শুষ্ক মৌসুম এলেই পানিশূন্য হয়ে পড়ে কুমিল্লার নদ-নদী। খাল-বিল শুকিয়ে যায় মৌসুমের আগেই। তখন লোকজন হেঁটেই নদী পার হতে পারে। গোমতী, ডাকাতিয়া, কাঁকড়ী নদী ক্রমেই নাব্য হারাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে জেগেছে বালুচর। কুমিল্লা অঞ্চলের নদীগুলোর উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নদনদীর এমন অবস্থার ফলে মানুষের জীবন-জীবিকা বদলে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। বিলীন হচ্ছে জীববৈচিত্র, কমছে মাছের উৎপাদন, ব্যাহত হচ্ছে সেচ কাজ। এমনকি গতিপথ পরিবর্তন, নাব্যতা হ্রাসসহ বিভিন্ন কারণে গত কয়েক বছর ধরে মানচিত্রও বদলে যাচ্ছে। নাব্যতা রক্ষা ও নদী খনন কর্মসূচি প্রতি বছর গ্রহণ করা হলেও বাস্তবে কোনো কাজ হয় না। অনেক ক্ষেত্রে টেন্ডার আহŸান প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নদী খনন ও নাব্য রক্ষার কাজ।
সূত্রমতে, কুমিল্লায় অসংখ্য ছোট-বড় নদী ও খাল রয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় ১০-১২টির মতো খাল ভরাট হয়ে গেছে। গঙ্গাইজুড়ী, ঘুংঘুর ও সোনাইছড়ি খাল আজ বিপন্ন। এসব খাল, নদীর সংখ্যা ও নদীপথের সীমারেখার কোনো হিসাব নেই পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং জেলা প্রশাসনের কাছে। ধীরে ধীরে কুমিল্লা জেলায় বৃহৎ নদীগুলো পড়ছে হুমকির মুখে। মরে যাচ্ছে কুমিল্লার নদী। উৎমুখে গতিরোধ, দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, অবৈধ বনায়ন, অপরিকল্পিত ব্রিজ, মাটি কাটাও বালু উত্তোলন চলছে কোন নিয়ম ছাড়াই।
এদিকে যেমন নদী দখল হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে পানির গতিপথ বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে নদীর বাধ। বহুস্থানে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় বন্যার অশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। কুমিল্লায় রয়েছে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি নদী ও খাল। এখানে প্রধান নদী গোমতী। ডাকাতিয়া ও কাঁকড়ী নামে আরো দু’টি রয়েছে। ডাকাতিয়া একটি, অন্যটি পুরাতন। খাল গুলো হচ্ছে, গঙ্গাইজুড়ী, ঘুংঘুর ও সোনাইছড়ি। গভীর নলকূপের পাশপাশি নদী খালের পানি দিয়ে একসময় এ জেলায় সেচ কাজ চলতো। ড. আখতার হামিদ খানের উদ্যোগে সোনাইছড়ি খাল এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে কাটা কোদালিয়া খাল দক্ষিণ কুমিল্লার কৃষিতে বিপ্লব এনেছিল। এর বাইরে নাম না জানা অনেকে খালের পানি সেচ কার্যে ব্যবহার হতো। আজ এগুলোর কোন কোনটি মৃতপ্রায়, কোনটি বা হারিয়ে গেছে অব্যবস্থাপনার কারণে। এছাড়া নদীও খালের দু’পাড়ে বসতি গড়ে উঠায় ও যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় নদী কেন্দ্রীক ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দাউদকান্দির মেঘনা নদীর কুমিল্লা অংশ শুকিয়ে যাওয়ার এবং অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠায় সম্ভবনাময় এই অংশটির ব্যবসা-বাণিজ্যও দিন দিন কমে যাচ্ছে। জেলার প্রধান নদী গোমতী। এদেশের প্রবেশ মুখে উজানোর অংশে ভারত সরকার পাম্প হউজ নির্মাণের মাধ্যমে শুঙ্ক মৌসুমে সেচ সুবিধার সেচ সুবিধার জন্যে ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চলে পানি সরিয়ে নেয়। এতে নদীর পানি প্রবাহ একেবারেই কমে যায়। চলতি বছর যে কারণে নদীটি প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। ফলে গোমতী অববাহিকায় সেচ কার্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে। গোমতী, ডাকাতিয়া, কাঁকড়ী নদীর উপর সরকার বেশ ক’টি ব্রিজ নির্মাণ করেছে। ব্রিজ নির্মাণে সড়ক ও জনপথ বিভাগ দায়িত্ব পালন করলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডেও মতামত নেয়া হয়নি। নদী বিষয়ে অনভিজ্ঞতার কারণে নদীর স্বাভাবিক গতিপথে তারা বাধার সৃষ্টি করে। এতে পলি জমে নদীর নাব্য নষ্ট হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রকৌশলী জানান, জেলার তিনটি নদীর যে প্রসস্থতা তাতে কোন গার্ডার ছাড়াই ব্রিজ নির্মাণ সম্ভব হতো। এতে পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হতো না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতামত নিয়ে ব্রিজ নির্মাণ করলে নদীতে পলি জমত না। বেইলী সেতুর পিলার অপরিকল্পিত ভাবে নির্মাণ করায় সেখানে নদীর নাব্যতা দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। এর বাইরে তিনি আরো বলেন, পালপাড়া বেইলী ব্রিজটি দৈর্ঘ্য কমাতে নদী ভরাট করা হয়। এদিকে চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজার এলাকায় কাঁকড়ী নদীর উপর ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের ব্রিজটিও নদীকে ছোট করে নির্মাণ করা হয়। গোমতী বাধের ভিতরে বনায়ন চলছে অপরিকল্পিতভাবে। গোমতী ছাড়াও কাঁকড়ী, ডাকাতিয়া অববাহিকায়ও অনেক ফলদ ও বনজ বৃক্ষ রোপন করে বাগান সৃষ্টি করা হয়েছে। বর্ষাকালে পানির প্রবল ¯্রােত এ সকল গাছপালায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে চাপ সৃষ্টি করে। এতে বাঁধ ভাঙার উপক্রম হয়। কুমিল্লা সদর উপজেলার চাঁনপুর ও ছত্রখীলে বেশ ক’টি বাগান রয়েছে। সেখানের গাছগুলো বেশ বড় বড়। বর্ষাকালে পানি প্রবাহ বেড়ে গেলে এ সকল বাগান বাধার সৃষ্টি করে। গোমতীর বহু জায়গাই দখল হয়েছে। কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে বহুবার দখলদারদের নোটিশও করা হয়েছে কিন্তু প্রভাবশালীদের উচ্ছেদ সম্ভব হয়নি। কারণ হিসেবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে দায়ী করেন নাম না প্রকাশে অন্চ্ছিুক পাউবো সূত্র।
সূত্র মতে গোমতীর ৩০ দশমিক ৩ কিলেমিটার অংশে জেলার ব্রাক্ষণপাড়ার মনোহরপুর এলাকায় এ রকম বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া কুমিল্লার গোমতী অংশের দু’তীরে ৩ শতাধিক, নতুন ডাকাতিয়ায় ৫০টিরও বেশি এবং কাঁকড়ী নদীতে ৬০ টিরও বেশী অবৈধ স্থপনা রয়েছে। অর্থাৎ নদীগুলোর অবৈধ স্থাপনা রয়েছে ৪০০টিরও বেশী। আস্তে আস্তে গাছপালা, মাটির ঘর, আধা-পাকা ঘর ও সর্বশেষ পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আস্তে আস্তে গাছপালা, মাটির ঘর, আধা-পাকা ঘর ও সর্বশেষ পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নদী দখল করে বাড়ি, গতিপথে প্রতিবন্ধতা, অবৈধ উপায়ে মাটি কাটা, বালু উত্তোলন ইত্যাদির মাধ্যমে নদী গুলোর দুরাবস্থার বিষয়ে ভূমি আইন অ্যাডভোকেট আনোয়ার সাহেব বলেন, নদী তীর দখল, মাটি কাটা, বাগান সৃজনের নামে জায়গা দখল, বালু উত্তোলন, বাঁধের উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল প্রভৃতি বিষয়গুলো পৃথক পৃথক বিভাগ বা মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রণ হয় বলে সমন্বয়হীনতার কারণে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যেহেতু নদীগুলো নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেহেতু নদী সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদী নৌ-মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলে সমন্বয়হীনতা হত না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যাও থাকতনা। তারা ্এককভাবে উদ্যোগ নিলেই দখল, অবৈধভাবে মাটি কাটা, বালু উত্তোলন ইত্যাদি প্রতিরোধ সম্ভব হত। আইনী জটিলতায় পড়ার সম্ভাবনা কম থাকত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন