শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ইসলামে সম্প্রীতির ধারণা

ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

ইসলাম সম্প্রীতির ধর্ম একথা সর্বজন স্বীকৃত। ইসলামের শুরু থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্য উদাহরণ তার বাস্তবতা। কিন্তু কখনও কখনও তা মানুষ বুঝতে ভুল করেছে। ভুল করেছে ইসলামের মৌলিক শিক্ষাকে ধারণ করতে। ফলে কিছু বিপদগামী অনুসারীর অসংযত আচরণকেই প্রাধন্য দিয়ে ইসলামের মৌলিক দর্শনকে বিতর্কিত করা প্রচেষ্টা যেমন কখনও যৌক্তিক হিসেবে বিবেচিত হবে না তেমনি তার গ্রহণযোগ্যতাও পাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) যিনি সমগ্র মানুষের জন্যে শুধু রহমত স্বরূপ আসেননি, বরং তিনি সকলের জন্যে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শও, তিনি তার সমগ্র জীবনে সম্প্রীতির বাস্তব উদাহরণ হিসেবে নিজেকে যথাযথ হিসেবে প্রকাশ করেছেন সফলভাবে। তাঁর (সা.) অনুসারীদের জীবনেও সম্প্রীতির বাস্তব উদাহরণ আমরা লক্ষ করি। ইসলাম এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছে।

সম্প্রীতির সমর্থকবোধক শব্দ অভিধানগুলোতে পাই ‘সদ্ভাব’, ‘সন্তোষ’, ‘আহ্লাদ’, ‘আনন্দ’ ইত্যাদি। একে অপরের মাঝে সদ্ভাব, সন্তোষজনক, আহ্লাদি, আনন্দপূর্ণ ইত্যাদি সম্পর্ককে সম্প্রীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সুতরাং কোনো সমাজে যদি একে অপরের সাথে সদ্ভাব, সন্তোষজনক, আনন্দপূর্ণ সম্পর্ক থাকে তাহলে তাকে সম্প্রীতির সমাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রকৃত অর্থে ইসলামের মৌলিক বাণীই হলো সম্প্রীতি। সম্প্রীতিকে তাই সামাজিক জীবনের মূল ভিত্তি ধরে সকল বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে এ অর্থে যাতে মানুষ শুধু দুনিয়াবি জীবনে শুধু নয়, বরং মৃত্যু পরবর্তী জীবনেও শান্তি লাভ করতে পারে। ইসলামের সামাজিক সম্প্রীতির মৌলিক সে ধারণার কতিপয় তুলে ধরা হলো:

সম্প্রীতি হবে আল্লাহর (সৃষ্টিকর্তা) সস্তুষ্টির জন্যে

যে কোনো কাজের মূল উদ্দেশ্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে না হয় সেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিজস্ব সুযোগ-সুবিধা ও চাওয়া পাওয়ার প্রাধান্য বেড়ে যায়। যা সত্যিকার অর্থে অন্যকে বঞ্চিত করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। ফলে বঞ্চিতরা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠে। এতে সম্প্রীতি রক্ষা অনেক কঠিন হয়ে যায়। এজন্যে ইসলাম ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যখনই সামাজিক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের কথা বলেছে সেখানেই এসবের উদ্দেশ্য হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে ভিত্তি ধরা হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা দিচ্ছেন, ‘বলুন, হে আহলে কিতাবগণ, একটি বিষয়ের দিকে আস যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করব না, তাঁর সাথে কোনো শরিক সাব্যস্ত করব না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে পালনকর্তা বানাব না। তারপর যদি তারা স্বীকার না করে, তাহলে বলে দাও যে, সাক্ষী থাক আমরা তো অনুগত (মুসলিম)।’ (সূরা আলে ইমরান, ৩: ৬৪)

একে অপরের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সকল মানুষ সমান। এখানে কোনো পার্থক্য নেই, না নারি পুরুষে, না মুসলিম অমুসলিমে। চিন্তা-চেতনা, দর্শনে কিংবা বিশ্বাসে ভিন্নমতের কারণে যদি কারো ব্যক্তিগত কিংবা ধর্মীয় জীবনে ক্ষতির আশংকা না থাকে তাহলে সেসবের ঊর্ধ্বে একে অপরের মাঝে সামাজিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। এ ক্ষেত্রে, প্রত্যেকেই তার সম্মান ও মর্যাদা যথাযথভাবেই পাবে। শুধুমাত্র ঐসবের ভিন্নতার কারণে কাউকে হেয় করা কিংবা অপমান করা যাবে না। আল্লাহ ঘোষণা করছেন, ‘(হে নবি, আপনি ঘোষণা দিন) তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্যে এবং আমাদের ধর্ম আমাদের জন্যে।’ (সূলা আল-কাফিরুন, ১০৯: ৬)

একে অপরের প্রতি সহিষ্ণুতা

একে অপরের প্রতি সহিষ্ণুতা ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। ভিন্ন মত, দর্শন কিংবা বিশ্বাসের কারণে কারও প্রতি সহিংসতা, জুলুম, নির্যাতন ও বঞ্চনা ইসলামের শিক্ষা নয়। বরং কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিচার ফয়সালায় ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। সেখানে কোনো ভিন্নাচরণের উল্লেখ করা হয়নি। (সূরা আন-নিসা, ৪: ৫৮)

একে অপরের অধিকার ও কর্তব্য এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা

কোনো পরিস্থিতিতে কারো অধিকার খর্ব করার বৈধতা ইসলামে নেই। কোনো সমাজ ব্যবস্থায় একে অপরের অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে পাশাপাশি তাদের একে অপরের কর্তব্যের ব্যাপারে যথাযথভাবে সচেতন হলে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করা সহজ হয়ে যায়। সেখানে সম্প্রীতি অবশ্যাম্ভাবী। ইসলাম তাই এটিকে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছে।

সবার জন্যে কল্যাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং সে মর্মে সহযোগিতা করা

সামাজিক সম্প্রীতির অন্য একটি নিয়ামক হলো জনগণ নির্দিষ্ট কোনো কল্যাণময় কাজের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে একে অপরের সহযোগিতা করছে কিনা। সেখানে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সামাজিক কল্যাণের জন্যে একে অপরকে সহযোগিতা করতে যেমন নির্দেশ দিয়েছে তেমিন অকল্যাণকর সকল কাজ থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখার পাশাপাশি অন্যদেরকে যেন সহযোগিতা না করা হয় তার জন্যে আদেশ দিয়েছে। কুরআন ঘোষণা করছে, ‘তোমরা একে অপরের কল্যাণের ব্যাপারে সহযোগিতা করো কিন্তু অকল্যাণ ও শত্রæতার জন্যে সহযোগিতা করো না।’ (সূরা আল-মায়েদাহ, ৫: ৩)

সহিংসতা না করার ব্যাপারে একমত হওয়া

সহিংসতা নিজে কোনো ব্যক্তি কিংবা একপক্ষ না করলেই সমাজের সম্প্রীতি রক্ষা করা যায় না। বরং ভিন্ন মত ও পথের সকলকে এ ব্যাপারে একমত হতে হবে যে, কেউ কারও জন্যে সহিংসতামূলক কোনো আচরণই করবে না। ইসলাম এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় নির্দেশনা দিয়েছে। শুধু মুসলিমদেরকে নয়, সমাজের অমুসলিমদেরকেও তাই বিশৃংখলা ও সহিংসতা না করার আদেশ দিয়েছে। কুরআনে এসেছে, ‘তোমরা যমীনে বিশৃংখলা করো না।’ (সূরা আল-বাকারাহ, ২: ১১; সূরা আল-আ‘রাফ, ৭: ৫৬ ও ৮৫; সূরা মুহাম্মদ, ৪৭: ২২) অন্য জায়গায় এসেছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আল-মায়িদাহ, ৫: ৬৪; সূরা আল-কাসাস, ২৮ :৭৭)

ইসলাম পরিপূর্ণ এবং শান্তির ধর্ম হিসেবে এমন কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেছে যার পালনে সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, আমরা সেগুলোকে না জেনে, না বুঝে নিজেদের চিন্তা চেতনার বাস্তবায়নের মাধ্যমে হিতে বিপরীত করছি প্রতিনিয়ত। সুতরাং সামাজিক সম্প্রীতির জন্যে যে বা যারাই কাজ করছেন তাদের উচিত এ ব্যাপারে ইসলাম কী বলেছে তা জেনে নেয়া। ৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত এ সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি তখনই সম্ভব হবে যখন ইসলামের এ অনুসারীরা তাদের ধর্মকে যথাযথভাবে বাস্তব জীবনে পালন করতে সক্ষম হবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সে তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন