শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভালো বইয়ের বিকল্প নেই

এহসান বিন মুজাহির | প্রকাশের সময় : ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০৫ এএম

জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হলে বই অবশ্যই পড়তে হবে। কেননা, বই যতই পড়া যাবে, বিচিত্র জ্ঞানের ভান্ডার ততই বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বের সেরা মনীষীদের সান্নিধ্য আমরা বইয়ের মাধ্যমেই লাভ করতে পারি। যুগে যুগে মানুষের জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য সাধনার নীরব সাক্ষী বই। এ বিশ্বের বড় বড় জ্ঞানী ব্যক্তিই ছিলেন বইপ্রেমিক। বহু ভাষাবিদ ও বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বই পড়ার প্রতি এত বেশি আসক্ত ছিলেন যে, লাইব্রেরি কক্ষে কর্মচারীরা তার নিবিষ্ট পাঠক মনের উপস্থিতি পর্যন্ত টের পেত না। তাই বহুবার তিনি লাইব্রেরি কক্ষে তালাবন্দি হয়েছেন। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। এটা শেষ পর্যন্ত তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। দিন-রাত বই নিয়েই তিনি নিমগ্ন থাকতেন। তিনি এক দিন পাঠাগারের এক কোনায় বসে বই পড়ছিলেন। একসময় লাইব্রেরিয়ান পাঠাগার বন্ধ করে চলে যান। তিনি তখনও মুগ্ধ হয়ে বই পড়ছিলেন। যত বড় বই-ই হোক, তিনি একবারে শেষ না করে কোনোভাবেই টেবিল থেকে উঠতেন না। পরদিন যথাসময়ে পাঠাগার খোলা হলো। লাইব্রেরিয়ান দেখতে পেলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মগ্ন হয়ে বই পড়ছেন। লাইব্রেরিয়ান অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি সারা রাত পাঠাগারে বন্দি ছিলেন? আর তখনই শহীদুল্লাহর ধ্যান ভেঙে গেল। লাইব্রেরিয়ান লোকটির প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, সে রকম কিছু নয়। আমি তো কেবল বই পড়ছিলাম।
পারস্যের কবি ওমর খৈয়ামের নেশা ছিল বই পড়া। কোনো বই হাতে পেলেই তা পড়ে শেষ করে ফেলতেন। তিনি বলেছেন, ‘সূর্যের আলোতে যেরূপ পৃথিবীর সকল কিছুই ভাস্বর হয়ে ওঠে, তেমনি জ্ঞানের আলোতে জীবনের সব অন্ধকার আলোকোদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আমরা যত বড় বড় জ্ঞানী, সাহিত্যিক, কলামিস্টদের নাম শুনি, তাদের জীবন পড়লে পাওয়া যায়, বই পাঠ এবং সংগ্রহের প্রতি ছিল তাদের ভীষণ আগ্রহ। জ্ঞানী ব্যক্তিরা জ্ঞানের মূল্য বোঝেন তাই তারা বই পড়েন। পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম বেহেশতের উপকরণের মধ্যে বইকেও স্থান দিয়েছেন। কবির ভাষায়, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলা হয়ে আসবে; কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন বলেন, ‘বই-ই জ্ঞানের প্রতীক, বই আনন্দের প্রতীক’। বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির ভাষায়-আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে তার জন্য আমি বইয়ের কাছে ঋণী। শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘বই পড়াকে যে যথার্থ হিসেবে নিতে পারে, সংসারের দুঃখ কষ্টের বোঝা তার অনেকখানি কমে যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে। বিশিষ্ট সাহিত্যিক আল্লামা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রাহ.) ছোটবেলা থেকেই বই পাঠে খুবই আগ্রহী ছিলেন। কোনো বই হাতের নাগালে পেলে পড়ে শেষ করার আগে বসা থেকে উঠতেন না। তিনি ছোটবেলায় কিছু টাকা জমিয়ে বই কেনার জন্য বাজারে রওনা দিলেন। ফার্মেসির দোকানে গিয়ে বললেন, আমাকে একটা বই দিন। এমন ছোট ছিলেন যে, তিনি জানতেন না সব কিছুর দোকান ভিন্ন ভিন্ন। ফার্মেসির দোকানে ওষুধ বিক্রি হয়, আর লাইব্রেরিতে বই বিক্রি হয়। ফলে ডাক্তার একটা ওষুধের লিস্ট তার হাতে দিয়ে অপর হাতে টাকা দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। এমনই ছিল হযরত নদভীর (রাহ). কিশোর জীবন। হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি (রাহ.) জীবনে যত বই পড়েছেন তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তিনি এমন বইপ্রেমিক ছিলেন যে, বই পড়তে পড়তে লাইব্রেরিতেই মৃত্যুবরণ করেন। কোরআনুল কারিমের দিকে দৃষ্টি ফিরালেও আমরা দেখতে পাই বই পাঠের গুরুত্ব।

পবিত্র কোরআনের প্রথম বাণী ছিল- ‘ইকরা’ অর্থ পড়। পড়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে প্রথমে। আর পড়ার মাধ্যম হচ্ছে বই। শুধু পাঠ্যসূচির কয়েকটি বই পড়ে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিতেই জ্ঞানের পূর্ণতা অর্জন করা যায় না। এজন্য বহুমুখী প্রতিভা অর্জন ও বিচিত্র জ্ঞানের জন্য নানা ধরনের বই পড়তে হয়। জ্ঞানার্জনের নির্দিষ্ট বই এবং নির্ধারিত কোনো সময়সীমা নেই। বিখ্যাত ফার্সি কবি শেখ সাদী (রাহ.) এ প্রসঙ্গে বলেন, সমস্ত জীবন জ্ঞানের ওপর লেখাপড়া করে বুঝেছি যে, জ্ঞানের বাতাস গায়ে লেগেছে মাত্র। প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে পারিনি। এটা ছিল জ্ঞানীদের কথা। জ্ঞানরাজ্যের তৃপ্তি মেটানোর জন্য বইয়ের বিকল্প নেই। মানুষের দুই ধরনের ক্ষুধার সৃষ্টি হয়। একটি হলো দৈহিক ক্ষুধা, অন্যটি মানসিক ক্ষুধা। দৈহিক ক্ষুধার চাহিদ সাময়িক এবং সহজলভ্য। মানসিক ক্ষুধার চাহিদা এর সম্পূর্ণ উল্টা। এটা পূরণ করাও খুব কঠিন। জানার জন্য পড়তে হবে। পড়ার প্রধান মাধ্যম হলো বই। কোরআনে এরশাদ হয়েছে- যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি কখনো সমান? না তারা কখনো সমান হতে পারে না। জ্ঞানরাজ্যের ক্ষুধা মেটানোর অন্যতম মাধ্যম হলো বই। বই আত্মার খোরাক জোগায়। বই পড়া হলো অনাবিল আনন্দের অফুরন্ত উৎস। অন্ধকার যেমন আলো ছাড়া দূরীভূত করা যায় না; তেমনি বই ছাড়া কেউ জ্ঞানী হতে পারে না।

আজও জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইউরোপের লোকেরা একটু কাজের ফাঁক পেলেই তারা বই পড়ে সময় ব্যয় করে। এমনকি কাজে যাওয়ার পথে বাসে বা ট্রেনে বসে এই অল্প সময়টুকু বই পাঠে কাটিয়ে দেয়। তাই আজ তারা বিশ্বের কাছে উন্নত জাতি হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে আমাদের সমাজ আজ বইবিমুখ। বই ক্রয় করা এবং পড়ার প্রতি আগ্রহ নেই। আবার সংগ্রহে থাকার পরও পড়ার প্রতি আগ্রহ নেই। আলসেমি করে অবসর সময় কাটান, টিভি, ভিসিআর, ডিস অ্যান্টিনা এবং ইন্টারনেটের মোহে আসক্ত হয়ে এদিকে সময় ব্যয় করেন। বই পড়ার অভ্যাস হ্রাস পাওয়ার কারণেই আজকের ছেলে-মেয়েরা নানা অপরাধ জগতে জড়িয়ে যাচ্ছে। আজকের তরুণ নেশাগ্রস্ত। একাডেমিক পড়াশোনাও ঠিকমতো করছে না। কলেজ-ভার্সিটিতে টেন্ডার আর অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখে তারা সেদিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। মদ-ইয়াবা, হেরোইন, আফিম, গাঁজার প্রতি আসক্তি হয়ে অনৈতিক হয়ে ওঠেছে। বই আমাদেরকে পড়তে হবে। বই পড়ার আনন্দ তখনই সার্থক হবে; যখন বই নির্বাচন সঠিক হবে। ভালো বইকে বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো নিত্যসঙ্গী করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, একটি ভালো বই অনন্ত যৌবনা। অশ্লীল বই বর্জন করতে হবে। কারণ ভালো বই যেভাবে আপনাকে ভালো বানাবে, তেমনি অশ্লীল বই আপনাকে খারাপ বানাবে। তাই কবি বলেন, ‘সৎ লোকের সংস্পর্শ সৎ বানায়, অসৎ লোকের সংস্পর্শ ব্যক্তিকে অসৎ বানায়’। জ্ঞানীরা বলেন, ভালো লোকের সঙ্গে চললে ভালো হওয়া যায়, খারাপের সঙ্গে চললে খারাপ হওয়া যায়। প্রবাদ কথা আছে ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস এবং অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। ভালো বই পড়ে ভালো হওয়া যাবে এবং খারাপ বই পড়লে খারাপ হওয়া যাবে, আর এটাই স্বাভাবিক। বই মানুষের জীবনে এবং চলার পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানবজীবনে ভালো বইয়ের বিকল্প নেই। ব্যক্তি ও পরিবারকে আলোকময় করতে এবং সমাজকে উন্নত করতে বই ও পাঠাগারকে গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন