ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদ মানে স্ফ‚র্তি। এ আনন্দ আস্তিক মুসলিমের। এ এক অনাবিল আনন্দ। যে আনন্দের কোনো তুলনা নেই। এ আনন্দ আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের। এ আনন্দ গুনাহ মাফের। এ আনন্দ হাজার বছরের চেয়েও উত্তম রাত্রিকে কাছে পাওয়ার। এ আনন্দ বৈষয়িক ব্যস্ততাকে বাদ দিয়ে ই’তেক্বাফ করার। এ আনন্দ কুরআন তিলাওয়াত ও অনুধাবনের। এ আনন্দ গরীব দুঃখীর কষ্ট অনুভবের। এ আনন্দ তাকওয়া অর্জনের।
সত্যিই তো, দীর্ঘ একমাস রমজান মাসের রোজা শেষে যখন পশ্চিম আকাশে ঈদের চাঁদ উদিত হয় তখন রোজাদারের মধ্যে যে আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যায় তার কোনো তুলনা হয় না। হাদিসে এসেছে, ‘রোজাদারের দুটি আনন্দ; একটি হচ্ছে, ঈদুল ফিতরের সময় (ইফতারির সময়ও বটে) এবং অন্যটি হচ্ছে, আল্লাহর সাথে দিদার লাভের সময়’। নবী স. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহাকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ঈদ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা অনুসারে মুসলিম নর-নারী রমজানের পুরো একমাস সিয়াম সাধনা করে আত্মশুদ্ধি অর্জন করেন। কুরআন নাযিল হওয়ার কারণেও রমজান মহিমান্বিত। এ মাসে আছে লাইলাতুল ক্বদর, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। দীর্ঘ একমাস সিয়াম কিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত, দান খয়রাত ও একে অপরের প্রতি বেশি বেশি সহনশীল হওয়ার মাধ্যমে একজন বান্দা প্রকৃত মুমিনে পরিণত হতে পারেন। সামনে খাবার পানীয় ও স্ত্রী সম্ভোগের সুযোগ থাকা সত্তে¡ও তা থেকে বিরত থাকার অর্থই হচ্ছে প্রকৃত তাকওয়া। এখান থেকে মুসলিমগণ আজীবন হারাম কাজ থেকে দূরে থাকার শিক্ষা হাতে কলমে গ্রহণ করেন। দীর্ঘ একমাস কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে আল্লাহর বান্দা যখন ঈদগাহে গিয়ে নিষ্পাপ শিশুর মতো ঘরে ফিরে আসে সত্যিই তখন তার মধ্যে ভর করে স্বর্গীয় নান্দনিক অনুভূতি। রোজাদারের ঐ আনন্দের সাথে দুনিয়ার আর কোনো আনন্দের তুলনা হয় না। একমাস রোজা রাখার কারণে যার কাছে হালাল বস্তুও ছিল হারাম সে এখন অবমুক্ত। প্রকৃত হারাম বস্তু ছাড়া আর কোনো হারাম নেই তার সামনে। সে এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যায় আবার অন্য রাস্তা দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। পথিমধ্যে যার সাথে সাক্ষাত পায় তার সাথেই সালাম, কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে স্বর্গীয় আনন্দকে ছড়িয়ে দেয়। এ এক অপূর্ব দৃশ্য।
উপরের এ দৃশ্যপট হচ্ছে ঈদকে কেন্দ্র করে একজন মুসলিমের সত্যিকার সংস্কৃতি। ঈদকে বরণ করার এরচেয়ে সুন্দর ও পবিত্র সংস্কৃতি আর নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বর্গীয় এ ঈদের সুন্দর সংস্কৃতি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝ থেকে। আধ্যাতিকতার জায়গা এখন দখলে নিতে চাইছে লৌকিকতা। এখন রোজা শুরু হওয়ার আগেই শুরু হয় ‘ঈদ ফ্যাশন শো’। যেখানে বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ি কাপড়ের প্রদর্শনীর সাথে চলে সুন্দরী নারীর অবাধ দেহ প্রদর্শনীর ছোট-খাটো মহড়া। যে রোজা এলো তাকওয়ার বার্তা নিয়ে সে রোজাকে উপলক্ষ করে আমরা কী করছি এসব? এই সংস্কৃতি কি রমজানের তাকওয়ার সাথে যায়? ব্যবসায়ীরা ওৎ পেঁতে থাকেন, কখন রোজা আসবে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, দু’পয়সা বেশি কামানো। তাই পুরো রোজার মাস বাজারে থাকে উত্তাপ। কোনো পণ্য স্পর্শ করার যোগ্যতা থাকে না সাধারণ গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের। গরিব জনেরা রোজা রাখেন বাজারের উত্তাপ সহ্য করেই, আর ব্যবসায়ীরা আনন্দিত হন গরিবকে কষ্ট দিয়ে বাড়তি ব্যবসার জন্য। ব্যবসায়ীদের এই মনোবৃত্তি কি রোজার চেতনার সাথে মানানসই? এদেশে রোজা এলেই হোটেল-কমিনিউটি সেন্টারগুলো নতুন সাজে সেজে ওঠে। না, বিয়ে-শাদীর জন্য নয়, সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানও নয়। পুরো রমজান জুড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও সংস্থার ইফতার মাহফিলের জন্যই এই আয়োজন। সারা বছর ইয়াতিমদের খোজ খবর রাখতে না পারলেও রাজনৈতিক দলের প্রধানেরা তাদের নিয়ে ইফতার মাহফিল করেন। অধিকাংশ ইফতার মাহফিলের উদ্দেশ্য থাকে দল কিংবা সংগঠনের অস্তিত্ব জানান দেয়া। ঘুমিয়ে থাকা কর্মীদের একটু জাগিয়েও তোলা যায় এই মাহফিলের আয়োজন করে। রোজা আছি কি নেই ওটা বড় কথা নয়, আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে জানান দেই আমরা কত বড় মোত্তাকি!
কুরআন নাযিলের মাস রমজান। তাই কুরআন খতম করার বেজায় পাল্লা। ব্যক্তিগতভাবে পড়ার ফুরসত নেই। তারাবিই একমাত্র ভরসা। হাজার টাকায় হুজুর ভাড়া করে তাই চালাও পাঁচদিন, দশদিন, পনের এবং বিশদিনের কুরআন খতম। কুরআন খতম তো হলো। কীভাবে হলো এটা বিবেচনায় না আনলেও চলবে। পুরো রমজানজুড়ে খতম তারাবিহ পড়লে যে ব্যবসা লাটে ওঠবে। যাদের ব্যবসা নেই তাদের ঈদের শপিং। রোজা না থাকলেও ঈদের আনন্দ থেকে বাদ যাবে কেন? ওদিকে দোকানিরা যে অপেক্ষা করছে ললনাদের জন্য।
রোজার ঈদ তাই গ্রামে ফিরতে হবে। যেখানে অপেক্ষা করছেন কারো মা-বা। কারো ভাই-বোন কিংবা স্ত্রী ও সন্তান সন্তুতি। সবাই অপেক্ষমান, কখন প্রিয়জন ঈদের বাজার নিয়ে বাড়িতে ফিরবেন। বাস ও লঞ্চ মালিকদের সামনে এরচেয়ে বড় মওকা আর কী হতে পারে। দিন-রাত সিরিয়াল ধরেও বাস-ট্রেনের টিকিট মেলা ভার। সব টিকেট উধাও! কাউন্টারে উধাও হলেও কালো বাজারে পাওয়া যায় দ্বিগুণ, তিনগুণ দামে। এখানেও গরিব কাইত। টিকেট এখন ধনীরা কিনবে। ওরাই বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সাথে ঈদ আনন্দ করবে।
প্রত্যেক বছর রোজার ঈদের জন্য অপেক্ষায় থাকেন এমপি, মন্ত্রিরা। পাতি নেতারাও বাদ থাকেন না। এলাকায় শো ডাউন করতে হবে। যাকাতের কাপড় বিলানোর নাম করে জনগণের সাথে একটু দেখা হলে মন্দ কি? পরে কাজে লাগবে। পকেটে নতুন টাকা নিয়ে ঈদের ময়দানে যেতে হবে। হোক না সে টাকা অবৈধ। ঈদের ময়দানে লোক দেখানো কোলাকুলি আর সালাম বিনিময়। মাঝে মধ্যে গরিবদের কিছু পয়সা হাদিয়া। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাছিলের বড় সময় যে এখনই!
ঈদের চাঁদ আকাশে উঠেছে। শুরু হয়ে গেল পটকাবাজি আর আতশবাজি। চাদাবাজি তো আছেই। বাজারে বাজারে, অলিতে-গলিতে যুবক-যুবতীরা নেমে পড়বে ঈদ আনন্দে ধুম তারাক্কা গানের তালে। মোবাইলগুলো হটাৎ সচল হয়ে যাবে। কে কার আগে প্রেমিকার কাছে ঈদ বার্তা প্রেরণ করবে চলে তার প্রতিযোগিতা। সারা বছর খোঁজ না রাখতে পারলেও ঈদের উসিলা করে কেউ কেউ স্বজনদের কাছে ফোন দেন। দায়সারা খোঁজ-খবরও নেন বটে!
ইদানীং নতুন আরেকটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে ঈদ আনন্দে। তা হচ্ছে, ট্রাকে কিংবা নৌকায় চাপিয়ে যুবক যুবতীরা কানফাটা শব্দে বাঁশি, বাদ্য ও গান বাজনা দিয়ে হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠা। সড়ক-মহাসড়ক ধরে এরা ধাপিয়ে বেড়ায়। রাস্তা-ঘাটে যুবতীদের দেখলে তাদের উত্তেজনা আরো বাড়ে। বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গি দিয়ে তারা মেয়েদের টিজ করে বাড়তি আনন্দ করে।
ঈদের জামাতে যাবেন? ওমা এ তো দেখছি অনেক ভীড়। যারা পুরো মাস রোযা রেখে মসজিদে তারাবিহ আদায় করেছেন তাদেরও আজ ঈদের ময়দানে জায়গা পাওয়া দুষ্কর। মওসুমী মুসল্লিরা যে দখলে নিয়েছেন সব। নামাজের পর যে লোক দেখানো মোলাকাত তাতেও ওরা ফার্স্ট। কোলাকুলিতে বাদ পড়ছে অপরিচিত গরিব কিসিমের মানুষেরা। ঈদের দাওয়াতও এখন চেনা পরিচিতের মধ্যে ভাগ হয়। গরিবকে দাওয়াত কে দেয়?
ঈদ এসেছে মিডিয়া বসে থাকবে কেন? বাঁশি পঁচা নাটকের পসরা আর নানান কিসিমের অনুষ্ঠানমালা নিয়ে একেকটা টেলিভিশন চ্যানেল প্রস্তুত। টানা পাঁচ-সাতদিন দর্শকরা গিলবে ওগুলো। সাথে আছে বিরক্তিকর বিজ্ঞাপন। মুসলমানের ঈদের সাথে ঠিক সাজুয্য খুঁজে পাওয়া যায় না ঐসব অনুষ্ঠানমালার। সিনেমা হলগুলোতেও নতুন নতুন ছবি মুক্তি পাবে। সব সিনেমার গল্প প্রায় এক। প্রেম কাহিনী আর অশ্লীলতা। যে অশ্লীতাকে তাড়ানোর জন্য রোজা এলো সেই অশ্লীলতাই এখন ঈদ আনন্দের বড় মাধ্যম হয়ে গেছে।
পেপার-পত্রিকারও তো ঈদ আছে। ঈদের আগেই প্রায় প্রতিটি পত্রিকা আলাদা আলাদা ম্যাগাজিন ছাপবে। না হয় পত্রিকার ভেতরেই বিশেষ ঈদ সংখ্যা ছাপা হবে। কেউ দেবে ফ্রি কেউ দেবে বাড়তি পয়সায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ঈদ উপলক্ষে প্রকাশিত ঐসব ম্যাগাজিনের কোনো কোনো প্রচ্ছদে দেখা যায়, অর্ধ উলঙ্গ নারীর ছবি কিংবা নানান ধরনের ভূত-পেতিœর আলপনা। ভেতরের গল্পগুলোর সাথেও ঈদের সাথে কোনো মিল নেই। একাজগুলো কিন্তু করা হয় পরিকল্পিতভাবে। উদ্দেশ্য, ঈদ আনন্দকে সেকুলারাইজ করা। এভাবেই লৌকিকতা কেড়ে নেয় আধ্যাতিকতার ঈদ আনন্দকে। লৌকিতার প্রচন্ডতায় আসল হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাই আমরা। যে আনন্দের বারতা নিয়ে রোজার ঈদ আসে আমাদের মাঝে সে আনন্দ ছিনিয়ে নেয় অপসংস্কৃতি। ঈদের শিক্ষাও থেকে যায় অন্তরালে। ভেদাভেদ, মারামারি আগের চেয়ে আরো বাড়ে। চারদিকে বাড়ে মাতম। অশান্তির প্রচন্ডতায় দগ্ধ হই আমরা...।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন