শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

লাইফলাইন বেগবান

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তিন সেতুর ম্যাজিক

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৩ জুন, ২০১৯, ১২:৩০ এএম

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। দেশের অর্থনীতির এই লাইফ লাইন এখন বেগবান। নতুন তিন সেতুর ম্যাজিকে পাল্টে গেছে দেশের প্রধান মহাসড়কের পুরনো চিত্র। অসহনীয় যানজটের বিষফোঁড়া কেটে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যজট নিরসনে এসেছে উন্নতি।
আমদানি-রফতানি পণ্যের চালান এবং শিল্পের কাঁচামাল পরিবহন বর্তমানে ঝামেলামুক্ত। সড়কপথে ভ্রমণ অনেকটাই দুর্ভাবনাহীন। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরে খুশী যাত্রী আর চালকরা। হাজার হাজার যানবাহনের জ্বালানি তেল পোড়ানো এবং লাখো যাত্রীর সময় বেঁচে যাচ্ছে। দৈনিক সাশ্রয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
গত ২৫ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুমিল্লার দাউদকান্দির মেঘনা-গোমতী নদীর ওপর নির্মিত চার লেনের সুপরিসর দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতু এবং মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় মেঘনা সেতু দুটি ‘ঈদ উপহার’ হিসেবে উদ্বোধন করেন। ঈদুল ফিতরের আগেভাগেই উভয় সেতুতে যানবাহন চলাচল হয় উন্মুক্ত। এরআগে চালু করা হয় মহাসড়কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু।
ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক যানজট মুক্ত। রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পৌঁছাতে সময় লাগছে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা। যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রজাদরদী সম্রাট শেরশাহ সুরি’র শাসনকালে চার শ’ বছর আগে নির্মিত ‘গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড’ (শাহ রাহে আজম)-এর একাংশ আজকের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। ‘গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড’ বাংলাদেশে চট্টগ্রাম থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া হয়ে পাকিস্তানের পেশাওয়ারের মধ্যদিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত পৌঁছেছে।
এটি এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও দীর্ঘতম সড়ক। যার দূরত্ব ২ হাজার ৫শ’ কিলোমিটার। কালের বিবর্তনে জনসংখ্যার চাপ ও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্ব বেড়ে গেলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে এই লাইফ লাইন স্থবির হয়ে পড়ে দীর্ঘদিন। জগদ্ধল পাথরের মতো চেপে থাকা তীব্র যানজটের কারণে অবস্থাটা ছিল ‘নয়টার গাড়ি কয়টায় পৌঁছাবে’! পঁয়ত্রিশ বছর আগেও এ মহাসড়কে চলাচলকারী বাস-কোচের ভেতরে কাচে নোটিশ লেখা থাকতো ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম সময় ৮ ঘণ্টা, জাস্ট টাইম নো কমপ্লেইন’।
অথচ তিন যুগ পরে এসেও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় কিংবা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ২৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে গিয়ে সময় লেগে যেতো ৮ ঘণ্টা থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত। মাইলের পর মাইল ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় ড়য়ে থাকতো বাস-কোচ, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, লরি, প্রাইভেট যানসহ হরেক যানবাহন। যানজটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন যাত্রী, চালক উভয়েই। যানজটে আটকে গিয়ে বন্দরের আমদানি-রফতানি পণ্যভর্তি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের মালামাল চুরি ও লোপাট হতো।
মহাসড়ক চার লেইনে উন্নীত হলেও নিত্যদিনের যানজটের কারণে তা বৃথা গেছে বলেই অনেকে ক্ষোভ-হতাশা ব্যক্ত করে আসছিলেন। এ মহাসড়কে দৈনিক ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচল করে। বিশেষ করে দেশের প্রধান চট্টগ্রাম বন্দরমুখী ও বহির্মুখী আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লরিগুলো বিলম্বে গন্তব্যে পৌঁছানোর কারণে শত কোটি টাকা গচ্ছা দিতে হতো ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের। দ্বিগুণ ভাড়াও গুণতে হয়।
গার্মেন্টসহ হরেক ধরনের পণ্যসামগ্রীর রফতানি চালান বন্দরের জেটিতে যথাসময়ে পৌঁছাতে না পারলে জাহাজীকরণ ছাড়াই জাহাজ বন্দর ছেড়ে চলে যায়। এভাবে অনেক সময়ই রফতানি অর্ডার বাতিল হয়। দেশের সামগ্রিক আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই পরিবাহিত হয়। স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক সাড়ে ৪ হাজার ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান বন্দরের মালামাল বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেয়। এরমধ্যে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়ক দিয়েই প্রায় ৮০ ভাগ পণ্য যায় ঢাকাসহ আশপাশ এলাকায়। এ কারণে মহাসড়কটি দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেছেন, দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। দেশের সমগ্র আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৯০ ভাগই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এর সিংহভাগ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পরিবহন করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন যানজট সমস্যার কারণে বন্দরে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হয়।
এতে করে বন্দরে জট সৃষ্টি এবং এরজন্য খেসারত দিতে হতো আমদানি-রফতানিকারক ও ভোক্তা সাধারণকে। যানজটের কারণে যাত্রীদের সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব ছিলনা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গোমতী-মেঘনা দ্বিতীয় সেতু, মেঘনা দ্বিতীয় সেতু ও কাঁচপুর দ্বিতীয় সেতুসহ তিনটি নতুন সেতু নির্মাণের ফলে এখন আর যানজট নেই। মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের ফলেই দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন গতিশীল হয়েছে উল্লেখ করে মেয়র নাছির বলেন, শুধুই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নয়।
সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কে অনেকগুলো সেতু নির্মিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কানেকটিভিটির ওপর জোর দিয়েছেন। সেভাবেই অবকাঠামো উন্নয়ন অগ্রসর হচ্ছে। চিটাগাং চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, নতুন তিনটি সেতু চালুর ফলে দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন আরও সচল হয়েছে। যানজটের সমস্যা অনেকাংশে কমেছে। যা আমদানি-রফতানিতে সুফল বয়ে আনবে। আমদানি-রফতানি পরিবহনের চাহিদা মেটাতে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা-চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
ক্লিয়ারিং ফরোয়ার্ডিং এজেন্টস (সিঅ্যান্ডএফ) এসোসিয়েশনের নেতা ও চেম্বারের পরিচালক একেএম আকতার হোসেন বলেন, তিনটি সেতু উদ্বোধনের ফলে রফতানির চাকা গতিশীল হয়েছে। এরফলে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক নেতা নুরুল আলম ও মোঃ ইউনূস বলেন, মহাসড়কে যানজটের কারণে বন্দরে জট লেগে থাকতো। মেঘনা-গোমতী ফোর লেইন দুইটি সেতু ও কাঁচপুর নতুন সেতু চালুর পর থেকে যানজট নেই। সময়ও কমে গেছে। বন্দরে পণ্য আনা-নেয়া সহজ হচ্ছে।
বন্দরনগরীর মনসুরাবাদে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির মালিক এনামুল হক জানান, আগে মহাসড়কে দিনে-রাতে যানজট লেগেই ছিল। এ কারণে পরিবহন ব্যবসায় খরচ পোষানো কঠিন ছিল। তিনটি সেতু চালু হওয়ার পর এখন সময়মতো মালামাল নিয়ে গন্তব্যে আসা-যাওয়া করা যায়। দামপাড়ায় এসি কোচ সার্ভিস দেশ ট্রাভেলসের যাত্রী হানিফ মাহমুদ বলেন, আমি এই মাত্র সপরিবারে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নামলাম। পথে কোথাও যানজট দেখিনি। সময় লেগেছে মাত্র চার ঘণ্টা। যানজট নিরসন ও সময় সাশ্রয় হওয়ায় এখন বাস-কোচের ভাড়া কমানো উচিৎ বলে মত দেন তিনি।
সিল্ক লাইন কোচের চালক শাহ আলম বলেন, মহাসড়কে কুমিল্লার অংশে ও ঢাকার কাছাকাছি যানজটের সমস্যার কারণেই বেশি সময় পার হতো। সবচেয়ে বেশি জটের এলাকায় তিনটি নতুন সেতু ম্যাজিকের মতো কাজ দিয়েছে। গত ঈদের আগে ও পরে আমরা নির্বিঘে্ন গাড়ি চালিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম আসা-যাওয়া করছি। পণ্যবাহী কাভার্ড ভ্যান চালক মফিজুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের মালামাল নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ যাবত ঠিক সময়মতো ঢাকায় পৌঁছে যাচ্ছি। জ্বালানি তেলের খরচ ও সময় কমে গেছে। আগে যানজটের কারণে মহাসড়ক একটা বড় টেনশনের ব্যাপার ছিল।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট নিরসনে গোমতী নদীর ওপর ১ হাজার ৪১০ মিটার দীর্ঘ ও ১৭ দশমিক ৭৫ মিটার প্রস্থ দ্বিতীয় গোমতী সেতু নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয় এক হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। অন্যদিকে এক হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে মেঘনা নদীর ওপর ৯৩০ মিটার দীর্ঘ ও ১৭ দশমিক ৭৫ মিটার প্রস্থ দ্বিতীয় মেঘনা সেতু নির্মিত হয়েছে। সাড়ে ৩ বছর ধরে চলা নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ হয়। উভয় সেতু উন্মুক্ত হওয়ার সাথেই মহাসড়কে যানজটের চিরাচরিত দৃশ্য পাল্টে যায়।
মহাসড়কে ঢাকা থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত ৯৭ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যকার যানজট ছিল তীব্র। আগে এই পথ পাড়ি দিতে ৪ ঘণ্টা থেকে ১২ ঘণ্টা লেগে যেতো। এখন দেড়-পৌনে দুই ঘণ্টায় যাওয়া যায়। কুমিল্লা থেকে দাউদকান্দি মেঘনা-গোমতী সেতু পর্যন্ত যেতে সময় লাগে মাত্র ৪৫ মিনিট। বাকি ৪৫ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছানো যায়। তখন ছিল দুই লেনের একটি করে সেতু। তাছাড়া মেঘনা ও গোমতী সেতুতে ওঠার আগে টোল প্লাজায় কতক্ষণ আটকা পড়তে হবে এমন দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই রওনা হতেন চালক-যাত্রীরা। নতুন দ্বিতীয় সেতুগুলোর সুবাদে ভ্রমণ এখন যানজট মুক্ত ও স্বস্তিকর।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন