সরকারি আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ঢাকার বাড়ির মালিকরা ইচ্ছামতো ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে। প্রশাসনের নাকের ঢগায় এ ঘটনা ঘটছে। প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে আছে। গ্রামের সহজ সরল মানুষ গ্রামে কর্মসংস্থানের অভাব হওয়ায় বেঁচে থাকার তাগিদে রাজধানীমুখী হচ্ছে। এতে আবাসনের তুলনায় জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে নগরীতে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাড়িওয়ালারা ইচ্ছামত ভাড়া বাড়াচ্ছে। এছাড়াও পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণ দেখিয়ে বাড়িভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে এসে এ খাতে তিন হাজার ১০০ কোটি টাকার ভুর্তকি ঘোষণা করা হলেও রাজধানীতে বাড়িভাড়া বাড়নোর প্রবণতা থামেনি। প্রতি বছরের ডিসেম্বর থেকে বাড়িভাড়া বাড়ানোর প্রবণতা থাকলেও এ বছর তা আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ২৭ বছর আগে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন করা হলেও সেটি কোনো বাড়ির মালিক মানছেন না। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নতুন বছর ছাড়াও বিদ্যুৎ, গ্যাস ও নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া বাড়ানো হয়, যা ভাড়াটিয়া জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। বাড়িওয়ালাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এরপরও বাড়িভাড়া নৈরাজ্য রোধে দুই সিটি কর্পোরেশনের কোনো উদ্যোগ নেই। সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুর্বলের পক্ষে নীতিনির্ধারকরা কথা বলতে চান না। রাজধানীতে যারা ভাড়াটিয়া আছে তাদের পক্ষ নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। সিটি কর্পোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্সের আশায় কখনো ভাড়াটিয়াদের পক্ষে ন্যায় পদক্ষেপ নেয়নি। ভাড়াটিয়াদের প্রতিবাদের প্ল্যাটফর্ম না থাকায় বাড়িওয়ালারা লাগামহীনভাবে ভাড়া বৃদ্ধি করে। তাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত অসহায়ের মতো মেনে নিতে হয়। এতে চাকরির সিংহভাগের বেতন চলে যায় বাড়িওয়ালার পকেটে। এলাকা ভেদে ৫শ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়িভাড়া ইতোমধ্যে বৃদ্ধি করা হয়েছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ১৯৯০ সালে পাকা ভবনে দুই কক্ষের একটি বাসার ভাড়া ছিল ২ হাজার ৯৪২ টাকা। ২০১৫ সালে সেই ভাড়া দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫০ টাকা। ২০০৬ সাল থেকে গত ১০ বছরে ভাড়া বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এ সময় ভাড়া বেড়েছে প্রায় সাড়ে চার গুণ। ৯০ শতাংশই ভাড়াটিয়া। এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রতি বছর বাড়তি ভাড়ার বোঝা ঘাড়ে নেয়। ধানমন্ডি, বনানী এলাকার চেয়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে নতুন সংযুক্ত হওয়ায় ৩৬টি ওয়ার্ডে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগায় বাড়িওয়ালারা ভাড়া বাড়িছে দ্বিগুণেরও বেশি। বাড্ডা, উত্তরা ১১, ১২ নাম্বর সেক্টর কয়েক মাস আগেও যখন ইউনিয়নের আওতায় ছিল তখন ফ্ল্যাটের ভাড়া ৫-৬ হাজার টাকা। ডিএনসিসিতে যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে ফ্ল্যাট ভাড়া হয়েছে ১০-১২ হাজার টাকা। শুধু ডিএনসিসি এলাকায় নয়, ডিএসসিসির আওতাধীন দনিয়া, মাতুয়াইল এবং ডেমরা এলাকায় উন্নয়নকে কেন্দ্র করে আগেভাগেই বাড়িওয়ালারা বাড়িভাড়া বাড়িয়েছেন। অল্প আয়ের মানুষ কম ভাড়ার আশায় এসব এলাকায় এতোদিন বসবাস করছে; এখন তারা চরম বিপাকে পড়েছে। প্রত্যেক বছর বাজেট পাস হওয়ার সাথে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। বাড়ে বাড়ি ভাড়াও। বাড়ির ভাড়া কেমন হবে, কখন ভাড়া বাড়বে, ভাড়াটিয়াকে কখন উচ্ছেদ করা যাবে, অগ্রিম জামানত গ্রহণ, ভাড়া আদায়ের রশিদ প্রদান, লিখিত চুক্তি, বাড়ি মেরামত ও বসবাসযোগ্য কিনা- এ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো ধরনের আইনে তোয়াক্কা করেন না বাড়ির মালিকরা। অন্যদিকে, বেশিরভাগ ভাড়াটিয়া বিষয়গুলো না জানায় সব অনিয়ম মুখ বুঝে সহ্য করে। এসব কারণেই ঢাকার মানুষের কাছে বাড়িভাড়া এখন যন্ত্রণার আরেক নাম। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকা ও অবস্থানভেদে ভাড়ার হারও নির্ধারণ করে। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই হার পুননির্ধারণ করে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে জমা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কেউই তা আমলে নিচ্ছে না। এ সুযোগে বাড়িওয়ালারা বাড়তি ভাড়া আদায় করে নিচ্ছে। এক জরিপ থেকে জানা গেছে, ঢাকার ৮৩ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকে। এ হিসাবে ৮৩ শতাংশ মানুষ ১৭ শতাংশ বাড়ি মালিকের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। ঐ জরিপ সূত্রে আরও জানা যায়, সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক গুলশান এলাকার প্রতি বর্গফুট বাড়িভাড়া ১৫ থেকে ১৮ টাকা, বনানীতে ১৪ থেকে ১৬, মহাখালীতে ১১ থেকে ১২, নাখালপাড়াতে ৬ থেকে ৭, উত্তরায় ৫ থেকে ৯, শান্তিবাগে ৫ থেকে ৬ টাকা, নয়াপল্টনে ৯ টাকা, শান্তিনগরে ৮ থেকে ৯ টাকা, কল্যাণপুর-পল্লবীতে ৬ টাকা, জিগাতলায় ৮ টাকা ও ধানমন্ডিতে ১১ দশমিক ২৫ টাকা নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু বাড়ির মালিকরা ভাড়া আদায় করছে এর দ্বিগুণ থেকে তিনগুণেরও বেশি। প্রতি বছর বাড়িভাড়ার সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিও নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় ভাড়াটিয়া হিসেবে টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠেছে। দুই সিটি কর্পোরেশনের মতে, ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব তাদের না। এটা মূলত গৃহায়ণ ও গণপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কাজ। তাছাড়া এ নিয়ে সরকারের আলাদা একটা আইন তৈরি করার কথা রয়েছে। এখনো এ ব্যাপারে কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। আইনটি দ্রুত তৈরি হওয়া উচিত। অন্তত একটা নীতিমালা হলেও অনেক ভালো হয়। সিটি কর্পোরেশন যেহেতু ঢাকাবাসীর সেবা দিচ্ছে সেহেতু বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিৎ। আইনের ১৩-এর ১ ধারা অনুযায়ী, বাড়িওয়ালা ভাড়া পরিশোধের রসিদ দেবে। রসিদের একটি অংশ বাড়িওয়ালাকে সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু রসিদ দিচ্ছে কিনা, সেটি তদারক করতে নেই সরকারি কোনো সংস্থা। বাড়িভাড়া আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার এ আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তিকে কোনো এলাকার জন্য ‘নিয়ন্ত্রক’ হিসেবে নিয়োগ করতে পারবে। তিনি মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণে সহায়তা করবে। কিন্তু এলাকাভিত্তিক নিয়ন্ত্রক থাকার কথা সাধারণ মানুষ জানেই না। নগরবাসীর সুখ-দুঃখ দেখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। সেখানে বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়া দু’পক্ষের স্বার্থ দেখতে হবে। সিটির উন্নয়ন কাজে ব্যয় বেড়েছে এর সঙ্গে সমন্বয় রেখে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি পেয়েছে। হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির সঙ্গে কোনো এলাকার ভাড়া কেমন হবে সেটি নির্ধারণ করা হয়েছে। বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করা এবং কমানো এটি শুধু ডিএনসিসির একক কোনো সিদ্ধান্ত নয়। কর্পোরেশনসহ ঢাকায় যতগুলো সংস্থা রয়েছে প্রত্যেকের সমন্বয় প্রয়োজন। বাড়িভাড়াসংক্রান্ত বিষয়ে আইনের প্রয়োগ না থাকায় কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেয়া যাচ্ছে না। ক্যাবের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, প্রতিবছর ভাড়া বাড়ানোর কোনো নিয়ম না থাকলেও নতুন বছর এলেই ভাড়াটিয়াদের গড়ে অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ভাড়া। জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৮ দশমিক ৭৭, ২০১৫ সালে ৬ দশমিক ৩৩, ২০১৪ সালে ৯ দশমিক ৭৬, ২০১৩ সালে ১০ দশমিক ৯১, ২০১২ সালে ৯ দশমিক ৭৩, ২০১১ সালে ১৫ দশমিক ৮৩, ২০১০ সালে ৫ দশমিক ৯৯, ২০০৯ সালে ১৪ দশমিক ৯৬, ২০০৮ সালে ২০ দশমিক ৫৯, ২০০৭ সালে ২১ দশমিক শূন্য ২, ২০০৬ সালে ১৪ দশমিক ১৪, ২০০৫ সালে ৭ দশমিক ৮৯, ২০০৪ সালে ৯ দশমিক ৯৬, ২০০৩ সালে ৮ দশমিক ৪, ২০০২ সালে ১৩ দশমিক ৪৯, ২০০১ সালে ১৭ দশমিক ৪, ২০০০ সালে ১৫ দশমিক ৮, ১৯৯৯ সালে ১৮ দশমিক ২৪, ১৯৯৮ সালে ১৪ দশমিক শূন্য ৯, ১৯৯৭ সালে ১৫ দশমিক শূন্য ৩ ও ১৯৯৬ সালে আগের বছরের তুলনায় ১৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ বাড়িভাড়া বেড়েছে। বিষয়টির প্রতি উবর্ধতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন দেশের বিজ্ঞমহল।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন