শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

ময়মনসিংহ গীতিকার সাহিত্য মূল্য

আহমেদ উল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

যে কোন সাহিত্য আত্মপ্রকাশ করে দুটি ধারাকে কেন্দ্র করে। একটি মৌখিক ধারা, অপরটি লেখ্য ধারা। যে সাহিত্য মানুষের মুখে মুখে সৃষ্টি, মানুষের মুখে মুখেই ব্যাপ্তি এবং লোক মুখে মুখেই লোক থেকে লোকান্তরে কাল থেকে কালান্তরে প্রবাহিত হয়ে থাকে আধুনিক সংজ্ঞায় তাকেই লোকসাহিত্য বলে। লৌকিক জীবনের সাথে সম্পৃক্ত মানুষের ভাব-ভাবনা, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরন, বিশ্বাস-সংস্কার, প্রেম-ভালোবাসা এসবই লোকসাহিত্যের মূল বিষয়। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলাদেশ লোকসাহিত্যের এক সমৃদ্ধ আধার। আর এই লোক সাহিত্যের অনন্য এক দৃষ্টান্ত ময়মনসিংহ গীতিকা। যার মাধ্যমে বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে বাংলার লৌকিক জীবনের এক একটি অনন্য উপখ্যান। শাশ্বত মানবিক চেতনার গৌরব গাঁথা পড়ে সবাই বিস্মত। ময়মনসিংহ গীতিকার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বাংলার লোকসাহিত্য সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে যায় সবার। 

ময়মনসিংহ গীতিকার জন্মস্থান বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলা এবং নেত্রকোনা জেলার কিছু অংশ। ভৌগলিক মানচিত্রে প্রাচীন ময়মনসিংহ ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে বড় জেলা। যার বিস্তৃতি ছিল উত্তরে গারো পাহাড় থেকে দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর অবধি। কালে কালে ময়মনসিংহ জেলা ভেঙ্গে নতুন জেলা সৃষ্টি হয়েছে। তবে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা বলতে বর্তমান কিশোরগঞ্জ,নেত্রকোনা, জামালপুর, টাঙ্গাইল, শেরপুর, ময়মনসিংহ জেলাকেই বুঝায়। ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চল বিস্তৃত জলাভূমি দ্বারা আচ্ছন্ন। আর এই জলাভূমি হাওর নামে পরিচিত। হাওর শব্দটি সাগর শব্দটিরই পরিবর্তিত রূপ। যা তার আকার বা বিশালত্বের পরিচয় বহন করে। এই হাওর বা জলাভূমির পূর্ব দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে কংশাই, ধনু, ঘোড়াউত্রা, ফুলেশ্বরী, নরসুন্দা, সুতি নদী প্রবাহিত। হাওর বা নদ-নদী প্লাবিত বিস্তৃত নিম্নভূমি বা ভাটি অঞ্চলই ময়মনসিংহ গীতিকার জম্মভূমি। বৃহত্তর ময়মনসিংহের দুটি মহকুমা কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা হবার কারনে গীতিকাটির নাম হয় ময়মনসিংহ গীতিকা।
ময়মনসিংহ গীতিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড.দীনেশ চন্দ্র সেনের সম্পাদনায়। আর বইটি প্রকাশে সার্বিক সহযোগীতা করেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। বইটিতে মোট ১০ টি গীতিকা আছে। গীতিকা গুলি হল ১. মহুয়া, ২. মলুয়া, ৩. চন্দ্রাবতী, ৪. কমলা, ৫. দেওয়ান ভাবনা, ৬. দস্যু কেনারামের পালা, ৭. রূপবতী, ৮. কঙ্ক ও লীলা, ৯. কাজল রেখা, ১০. দেওয়ানা মদিনা।

ড. দীনেশ চন্দ্র সেন গীতিকাগুলি সংগ্রহ করান স্বশিক্ষিত এক স্বভাব কবি চন্দ্র কুমার দে’র মাধ্যমে। চন্দ্রকুমার দে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার রঘুনাথপুরের অধিবাসী ছিলেন। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন প্রথম গীতিকা গুলির সাথে পরিচিত হন কিশোরগঞ্জের আর এক কৃতি পুরুষ কেদারনাথ মজুমদারের মাধ্যমে। কেদার নাথ মজুমদার প্রথম ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’ গ্রন্থ রচনা করেন। তার বাড়ি ছিল বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার কাপাসাটিয়া গ্রামে। কেদারনাথ মজুমদার ময়মনসিংহ হতে ‘সৌরভ’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। উক্ত পত্রিকায় চন্দ্র কুমার দে’র লোক সাহিত্যের উপর কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে সৌরভ পত্রিকায় মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর উপর প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ পড়ে মুগ্ধ হন ড. দীনেশ চন্দ্র সেন। তারপর পত্রিকার সম্পাদক কেদার নাথ মজুমদার, যে তার বন্ধু ছিলেন তার মাধ্যমে চন্দ্র কুমার দে’র সাথে পরিচিত হন এবং তাকে দিয়ে অতিকষ্টে দিনের পর দিন চেষ্টা সাধনার মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গীতিকা গুলি সংগ্রহ করান।
ময়মনসিংহ গীতিকা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হবার সাথে সাথে বিদ্যত সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। গ্রামের অঁজ পাড়া গার মানুষেরা ও যে কত সুন্দর শিল্প সৃষ্টি করতে পারে প্রথমে তারা তা বুঝতেই পারেনি।
ময়মনসিংহ গীতিকা ইংরেজী ভাষায় অনূদীত হয়ে প্রকাশের পর বিদেশের সুধীবৃন্দকে প্রবল ভাবে আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে মনীষী রোমা রোলাঁ, ড. সিলভা লেভি, স্যার জর্জ গ্রীয়ারসন, উইলিয়াম রদেনস্টাইন, ফ্রান্সিস. এইচ. স্ক্রাইন, ই.এফ. ওটেন গীতিকা সম্পর্কে উচ্চসিত প্রশংসা করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থে বলেন-‘গীতিকা গুলোর সাহিত্যিক মূল্য বিদেশী সাহিত্য রসিকেরা কি দিয়াছেন, তাহা জানিলে বোধ হয় আমরা আমাদের ঘরের জিনিসকে একটু বেশি আদর করিব।’
ময়মনসিংহ গীতিকার সাহিত্য মূল্য অসীম। গীতিকাগুলি প্রধানত নায়িকা প্রধান। মহুয়া পালার নায়িকা যখন জল আনতে নদীর ঘাটে যায় তখন নায়ক নদ্যার চাঁদের সাথে ভীরু প্রণয়ীর সসঙ্কোচ আত্মনিবেদনে চিরন্তন প্রেমের পরিবেশ পাওয়া যায়। অসাধারন ব্যঙমীয় তার প্রণয়ের প্রকাশ। যেমন-
‘‘জল ভর সুন্দরী কন্যা জলে দিছ ঢেউ ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।।’’
শুধু তাই নয় মহুয়ার রূপের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ নায়ক নির্লজ্জের মত তার প্রেমের প্রকাশ করে অকাতরে। যেখানে নেই কোন আধুনিক প্রেমের ভনিতা।
‘‘কঠিন আমার মাতা-পিতা কঠিন আমার হিয়া ।
তোমার মত নারী পাইলে আমি করি বিয়া।।’’
প্রেমিকাকে নিজের করে পাবার যে বাসনা তা পূরনে প্রেমিক যে কোন অবলম্বন গ্রহণ করতে পারে।
‘‘কোথায় পাইবাম কলসী কন্যা কোথায় পাইবাম দড়ি।
তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুব্যা মরি।।’’
চিরন্তন গ্রামীন সরল পরিবেশ, অতিথি পরায়নতা, মানুষের সাথে মানুষের বন্ধনের এক অকৃত্রিম রূপ আমরা ময়মনসিংহ গীতিকায় পায়।
‘‘আমার বাড়িত যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিড়া।
জলপান করিতে দিয়াম শালি ধানের চিড়া।।
শালি ধানের চিড়া দিয়াম আর ও শবরী কলা।
ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা।।’’
ময়মনসিংহ গীতিকার অধিকাংশ গীতিকায়ই প্রণয়মুলক। এতে গ্রামীণ প্রেমের বর্ণনা অপূর্ব রূমান্টিকতায় বর্নিত। কাজল রেখা, মহুয়া, মলুয়া, লীলা, চন্দ্রাবতী প্রভৃতি গীতিকার নায়িকাদের প্রেম ও ত্যাগের গভীরতা আমাদের মর্মকে স্পর্শ করে নিবিরভাবে।
ময়মনসিংহ গীতিকার পালা গুলোর মাঝে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির অপূর্ব সম্মিলন পাওয়া যায়। যা চিরায়ত অসা¤প্রদায়িক বাঙ্গালী চেতনার পরিচয় বহন করে। বাংলার গ্রামীন মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দু:খ, প্রেম-বিরহের আখর গ্রন্থ ময়মনসিংহ গীতিকা। গ্রামের সহজ সরল যে মানুষের হাতে এত অপূর্ব সুন্দর সাহিত্য সৃষ্টি হয় সেই সকল লৌকিক কবির প্রতি হাজার সালাম।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Md Shah Alam ২০ অক্টোবর, ২০২০, ৩:১২ পিএম says : 0
অজানা ইতিহাস জানলাম। খুব ভালো লাগলো।
Total Reply(0)
md babu miah ২৯ অক্টোবর, ২০২১, ৯:২৯ এএম says : 0
very interesting ......good arrengment from mymansinho gitika
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন