শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কাক্সিক্ষত উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রসঙ্গে

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বাংলাদেশের প্রশাসনের অন্যতম সমস্যা সবকিছু কেন্দ্রীকরণ। কেন্দ্রীকরণের বিপরীত শব্দ ও প্রক্রিয়া হচ্ছে বিকেন্দ্রীকরণ। বাংলাদেশে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ওপর আলোচনা করতে গেলেই, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগরী, বন্দরনগরী ও ঘোষিত ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ চট্টগ্রামের নাম আসতে বাধ্য। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা জনসংখ্যার ভারে প্রকম্পিত। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা অপরিকল্পিত মহানগরীর একটি উদাহরণ। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা সরকারি-আধা সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকান্ড, প্রশাসনিক কর্মকান্ড ও দাফতরিক কর্মকান্ড কেন্দ্র। ঢাকাকে দেশের সব বাণিজ্যিক কর্মেরও কেন্দ্র বা রাজধানী করে ফেলা হয়েছে। আজ থেকে চার-পাঁচ বছর বা পাঁচ-সাত বছর আগে (সঠিক তারিখটি মনে নেই) জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আহবানটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিষয় ছিল ‘প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ’। আমরা যখন এই কলাম পড়ছি, তখন এরশাদ সাহেব বিগত বা মরহুম। তার শাসন আমলে তিনি অনেক ভালো কাজ যেমন করেছেন, তেমনি অনেক মন্দ বা সমালোচিত বা বিতর্কিত কাজও করেছেন। সব প্রশাসক বা নেতাই ভালো ও মন্দ কাজ উভয়ই করে থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যে নেতা ভালো কাজ বেশি করেন, তাকে স্মরণ রাখা হয় একরকমভাবে; আবার যে নেতা মন্দ কাজ বেশি করেন, তাকে স্মরণ রাখা হয় অন্যভাবে। দেশের শাসক তথা প্রেসিডেন্ট এরশাদ, ভালো কাজ বেশি করেছিলেন নাকি মন্দ কাজ বেশি করেছিলেন, সেই মর্মে কোনো সার্টিফিকেট এই কলামে দেবো না।

উল্লেখ করতে চাই, এরশাদ সাহেব প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করতে চেয়েছিলেন। তার উদ্যোগ কোনো ক্ষেত্রে সফল হয়েছে আবার কোনো ক্ষেত্রে বিফল হয়েছে। ১৯৮৪ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের জেলা ছিল ১৯টি যথা চট্টগ্রাম, ঢাকা, টাঙ্গাইল, পটুয়াখালী, ময়মনসিংহ, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ইত্যাদি। প্রতিটি জেলার মধ্যে আরেকটি প্রশাসনিক নিম্নধাপ ছিল, যেটিকে বলা হতো মহকুমা বা ইংরেজিতে সাব-ডিভিশন। প্রেসিডেন্ট এরশাদ সব মহকুমাকে জেলাপর্যায়ে উন্নীত করেন। ফলে বাংলাদেশে জেলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪টি। ওই সময় জেলার নিচে ছিল মহকুমা এবং মহকুমার নিচে ছিল থানা।

আর এই থানা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সাংগঠনিক স্তর এবং যুগপৎ ছিল একটি প্রশাসনিক স্তর। এরশাদ সাহেব স্থানীয় সরকারের একটি ধাপ হিসেবে ‘উপজেলা’ সৃষ্টি করেন। কোনো কোনো উপজেলায় একটি থানা আবার কোনো কোনো উপজেলায় একাধিক থানা ছিল বা আছে। তিনি নির্বাচিত ব্যক্তিগণের মাধ্যমে উপজেলা পরিচালনার ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৮৪ সালে মহকুমা বিলুপ্ত হয়ে জেলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং ১৯৮৫ সালে জেলা উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছিল; প্রথমবারের মতো নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা দায়িত্ব নিয়েছিলেন। স্থানীয় সরকার হিসেবে উপজেলা এখনো যথেষ্ট সাফল্য পায়নি বা সম্পূর্ণ সফল প্রতিষ্ঠান হতে পারেনি, আংশিকভাবে সফল প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতি এটি। এর কারণ, আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলোর অনীহা।

ঝঞ্ছা-বিক্ষুব্ধ সঙ্ঘাতপ্রবণ পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আনয়নের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট এরশাদ অবিচল ছিলেন। সেই লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে সঠিক কর্মকর্তা তথা কনিষ্ঠ সহকর্মী বেছে নিয়েছিলেন এবং দৃশ্যমান সাফল্য অর্জন করেছিলেন; আমি নিজে তার ব্যক্তিগত সাক্ষী। যদিও আজকে শুধু (বিকেন্দ্রীকরণ প্রসঙ্গেই) পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়টি প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করব। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিশদ আলোচনা পেতে হলে, সরেজমিন অভিজ্ঞতার আলোকে আমার লিখিত (‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির ম‚ল্যায়ন’) বইটি ঘাঁটতে পারেন। বইটির প্রকাশক মওলা ব্রাদার্স, প্রকাশকাল ২০০১ এবং এটা অনলাইন বিক্রেতাদের মাধ্যমেও পাওয়া যায়। ১৯৮৭-৮৮-৮৯ সালে আমি খাগড়াছড়িতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্যতম ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়, সরেজমিন বা ইংরেজি পরিভাষায় অন-গ্রাউন্ড, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিপ্রক্রিয়ার প্রধানতম ও নিবিড়তম চালিকাশক্তি ছিলাম, রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও চট্টগ্রামের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল আবদুস সালাম সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায়।

সে সময় (ডিসেম্বর ১৯৮৭-ডিসেম্বর ১৯৮৮) পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তথা সেই সংগঠনের সশস্ত্র অঙ্গ ‘শান্তি বাহিনী’ একটি পাঁচ দফা দাবিনামা উপস্থাপন করেছিল। ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবিনামার আদলে। ‘শান্তিবাহিনী’র এক নম্বর দাবি ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে, প্রদেশের নাম হবে জুম্মল্যান্ড, রাজধানী হবে রাঙ্গামাটি, এই প্রদেশের হাতে তিনটি বিষয় ছাড়া বাকি সব বিষয় থাকবে। সরকারের পক্ষে, আনুষ্ঠানিক আলোচনা বৈঠকে প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে আমি নিজেসহ আমরা এই দাবিনামা নাকচ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু বলেছিলাম, যদি কোনো দিন বাংলাদেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থা কায়েমের পরিস্থিতি আসে বা প্রাদেশিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বা বৃহত্তর চট্টগ্রামের জন্য এই বিষয়টি বিবেচনাযোগ্য হতে পারে। সেই ঐতিহাসিক শান্তি আলোচনার ৩১ বছর পর ২০১৯ সালের জুলাই মাসে আমরা মনে করি, চট্টগ্রাম তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামের সুষ্ঠু প্রশাসন ও সমন্বিত উন্নয়নের লক্ষ্যে, চট্টগ্রাম মহানগরীকে কার্যকর বাণিজ্যিক রাজধানী বানানোর লক্ষ্যে, দু’টি প্রস্তাবের যেকোনো একটি বিবেচনা করা প্রয়োজন।

আমরা পাঁচ-সাত বছর আগের একটি আলোচনা সভার কথা বলছিলাম। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের আহŸান জানিয়েছিলেন। যদি একবারে সম্ভব না হয়, কোনো একটি উপযুক্ত এলাকাকে নিয়ে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা চালু করা এবং এর অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে বাকিগুলো নিয়ে আগানো। আলোচনা সভাতেই, এই প্রস্তাবের বিপক্ষেও যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে কলামের মধ্যে এই প্রস্তাব আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। সুবিধা এবং অসুবিধা উভয় দিক আছে। বৈরী আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিবেশে, আয়তনে ক্ষুদ্র কিন্তু নিবিড়ভাবে জনবহুল একটি দেশের জন্য প্রাদেশিক ব্যবস্থা কতটুকু উপযুক্ত, সেটি অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে।

জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম আঙ্গিক হলো জনগোষ্ঠীর মধ্যে চিন্তার সংহতি এবং একমুখী জাতীয়তাবাদের চিন্তা। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের মানুষ জাতীয়তাবাদের চিন্তায় দুই ভাগে বিভক্ত, ধর্মীয় ম‚ল্যবোধের চিন্তা ভাবনা দুই ভাগে বিভক্ত, শিক্ষাব্যবস্থার অনুসরণে দুই ভাগে বিভক্ত এবং চ‚ড়ান্তভাবে সততা ও অসততার প্রশ্নে তথা নীতি ও দুর্নীতির প্রশ্নে দুই ভাগে বিভক্ত। এ অবস্থায় প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থার উপকারিতা আর অপকারিতার মধ্যে ভারসাম্য আনয়ন সহজ হবে, না কঠিন হবে সেটি আলোচনাযোগ্য ব্যাপার। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। সেই মুক্তিযুদ্ধে সৈন্য দিয়ে ও অন্যান্য পন্থায় আমাদের সহযোগিতা করেছিল ভারত। ১৯৭১ সালে ভারতের ভ‚-কৌশলগত স্বার্থ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তা এক বিন্দুতে স্থির থাকেনি এবং না থাকাটাই স্বাভাবিক। অতএব, এরূপ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় প্রাদেশিক সরকার কতটুকু প্রাসঙ্গিক সেটি অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে।

যা হোক, সম্প্রতি এক টকশোতে ঢাকাকে ভারমুক্ত করার স্বার্থে, ব্যবসা-বাণিজ্যকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-প‚র্ব অংশের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা তিনটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। প্রথম প্রস্তাব, বৃহত্তর চট্টগ্রামকে সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে প্রদেশ ঘোষণা করা। অথবা দ্বিতীয় বিকল্প প্রস্তাব, সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে শুধু আলাদা প্রশাসনিক ইউনিট ঘোষণা করা এবং প্রশাসনের জন্য চট্টগ্রামকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। অথবা, তৃতীয় বিকল্প প্রস্তাব, চট্টগ্রামে উন্নয়ন এবং চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে সফল করার জন্য এবং সমন্বয় করার জন্য একটি আলাদা প্রশাসনিক দফতর বা প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় স্থাপন করা। তিনটি প্রস্তাবেই অন্যতম বিষয় হলো যে, ঢাকা মহানগর থেকে অনেক কর্মকাÐের প্রধান দফতর, বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের বিবেচনা মোতাবেক, চট্টগ্রামে বা খুলনায় বা সিলেটে বা ময়মনসিংহে বা রংপুরে কিংবা রাজশাহীতে স্থানান্তর করতে হবে। অন্যতম অন্তর্ভুক্ত বিষয় হলো, বিচার বিভাগের উচ্চতর অংশের বিকেন্দ্রীকরণ এবং এই বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ চট্টগ্রামে স্থাপন করা।

চট্টগ্রামে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনের সাথে সাথে অন্য সাতটি বৃহৎ মহানগরীতেও তা স্থাপন করা যায় বা যাবে অর্থাৎ চট্টগ্রামে স্থাপনের পর, চট্টগ্রামের অভিজ্ঞতার আলোকে অন্যান্য মহানগরীতে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা যায় বা যাবে। চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য, উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন দফতর বা প্রতিষ্ঠান বা সরকারের অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা এলে, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা এবং চট্টগ্রামের মানুষের দুর্ভোগ, বারবার মনে করিয়ে দেয় যে, প্রশাসনিক সংস্কার অতি জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন; কিন্তু আমরা সে দিকে অবহেলা করছি। আমার ব্যক্তিগত মত, আমরা রাজনৈতিক কারণে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করেছিলাম; কিন্তু প্রশাসনিক প্রয়োজনে ঢাকা মহানগরীর উন্নয়নের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা আজো করিনি। অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রয়োজন অগ্রাধিকার পেয়েছে, তবে জনগণের কল্যাণ অগ্রাধিকার পায়নি। চট্টগ্রামেও অগ্রাধিকারে হেরফের হয়ে যেতে পারে। আমরা এ বিষয়ে সাবধান থাকতে চাই।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন