শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

একাদশ সংসদ নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

এইচ এম আব্দুর রহিম | প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে খানিকটা আশার আলো দেখা দিয়েছিল। একাদশ সংসদ নির্বাচন সবার অংশগ্রহণমূলক থাকলেও নানা প্রশ্ন ছিল নানা মহলে। অনেকে বলেছিল, নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ বড় বিষয় নয়, নির্বাচনটি অবাধ নিরপেক্ষ হওয়াই বড় বিষয়। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সবার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এই নির্বাচন গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ও স্বচ্ছ রাজনীতি সম্পর্কে বিরাট প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে কার্যকর গণতন্ত্র আছে কিনা অতীতে এ প্রশ্ন বহুবার উঠে এসেছে ভিন্ন পেক্ষাপটে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর প্রশ্নটি আবারও উঠে এসেছে। একাদশ সংসদ নির্বাচন সর্ম্পকে এক কথায় বলা যায়, কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত দিয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে এদেশে চালু নেই, এ নির্বাচনের মাধ্যমে তা শতভাগ প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওইসব নির্বাচনে পরাজিতদের কিছু অভিযোগ থাকলেও নির্বাচন সবার কাছে বৈধ্যতা পেয়েছিল। দেশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, উল্টো পথে চলছে গণতন্ত্র। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব নয়, তা আবার প্রমাণিত হলো। পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে কি না। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানে গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। উপরন্ত বাংলাদেশকে যেভাবে আখ্যায়িত করেছে তা লজ্জা ও অনুতাপের বিষয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেক কিছু নির্ভর করে নির্বাচনের মান কতটা ভালো কিংবা স্বচ্ছ হলো- এর উপর। গণতন্ত্র এক ধরনের ব্যবস্থা। এক ধরনের সিস্টেম।
সবার আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র সবার জীবনকে স্পর্শ করে সবার জন্য। সবার জন্য রচনা করে বলিষ্ঠ জীবনবোধ। সমস্বার্থের এক মোহনায় সবাইকে করে সম্মিলিত। সমস্বার্থের সুসম বন্ধনে সবাইকে করে সংগ্রথিত। সাম্যমৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্বের উপত্যকায় সবাইকে করে সংগঠিত। এই ব্যবস্থায় সংখ্যাগুরু যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘুও। অন্যদিক থেকে গণতন্ত্র এক প্রক্রিয়াও বটে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি স্বীকৃতি হয় স্বতন্ত্র, অনন্য, একক রূপে। কারও ওপর সে নির্ভরশীল নয়। নয় কারও মুখাপেক্ষী। আপন মহিমায় সেই ভাস্বর। তার সম্মতি ছাড়া শাসন করার অধিকার কারো নেই। তার সম্মতি ছাড়া তার ওপর কর ধার্য করার অধিকার নেই কারো। তা ছাড়া যে কোনো নীতি নির্ধারণে এই প্রক্রিয়ায় সর্বাধিক সংখ্যক ব্যক্তির ইচ্ছা হয় প্রতিফলিত। সবার সম্মতি নিয়ে সমাজ ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু একই সঙ্গে কাজ করে। আর এ দিক থেকে বলা যায়, গণতন্ত্র এক ধরনের নৈতিকতা। পরিশীলিত কর্ম প্রবাহ। রুচিকর এক যৌথ উদ্যোগ। পরিচ্ছন্ন ও সচেতন এক পদক্ষেপ। গোপনীয়তার জমাট বাঁধা অন্ধকার ছাপিয়ে গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের শুরু হয়। সর্ব সাধারণের সমক্ষে, মুক্ত আলোয়। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয় বলে সমমানসিকতা প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক কার্যক্রমে। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে নির্ধারণ করে নিজের পদক্ষেপ। নিয়ন্ত্রণ করে নিজের আচার-আচরণ। আমার জন্য যা পীড়াদায়ক, অন্যের জন্য তা সুখকর হতে পারে না। আমি যা খুশি করব তা তো হতে পারে না। সত্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি চর্চা ছাড়া গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রে কৌশল রুচিসম্মত। তার চর্চা হয় অবাধ-মুক্ত পরিবেশে। সুতারাং, রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি।
সফল গণতন্ত্রে কয়েকটি অঙ্গীকার রয়েছে। এক. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার যে ক্ষমতা প্রযোগ করে তা জনগণের ক্ষমতা। সরকার আমানত হিসেবে গণ ক্ষমতা ধারণ করে প্রয়োগ করে অনুমোদিত পন্থায়, ঐক্যমতের ভিত্তিতে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে সরকার ক্ষমতা চ্যুত হয়। গণতান্ত্রিক এই সত্য স্বীকৃত হতে হবে। দুই. গণতন্ত্রে ব্যক্তি প্রাধাণ্যের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের প্রাধান্য। প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের রাজত্ব। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় থাকবে আইনের প্রতি আনুগত্য, কোনো ব্যক্তির প্রতি নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আর একটি দিক হলো আইন মেনে চলতে হবে, যদিও তা খারাপ আইন হয়ে থাকে। আইন প্রণয়ন করেন জন প্রতিনিধিরা। তিন. গণতান্ত্রিক পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে জোরের যুক্তির পরিবর্তে যুক্তির জোর কার্যকর হয়। সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় সমঝোতা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে। সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক কাঠামো, তেমনি প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মন। প্রয়োজন কাঠামোর সর্বস্তরে স্পন্দিত অন্তঃকরণ। কাঠামোকে সিক্ত করার জন্য গণতান্ত্রিক চেতনার আস্তরণ।
উল্লিখিত বিষয়গুলো গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আমরা গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে যতই কথা শুনছি না কেন, এসব শর্তের কোনো উপস্থিতি কি বিদ্যমান অবস্থার মধ্যে লক্ষ করা যায়? আমাদের ক্ষমতাসীন মহল মনে করে, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠার অবকাশ নেই। তাদের নীতি নির্ধারকদের বক্তব্য হলো, কিছু প্রতিষ্ঠান নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। আমরা মনে করি, এ নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য একটি টেস্ট কেস ছিল। কারণ বিগত ২৭ বছরের মধ্যে এবারই দলীয় ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দলীয় কিংবা ক্ষমতাসীনদের অধীনে ভালো নির্বাচন হতে পারে, নানা রকম সুযোগ থাকা সত্তে¡ও এই ধারণা প্রমাণ করতে পারেনি শাসক মহল।
এই ক্ষতের উপশম হবে কীভাবে? বিদ্যমান পরিস্থিতি সাক্ষ্য দেয় গণতন্ত্রের বেহাল অবস্থার। এ জন্য দায়ী অসুস্থ রাজনীতি। গণতন্ত্রকে গতিশীল করতে হলে রাজনীতি কল্যাণমুখী করা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। প্রয়োজন রাজনীতিকে ক্ষমতার-রাজনীতির গহ্বর থেকে উদ্ধার করা। প্রয়োজন ব্যক্তি প্রাধান্যের নিগড় থেকে মুক্ত করে আইনের রাজত্বে ফিরিয়ে আনা। রাজনীতি তার গণতন্ত্রের বিশুদ্ধ রূপ ফিরে পেলে আজকে সমাজ জীবন যে ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে অহর্নিশ ছটফট করছে তা থেকে অব্যহতি পাবে। সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্তি লাভ করবে। সংঘাতময় পরিবেশের অবসান ঘটবে। শুচিতা ফিরে আসবে। যুক্তি-বুদ্ধির প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। জনগণ আবার হয়ে উঠবে শাসন-প্রশাসনের প্রধান নিয়ামক। এ জন্য প্রয়োজন সচেতন ও সম্মিলিত উদ্যোগ।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন