শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বাতি আছে জ্বলে না

সিগন্যাল বাতির পেছনে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ : বছরে ব্যয় ১২ কোটি টাকা

নূরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:৩৪ এএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

রাজধানীর গুলিস্তানের যে অংশে ফ্লাইওভারের র‌্যাম্প নেমেছে সেখানে দিনরাত যানজট লেগে থাকে। ফ্লাইওভার থেকে নেমে গাড়িগুলো এলোপাথারিভাবে চলতে গিয়ে জটলার সৃষ্টি হয়। জটলা থেকে যানজট। সিগনাল বাতি আছে, কিন্তু জ্বলে না। ট্রাফিক পুলিশের লাঠির ইশারায় চলে গাড়ি। ব্যস্ততম বিজয় সরণিতে আবার উল্টোচিত্র। সিগনাল বাতি আছে, জ্বলেও। এমনিভাবে রাজধানীর প্রতিটি সড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে রয়েছে লাল, সবুজ ও হলুদ বাতি। কোনো কোনো স্থানে রয়েছে টাইম কাউন্টডাউন যন্ত্রও। সবকিছু থাকার পরও সেখানে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায়। বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেনা ট্রাফিক সিগন্যাল বাতিগুলো কেবল রাস্তায় সাজিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো কাজে আসছে না। কারণ, চলাচলের জন্য যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা হয় ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায়।
জানা গেছে, রাজধানীর যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে ২০১৫ সালের ১৭ মে পরীক্ষামূলকভাবে কাকলী থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ১১টি পয়েন্টে অটোসিগনাল চালু করা হয়। তবে যানজটের শঙ্কায় চালুর পর পরই এগুলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৮ সালের শুরুতে নতুন করে হাতে নেয়া হয় আরো একটি প্রকল্প। নতুন এ প্রকল্পে আগের মতো যন্ত্রনির্ভর না হয়ে যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ট্রাফিক পুলিশের হাতে রাখার কথা বলা হয়। সড়কে গাড়ির চাপ বুঝে রিমোটের সাহায্যে ট্রাফিক পুলিশ নিজেই পরিবর্তন করতে পারবে সিগনালের ব্যাপ্তি। তবে সেই প্রকল্প শেষ হলেও কার্যকর না থাকায় কোনো সুবিধাই পাচ্ছে না রাজধানীবাসী।
ঢাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ চলছে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় চলে গাড়ি। এতে করে কোনো পয়েন্টে একবার গাড়ি আটকালে তা কখন ছাড়া হবে তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশের উপর। তিনি ইশারা না দিলে গাড়ি চলে না। ভুক্তভোগিদের অভিযোগ, ট্রাফিক পুলিশ তাদের খেয়াল খুশি মতো রাস্তার একদিক আটকে রেখে আরেকদিক যান চলাচলের জন্য খুলে রাখে। এতে করে যানজট যেমন বাড়ে তেমনি মানুষের ভোগান্তিও বাড়ে। ভুক্তভোগিদের মতে, সিগনাল বাতি সচল থাকলে এমন অবস্থা হতো না।
সরেজমিনে গুলিস্তান এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ফ্লাইওভার থেকে নেমে মিনি বাসগুলো ডানে ঘুরতে না ঘুরতেই যাত্রী তোলা শুরু করে। এতে করে পেছনের গাড়িগুলো ঘুরতে না পেরে দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তাতে নিমিষেই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ ওই পয়েটে দুই জন ট্রাফিক সার্জেন্ট ছাড়াও কমপক্ষে তিনজন কনস্টেবল দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তারা এক পাশে দাঁড়িয়ে গল্পে ব্যস্ত। আবার ফ্লাইওভার থেকে নেমে কিছুদূর এসে গুলিস্তানের দিকে যাওয়ার জন্য গাড়িগুলো আটকে থাকছে চৌরাস্তার মোড়ে। সেখানে সিগনাল বাতি আছে তবে জ্বলে না। ট্রাফিক পুলিশ লাঠির ইশারায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তিনদিকেই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
ঢাকার ট্রাফিক সিগনাল বাতি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয় করছে দুই সিটি করপোরেশন। তার পরও কাজে আসছে না এ সিগনাল বাতি। বছর বছর বড় অংকের অর্থ ব্যয় করেও এখনো হাতের ইশারায় নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে যানবাহন। এ অবস্থায় সিগনাল বাতির পেছনে ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মিলিয়ে রাজধানীতে সিগনাল বাতি রয়েছে ১০০ পয়েন্টে। এর মধ্যে উত্তরে পড়েছে ৬০টি। বাকি ৪০টি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। ২০০৪ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময় এসব বাতি স্থাপন হয়েছে। সিগনাল বাতির পাশাপাশি স্থাপন হয়েছে ‘টাইমার কাউন্টডাউন’ যন্ত্র। এসব খাতে ব্যয় হয়েছে অর্ধশত কোটি টাকার উপরে।
স্থাপন করার পর থেকে বাতিগুলো সচল রাখতে প্রতি মাসে মোটা অংকের অর্থ খরচ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি পয়েন্টে সিগনাল বাতির বিদ্যুৎ বিল, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে মাসে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ঢাকার সিগনাল বাতিগুলোর পেছনে মাসে ১ কোটি টাকা ব্যয় হলে বছর শেষে এর পরিমান দাঁড়ায় ১২ কোটি টাকা। মাসে কোটি টাকা ব্যয় হলেও এসব সিগনাল বাতি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজে আসছে না। এতে করে প্রায় পুরো টাকাই গচ্চা যাচ্ছে।
সিগনাল বাতি নিয়ে ভুক্তভোগি যাত্রী বা পথচারিদের যেমন ক্ষোভ আছে তেমনি গাড়ির চালকদেরও ক্ষোভ আছে। নারায়ণগঞ্জ রুটের চালক মকবুল হোসেন বলেন, রাজধানীতে অন্তত: ট্রাফিক সিগনাল বাতি আশা করতেই পারি। ট্রাফিক পুলিশের খেয়াল খুশিমতো চলতে গিয়ে বরাবরই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছে। মোড়ে মোড়ে কাউন্টডাউন ঘড়ি বসানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিদেশ থেকে বড় বড় মেহমানরা আসছেন। তারা এসে কি দেখবেন? বাংলাদেশের রাজধানীতে ট্রাফিক বাতি নেই বা জ্বলে না। এটা আমাদের জন্য লজ্জারও বটে। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, সরকার ইচ্ছা করলেই সুন্দর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে পারতো রাজধানীকে। তাতে যাত্রী, চালক, শ্রমিক, মালিক সবাই উপকৃত হতো।
ঢাকার রাস্তায় ব্যাপকভিত্তিক ট্রাফিক সিগনাল বাতি স্থাপন শুরু হয় ২০০৪ সালের পর থেকে। ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয় ৫৯টি সিগনাল বাতি। ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাংকের ঋণসহায়তায় ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (কেস) প্রকল্পের আওতায় স্থাপন করা হয় ১০০টি স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেত ব্যবস্থা। তবে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় এসব সিগনাল বাতি কোনো কাজেই আসেনি। সিগনাল বাতির ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতা, অর্থ ও দক্ষতার অভাবে এসবের সুফল পায়নি রাজধানীবাসী। যে কারণে হাতের ইশারাতেই যান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে এখনো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানীর ট্রাফিক সিগনাল বাতির পেছনেই এখন পর্যন্ত ১০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। এর বাইরে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে ২৫ কোটি টাকায় সাতরাস্তা থেকে উত্তরা পর্যন্ত ১১টি ইউলুপ নির্মাণ করছে ডিএনসিসি। ১৬৫ কোটি টাকায় শাহবাগ, শেরাটন, বাংলামোটর ও সোনারগাঁও ইন্টারসেকশনে আন্ডারপাস নির্মাণের আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকার চারটি সিগনালে স্থাপন করা হচ্ছে ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (আইটিএস)। ফ্লাইওভার, সড়ক, ইউটার্ন, ইন্টারসেকশন, ফুটপাত, ড্রেন, মেট্রোরেল, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট, রেলপথ, বৃত্তাকার রেলপথ, যানজট নিয়ন্ত্রণ ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে গত ১০ বছরে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে সরকার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন