নৌপথে আবারো অনিয়মের বলি হয়েছে এক অন্তসত্বা মা ও তার শিশুপুত্র। এনিয়ে গত একমাসে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে ৩টি বড় ধরনের দূর্ঘটনায় ২টি নৌযান ডুবি এবং দুই যাত্রীর মৃত্যু ছাড়াও ১০জনের বেশী আহত হয়েছে। সর্বশেষ সোমবার রাতের প্রথম প্রহরে বরিশাল থেকে ঢাকাগামী যাত্রী বোঝাই ‘এমভি কির্তনখোলাÑ১০’ নৌযানটির ওপর ঢাকা থেকে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়াগামী ‘এমভি ফরহান-৯’ নামের অপর একটি যাত্রীবাহী নৌযান আছড়ে পড়লে দুই যাত্রী নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরো অন্তত ১০জন। হতাহতদের সকলেই কির্তনখোলাÑ১০ নৌযানের লোয়ার ডেক যাত্রী। কির্তনখোলা’র ডান পাশের লোয়ার ডেকের একটি বড় অংশই এ দূর্ঘটনা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। মধ্যরাতের ঐ দূর্ঘটনায় দুটি নৌযানরেই সহশ্রাধীক যাত্রী আতংকিত হয়ে আর্তনাদ শুরু করে দেয়। ঐ সংঘর্ষেও ধাক্কায় বেশীরভাগ কেবিন যাত্রী শয্যা থেকে মেঝেতে পড়ে গিয়ে কমবেশী আঘাত প্রাপ্ত হয়েছেন বলেও জানা গেছে। এমভি ফারহান-৯ নৌযানটি প্রথম শ্রেণীর হলেও তার হুইল হাউজে থাকা কাপ্তেন আলতাফ দ্বিতীয় শ্রেণীর সনদ প্রাপ্ত। এসময় নৌযানটির হুইল হাউজে আরেকজন সুকানীও ছিল। বিধি মোতাবেক নৌযানটি প্রথম শ্রেণীর কাপ্তেন দিয়ে পরিচালন-এর কথা এবং চালক নিয়ন্ত্রন হারিয়েই ঐ দূর্ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে।
রবিবার রাত ৯টার পরপরই বরিশাল থেকে ৫ শতাধীক যাত্রী নিয়ে এমভি কির্তনখোলা-১০ ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। রাত ১টার কিছু আগে বরিশাল ও চাঁদপুরের সীমান্তবর্তি হিজলার উজানে মেঘনা মোহনার কাছে মিয়ারচরের বিকন বাতির কাছে বিপরিত দিক থেকে আসা এমভি ফারহান-৯ কির্তখোলা-১০’এর ওপর আছরে পড়ে। ফারহান ঢাকা থেকে রবিবার সন্ধায় ছেড়ে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া যাচ্ছিল। দুটি নৌযানের একাধীক যাত্রীর অভিযোগ, দূর্ঘটনার সময় ফারহান লঞ্চটি মুলত চালকের নিয়ন্ত্রনে ছিল বলে মনে হচ্ছিল না। কির্তনখোলা ও পেছনে থাকা অন্য নৌযান থেকে বার বার হুইসাল বাজান ও মাইক যোগে ডাকাডাকির পরেও ফারহানের চালক নিয়ন্ত্রন হারিয়ে নৌযানটি নিয়ে কির্তনখোলাÑ১০’এর ডান পাশে সজোরে আঘাত করে। এতে কির্তনখোলা-১০’এর লোয়ার ডেকে থাকা যাত্রী মাহমুদা (২৩) ও তার শিশুপুত্র মমিন(৭) ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। নিহত মাহমুদা ছিল অন্তসত্বা। সে বরিশাল থেকে ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিল।
দূর্ঘটনার সময় মেঘনা অববাহিকায় হালকা থেকে মাঝারী কুয়াশা ছিল। কির্তনখোলাÑ১০’এর কাপ্তেন নুরুল ইসলাম জানান, ‘অনেক দুর থেকেই ফারহান লঞ্চটিকে নিয়ন্ত্রনহীন মনে হচ্ছিল তাদের কাছে। তাই বার বার হুইসাল বাজান সহ ওয়ারলেস যোগে আমরা সতর্ক করছিলাম। কিন্তু তাতে কোন সারা দেয়নি ফারহানের চালক। শেষ পর্যন্ত আমোদের নৌযানটির ওপর আছড়ে পওে বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে ফারহান’। তার মতে, ‘মূলত ঐ ধরনের নৌযান পরিচালন-এর দক্ষতা ও সনদ ছিলনা ফারহান-৯’এর চালকের’।
দূর্ঘটনার পর ঘাতক ফারহান নৌযানটি চালিয়ে পিরোজপুর হয়ে সোমবার দুপুরে ভান্ডারিয়াতে পৌছে চালক। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ফারহান-এর চালক ও তার সহকারী হুইল সুকানীকে আটকে করেনি পুলিশ বা বিআইডব্লিউটিএ। দূর্ঘটনার ব্যপারে কির্তনখোলা কতৃপক্ষও সোমবার বিকেল পর্যন্ত কোন মামলা দায়ের করেনি কোথাও। তবে সকাল ৯টার দিকে কির্তনখোলাÑ১০ ঢাকার সদরঘাটে পৌছার পরে নিহত মা ও শিশপুত্রের লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। দুটি নৌযানের মালিক পক্ষ ও লঞ্চ মালিক সমিত বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে বসেছে বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে কির্তনখোলা নৌযানের সত্বাধিকারীকে টেলিফোনে পাওয়া যায়নি। দূর্ঘটনার ব্যপারে বিআইডব্লিউটিএ একটি তদন্ত টিম গঠন করেছে।
এনিয়ে গত এক মাসে দক্ষিণাঞ্চলে ৩টি বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটল। গত ১৪ ডিসেম্বর রাতে বরিশাল বন্দরের বিপরিতে কির্তনখোলা নদীতে বরগুনা থেকে ঢাকাগামী যাত্রী বোঝাই নৌযান ‘এমভি শাহরুখÑ২’এর আঘাতে ১২শ টন ক্লিংকার বোঝাই ‘এমভি হাজী মোঃ দুদু মিয়া(রঃ)’ ডুবে যায়। ক্লিংকার বোঝাই নৌযানটির সব ক্রুরা নিরাপদে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও নৌযানটি এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্বম বরিশাল নদী বন্দরের নিরাপদ পরিচালন ব্যবস্থা এখনো মারাত্মক ঝুকির মুখে। এমভি শাহরুখ-এর চালকও ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর সনদপ্রাপ্ত। অথচ নৌযানটি ছিল প্রথম শ্রেণীর।
গত সোমবার রাতে বরিশালেরই বানরীপাড়ার সন্ধা নদীতে পিরোজপুর থেকে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী নৌযান ‘এমভি মর্ণিং সানÑ১’এর সাথে সংঘর্ষে স্থানীয় পণ্যবাহী নৌযান ‘এমবি বসুচর’ নিমজ্জিত হয়েছে। প্রায় দেড়শ টন পল্ট্রী ফিড বোঝাই নৌযানটি দূর্ঘটনার সাথে সাথেই ডুবে গেলেও ভাগ্যক্রমে এর চালক ও ক্ররা সাতরিয়ে কিনারায় উঠতে সক্ষম হয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরীন রুটে চলাচলকারী কোন বেসরকারী নৌযান বিধি মোতাবেক বিআইডব্লিউটিএ’র পাইলট নিয়ে চলাচল করছে না। এ সংক্রান্ত আইন কাগজে থাকলেও নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় ও তার অধিনস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তা প্রয়োগে নুন্যতম কোন পদক্ষেপ গ্রহন করছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। উপরন্তু দেশের অভ্যন্তরীন নৌপথে চলাচলকারী বেশীরভাগ নৌযানই বিধি মোতাবেক ‘নেভিগেশন লাইট’গুলো যাথানিয়মে প্রজ্জলিত না করা সহ চলাচলের সময় ‘লুক আউট ডিউটি’তে কোন কর্মী না রাখারও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কুয়াশার মধ্যে নৌযানসমুহ চলাচলে বিধি বিধানও অনুসরন করছেনা বেশীরভাগ বেসরকারী নৌযানসমুহ। নৌ-পথে জারীকৃত সতর্কতা সহ নিরাপদ নৌযান চলাচলে ‘বয়া-বিকন’ সহ নৌ সংকেত ব্যবস্থা অনুসরন না করারও অভিযোগ রয়েছে বেশীরভাগ নৌযানের চালকদের বিরুদ্ধে। এপর্যন্ত যত দূর্ঘটনা ঘটেছে তার বেশীরভাগই বিধি বিধান ভংগের কারনে বলে জানিয়েছেন একাধীক নৌ বিশেষজ্ঞ।
গত ২৪ ডিসেম্বর রাতের শেষ প্রহরে বরিশালের অদুরে চরমেনাই-এর কাছে পথ হারিয়ে ‘এমভি মধুমতি’ নামের যাত্রীবাহী নৌযানটি ডুবো চড়ায় উঠে যায়। প্রায় ১০ঘন্টা পড়ে ভড়া জোয়ারে নৌযনটি চড়া মূক্ত হয়ে নির্ধরিত সময়ের ১২ঘন্টা পরে বরিশালে পৌছে । প্রায় ৫শ যাত্রী নিয়ে বিআইডব্লিউটিসি’র ঐ নৌযানটি ঢাকা থেকে চাঁদপুর হয়ে বরিশালে অসছিল। নৌযানটিতে অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি ছাড়াও প্রথম শ্রেণীর কাপ্তেনও ছিল। কিন্তু বিধি মেনে বিআইডব্লউটিএ’র সংকেত অনুসরন করে নৌ পথ অতিক্রম না করার কারনেই দূর্ঘটনা ঘটে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
এমনকি দেশের অভ্যন্তরীন নৌপথে চলাচলকারী বেসরকারী নৌযান চালকদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমানে বরিশালÑঢাকা সহ বিভিন্ন রুটে দেশের সর্বাধীক দৈর্ঘের প্রথম শ্রেণীর নৌযান যাত্রী পরিবহন করলেও তাতে বিধিমোতাবেক কাপ্তেন নিয়োগ দেয়না নৌযান মালিকগন। ফলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রন হারিয়ে দূর্ঘটনা ঘটছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমান শীতকালে প্রতিরাতেই মেঘনা অববাহিকা ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। পাশাপাশি শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ায় বিভিন্ন চ্যানেলগুলোতে গভীরতা হ্রাসের ফলে তা সরু হয়ে যাচ্ছে। এঅবস্থায় বিঅইডব্লিউটিএ’র তরফ থেকে নিরাপদ নৌ চলাচলের স্বার্থে হালকা কুয়াশায় ধীর গতিতে এবং ঘন কুয়াশায় নৌযানসমুহ নোঙরে রেখে প্রয়োজনীয় বাতি প্রজ্জলন সহ ঘন ঘন ‘ফগ সিগন্যাল ও বেল’ বাজানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতেও বলা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন