি উচ্চবিত্ত এই চার শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়েছে। মধ্যবিত্তের এক অংশ দরিদ্র অপর অংশ উচ্চবিত্তে পরিণত হয়ে গেছে। বিদেশের মতো গাড়ি, বাড়ি, ‘টিভি চ্যানেল, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাক-আশাক, মাল্টিপ্লেক্স ইত্যাদির চাহিদা বাড়ায় কে দরিদ্র আর কে ধনী নয় এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশ্বায়নের প্রভাব ফেলেছে মানুষের মানসিকতায়। এখানে বলা যায় মানুষ কী চায়, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই তার পারিপার্শ্বিক সমাজ দিয়ে নির্ধারিত হয়। এই পারিপার্শ্বিক সহজাত বদলাচ্ছে। বিশ্বায়নের প্রচারমাধ্যম টেলিভিশন যুগে গোটা বিশ্ব এখন মানুষের ঘরের দরজায়।
এখন হতদরিদ্রদের দরিদ্রের কোঠায় টেনে তোলাই প্রধান কাজ। তাই সরকারি প্রকল্পের বাস্তবতা এবং কর্মক্রমের মাধ্যমে আর্থিক উন্নতি ঘটাতে সুদৃষ্টি রাখতে হবে। দরিদ্রদের দারিদ্র্য দূরীকরণে নির্ধারিত কাজ ও বছরে সরকারি সমবায়ের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য বণ্টন করে তাদের শারীরিক পুষ্টি বাড়াতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যক্তিস্বার্থপূর্ণ চেতনা ব্যক্তির চারিদিকে থাকা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থনীতির গবেষণায় এটাই আসল বিষয় হওয়া উচিত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন