বেনাপোল কাস্টমস কমিশনারের বিরুদ্ধে ভুয়া বেনামী অভিযোগ তদন্ত কাস্টমস ও বিসিএস আয়কর ক্যাডারে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বেনামীর বাদশা’ দুদকের হবু ডিজি আহসান আলী বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাবশত দুদক ও দুইশত জায়গায় ভুয়া অভিযোগ জমা দেন। দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস দুদকের যশোর বিভাগীয় অফিসসহ তিন শাখা ও এনবিআরে তদন্ত চলমান থাকে। কাগজপত্র ও জিজ্ঞাসা জবাব দিতে গিয়ে সমগ্র কাস্টম হাউসকে উৎকন্ঠা ও বাড়তি চাপের মধ্য ফেলে দেয়া হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তদন্তে ১৫টি অভিযোগের একটিও প্রমাণ না হওয়ায় এ তদন্তের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ! এ নিয়ে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে কাস্টমস ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে।
এদিকে ভুয়া ডিজি পরিচয়দাতা আহসান আলী বেনাপোলে গিয়ে কমিশনারকে অবৈধ তদ্বির ও চাপ দেয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। ভিডিওতে দেখা যায় ২০ লাখ টাকা শুল্ক কম দেয়ার জন্য তিনি কমিশনারকে চাপ প্রয়োগ করছেন। বিভিন্ন সেক্রেটারী তার বন্ধু ও এনবিআর চেয়ারম্যানের পিএসের নাম বলছেন। তাকে দিয়ে ফোন করিয়েছেন। সমগ্র বিষয়টি এখন ‘টক অব এনবিআর’।
বাংলাদেশ বিসিএস আয়কর এসোসিয়েশনের মহাসচিব নুরুজ্জামান খান বলেন, “সেগুন বাগিচা থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব কতো? একজন কমিশনারের বিরুদ্ধে তদšত চালুর আগে আরেকটু দেখেশুনে শুরু করা উচিত ছিল। অভিযোগে ধানমন্ডির যে চারটি বাড়ির ঠিকানা দেয়া হয়েছে, এটা দু ঘন্টায় সরেজমিনে তদন্ত করলে ৯ মাস সময় বাঁচত । সরকারের অর্থ ও জনবল সাশ্রয় হতো। কর্মকর্তারাও উৎকন্ঠা কাটিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারত।”
বাংলাদেশ বিসিএস কাস্টমস ও ভ্যাট এসোসিয়েশনের মহাসচিব সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, “বেনামী অভিযোগ আমলে নিলে এমন হয়। আমরা যেকোন অনিয়মের বিরুদ্ধে। দুদকের অনেকেই জানে, কমিশনারকে হয়রানি করার জন্য এ কাজ আহসান আলী করেছে। দুদক’র কিছু কর্মকর্তা তাকে আশ্রয় পশ্রয় দিয়েছে। বেনপোলের কমিশনারের বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযোগের একটাও প্রমান হয়নি। জরুরী রাজস্ব আদায় করতে হয় কাস্টমস কর্মকর্তাদেরকে। প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে গিয়ে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। একটা ডিজিট ভুল হলে সরকারের বড় অংকের রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে।
বেনাপোল কাস্টম হাউস, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও দুদকের শতাধিক কর্মকর্তা এ বেনামী অভিযোগ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে। ফলাফল, শূণ্য এবং কমিশনার ছাড়াও সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আদায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ৪০০ কর্মকর্তা কর্মচারীর আতংক, দুশ্চিšতা, উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ে। এর নেতিবাচক প্রভাব রাজস্ব আদায়ের ওপর পড়েছে এবং বেনাপোল কাস্টম হাউসের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। সারাদেশে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরী ফোনে বলেন, “আড়াই টন ভায়াগ্রা আটকের আগে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলনা। ৩১টি চালানের শুল্ক ফাঁকির আব্দার না রাখায় আহসান আলী গত ডিসম্বর মাসে দুদকে বেনামী অভিযোগ জমা দেয়। আড়াই মেট্রিক টন ভায়াগ্রা আটকের পরপরই নতুন মাত্রা পায়। ভায়াগ্রা গ্রুপের সাথে মিলে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে আমার পিছনে লাগে। আমি পৌনে দু’বছর ধরে কাজ করছি। দুইশ’র বেশী সংস্কার কাজ করেছি। বাণিজ্য ও যাত্রী সেবার মানোন্নয়নে এসব কাজ করেছি। ফলে পণ্য আমদানি চালান ৩৩ দিনের জায়গায় ১দিনে খালাস হচ্ছে। একজন যাত্রী ২/৩ ঘন্টার স্থলে ১৫মিনিটে নির্বিঘেœ ভারতে যাতায়াত করতে পারছে। আমি দুর্নীতি করি না, পশ্রয়ও দেইনা। গত পৌনে দু বছরে আমার কোন কর্মকান্ড নিয়ে একটি নেতিবাচক সংবাদও পত্র পত্রিকায় প্রকাশ হয়নি। ২৪ জুলাই ভায়াগ্রা আটকের পর আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়। আমি ও আমার সহকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজার কোটি টাকা মূল্যের ভায়াগ্রা আটক করেছি। বেনাপোল কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা বাড়ানো প্রয়োজন।”
আহাসান আলীর বেনামী অভিযোগটি কেবল দুদকের নির্দেশে ৪ জায়গা থেকে তদšত হচ্ছে। একই অভিযোগের এতগুলো তদšত কেন এবং এর পেছনে সরকারের এত জনবল ও কর্মঘন্টার নিয়োজিত করার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ! তবে দুদক কি আহসান আলীর নিয়ন্ত্রণে?
চারটি তদন্তের মধ্যে ২টি দুদক সদর দপ্তর, ১টি দুদকের যশোর বিভাগীয় অফিস ও আরেকটি দুদকের অনুরোধে এনবিআর থেকে হয়। বেনামী অভিযোগটি দুদক যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক নাজমুস সাদাত তদšত করেন। তদšেত বেনামী অভিযোগ ভূয়া প্রমানিত হয়।
ইতিপূর্বে দুদকের অনুরোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের পক্ষে সদস্য ( শুল্ক: নীতি ও আইসিটি) সৈয়দ গোলাম কিবরীয়া বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে বেনামী অভিযোগের তদšত করেন। রাজস্ব বোর্ডের প্রতিবেদনে তাঁর বিরুদ্ধে করা ২৪ টি অভিযোগ ভূয়া প্রমানিত হয়েছে। অভিযোগে তাঁর নামে যেসব বাড়ি ও ফ্ল্যাটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো অন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের শ্বশুর-শাশুড়ির ধানমন্ডির বাড়িও আছে।
এনবিআরের তদšত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সাহাদাত হোসেন নামের এক ব্যক্তি বেনামী অভিযোগ করেছে। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৬ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাসার ঠিকানায় ধানমন্ডির যে হোল্ডিং নম্বর ব্যবহার করেছেন সেটিও তার নয়। যেসব সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ করা হয়েছে, তদšেত সেসব সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের নাম-ঠিকানারও সত্যতা মেলেনি।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়,
বেনামী অভিযোগে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে ৪৮০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির কথা বলা হলেও এ বিষয়ে তদšেত সুনির্দিষ্ট বিল অব এন্ট্রি সংক্রাšত কোনো তথ্য মেলেনি। অভিযোগে শেখ মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নামীয় এক ব্যবসায়ীর মালিকানা হিসেবে মেসার্স ট্রিনা অ্যাসোসিয়েশনের কথা বলা হলেও বা¯তবে ওই ব্যক্তি কোনো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নন।
বেনামীতে অবৈধ সম্পদের অভিযোগে বেলাল চৌধুরীর নামে ধানমন্ডির ১৫/এ, রোড নম্বর-৪-এর ১৫ নম্বর বাড়ির কথা উল্লেখ করা হয়। তদšতকালে দেখা যায়, ওই বাড়ির মালিক ও বসবাসকারী মো. আতিকুল করিম ও পাপ্পু। ওই বাড়িতে একটি ডেভেলপার কোম্পানি রয়েছে।
এছাড়া অভিযোগে ধানমন্ডির ৫ নম্বর রোডের ১৫০ কোটি টাকা মূল্যের ১৫ নম্বর বাড়িটি বেলাল চৌধুরীর নামে উলেখ করা হয়। তদšতকালে ওই বাড়ির মালিকানা হিসেবে স্থানীয় তিন ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। এরা হলেন- উজির আফজাল, নাজির আফজাল ও তৈয়ব আফজাল।
ধানমন্ডির ৫ নম্বর রোডের ১৬ নম্বর বাড়িটিও বেলাল চৌধুরীর নামে অভিযোগে উলেখ করা হয়। তদন্তকালে দেখা যায়, ওই বাড়িটি সাবেক নৌবাহিনীর প্রধান ও তারেক রহমানের শ্বশুর মরহুম মাহবুব আলী খানের নামে। বাড়িটির বর্তমান মালিক সৈয়দ ইকবাল মান্দ বানু। তার দুই মেয়ে জোবায়দা রহমান ও বিন্দু। অভিযোগে বসুন্ধরা জি-ব্লকে ১০ কাঠা জমির ওপর ৭৫ কোটি টাকা মূল্যের ৬ তলা বাড়ির কথা বলা হলেও ওই তথ্যেরও সত্যতা পায়নি তদšত কমিটি।
তবে প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪৫ নিউ ইস্কাটনে যে ফ্ল্যাটে বেলাল চৌধুরী পরিবার নিয়ে বসবাস করেন সেই ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। সেটিও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৮ বছরের ঋণ নিয়ে ২০১২ সালে ক্রয় করা। এগারো বছরের কি¯িত এখনো অপরিশোধিত।
উক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরেক বেনামী অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নেয়ামুল হাসান গাজী তদšত করছেন।
দুদক এর আগে বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণীসহ ৪টি বেনামী তদন্ত করে। ২০০৯ সালে দুদক সদর দপ্তর থেকে সম্পদ বিররণী দেড়বছর চুলচেরা তদন্ত করে তিনি নির্দোষ প্রমানিত হন (দুদক প্রধান কর্যালয়ের স্মারক নং- দুদক/৩১/০৮/চট্রগ্রাম/বি: অনু ও তদšত-১/১২৪৯৫/১(৭); তারিখঃ ১২/০৮/২০০৯ খ্রি:)।
২০১২ সালে আরেক বেনামী অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক দাখিল করে (দুদক প্রধান কর্যালয়ের স্মারক নং- সি/০৩-২০০৪/টা: ফো:-৪/ অ: বি: সেল-১/২৪৬৪৭/১(৫); তারিখঃ ১৮/০৯/২০১২ খ্রি: )
আরেক অভিযোগ অবৈধ সুযোগ সুবিধা দিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ ও শতকোটি টাকার রাজস্ব লোপাটের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়। (মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের স্মারক নং- ০৪.০০.০০০০.৫২১.২৭. ০৩৩.১২.৯৯৭;)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন