হোটেল কর্তৃপক্ষ কিছুই জানে না : হাসপাতালের ওয়ার্ডেই গাদাগাদি করে থাকছেন নার্সরা
স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের এক সপ্তাহ পার হলেও এখনো আবাসন সুবিধা পাননি করোনা রোগীদের সেবা দেয়া বেশিরভাগ ডাক্তার-নার্স-টেকনোলজিস্টসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। যারা পেয়েছেন তাদের থাকতে হচ্ছে রুম ভাগাভাগি করে। এভাবে চলতে থাকলে আট দশদিন পর ডাক্তার-নার্স পাওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। হোটেল মালিকরা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত তাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগই করেনি। একই সঙ্গে মানসম্মত খাবার সঙ্কটেও ভুগছেন ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা।
বিশ্বব্যাপি করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার-নার্স-টেকনোলজিস্ট ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। বর্তমান মহামারী থেকে রক্ষা করতে নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছেন রোগীর সেবায়। অথচ মানুষকে বাঁচানো প্রথম সারির এই যোদ্ধারাই স্বাস্থ্য খাতের সমন্বয়হীনতার শিকার। জীবনবাজি রেখে ভয়াবহ ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবায় দিনরাত নিয়োজিত থাকলেও প্রতিটি মুহুর্ত সংক্রমিত হওয়ার অজানা আতঙ্ক তাড়া করছে তাদের। ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ি গতকাল পর্যন্ত করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে ডাক্তার ১২৬ জন ও নার্স ৬২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসক-নার্সরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন কেন জানতে চাইলে ডাক্তারদের নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ) চেয়ারম্যান ডা. মো. শাহেদ রাফি পাভেল ইনকিলাবকে বলেন, খুবই নি¤œমানের সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান করায় ডাক্তার-নার্সরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান নির্দেশিত পিপিই ও এন-৯৫ মাস্ক সঙ্কট রয়েছে। একই সঙ্গে অনেক রোগী করোনার লক্ষণ গোপন করে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। তার সংস্পর্শে এসে চিকিৎসক-নার্সরা আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশে তীব্র হয়ে ওঠা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার সম্মুখ যোদ্ধা ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সংকটের শেষ নেই। অপর্যাপ্ত পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) নিয়েই করোনাযুদ্ধে নামা স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সংকটে পড়ছেন। স্বল্প জনবলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে থাকা-খাওয়ার সংকট। এর বাইরে বিভিন্ন স্থানে মানসিকভাবে নানা পীড়নের শিকার হচ্ছেন ডাক্তার-নার্স। গত শনিবার নারায়ণগঞ্জ করোনা ইউনিটের ডাক্তার-নার্সরা পিপিই পড়া অবস্থায় আড়াই ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন ছিলেন। সেখানে নার্সদের রাখা হয়েছে পুরাতন একটি ডাকবাংলোতে। করোনা ইউনিট ব্যতীত অন্যান্য ইউনিটের নার্সরাও পিপিই না পেয়ে আছেন চরম ঝুঁকিতে।
স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষায় গত ১১ এপ্রিল রাজধানীর মোট ২০টি অভিজাত আবাসিক হোটেলের প্রায় ৬শ› রুমের তালিকা প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। যেখানে থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের হাসপাতালে যাওয়া আসা করার কথা। তবে পরিচয় গোপন রেখে স্বাস্থ্যকর্মীরা বলেন, উত্তরা ও মিরপুরে মাত্র তিনটি হোটেলে কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মীর থাকার ব্যবস্থা হলেও বাকিরা বাসা থেকেই যাওয়া আসা করছেন। এ প্রসঙ্গে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের পরিচালক বলেন, এখন পর্যন্ত তেমন কোনো হোটেল পাইনি। কবে পাবো তাও বলতে পারবো না।
জানা গেছে, করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করা নার্সদের অবহেলা করছে হাসপাতালগুলো। পিপিই ডাক্তারদের জন্য একবার ব্যবহার করার কথা বললেও নার্সদের ক্ষেত্রে ধুয়ে বারবার ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে। পাশাপাশি নার্সদের সাত দিন ডিউটি করার পরে চৌদ্দদিন কোয়ারেন্টাইনে থাকার কথা। অথচ তাদেরকে বলা হচ্ছে সাতদিন কোয়ারান্টিনে থাকতে। এছাড়া থাকা খাওয়াসহ নানা সমস্যা তো আছেই।
এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী এক নার্স বলেন, কুর্মিটোলার দেড়শ নার্স হাসপাতালের একটা ওয়ার্ডের মধ্যে থাকে। ভুক্তভোগী আরেক নার্সিং স্টাফ মোবাইল ফোনে বলেন, প্রত্যেকটা জায়গায় যেসব নার্স আছে, যারা সেবা দিচ্ছেন, তাদের টোটালি আলাদা কোনো জায়গায় রাখা হচ্ছে না। তারা পরিবারের কাছে যাচ্ছে, বাজার ঘাটে যাতায়াত করছে। আমাদের জীবনেরও একটা মায়া আছে। যার কারণে আমরা চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি। আর যারা হোটেল পেয়েছেন তারা বলছেন, করোনা পজেটিভ পেলে তাদেরকে হোটেল থাকতে দেয়া হচ্ছে না। ভুক্তভোগী এক ডাক্তার বলেন, আমার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সকালে অ্যাম্বুলেন্স আসবে, তুমি বাসায় অথবা হসপিটালের তিন তলায় চলে যেও। এখন আমার বাসায় ছোট ছোট তিনটা বাচ্চা আছে, আমরা স্ত্রী আছে। এখন এটা আমরা জন্য একটা অমানবিক আচরণ হয়। ভুক্তভোগী এক নার্স বলেন, আমরা যদি এখন একরুমে তিনজন না থাকি। তাহলে বাসায় চলে যেতে হবে। আমরা সবাই পজেটিভ রোগী নিয়ে কাজ করি বিধায় বাসায় যাওয়াও তো আমার পরিবারের জন্য নিরাপদ নয়। নাম প্রকাশ না করে আরও একজন ডাক্তার বলেন, এই দায়িত্বহীনতার কোনো জবাব নাই। এখন যে অবস্থা, তাতে হয়তো আগামী ৭ দিন ডাক্তার পাওয়া যাবে..।
এ দিকে, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য হোটেল বরাদ্দ প্রসঙ্গে হোটেল মালিক সমিতি বলছে, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে কেউ যোগাযোগ না করায় তারা এখনো কোনো প্রস্তুতি শুরুই করেননি। এমনকি হোটেল মালিক ও হোটেলের নিয়ন্ত্রক সরকারের পর্যটন করপোরেশনও বিষয়টি জানেন না বলে সূত্র জানিয়েছে। এমনকি হোটেল মালিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কোন ধরনের যোগাযোগও করা হয়নি। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল এসোসিয়েশনের সচিব মহসিন হক হিমেল বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে কেউ যোগাযোগ না করায় এখনো কোনো প্রস্তুতি শুরুই করা হয়নি। এমন কি কোনো চিঠিও আসেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে হোটেলগুলোর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- ঢাকা রিজেন্সি, প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, লা মেরিডিয়ান, রেডিসন বøæ ওয়াটার গার্ডেন, রাজমণি ঈসা খাঁ, হোটেল ৭১, হোটেল অবকাশ, হোটেল জাকারিয়া, হোটেল রেনেসাঁ, হোটেল মিলিনা, হোটেল গ্রান্ড প্রিন্স, হোটেল সাগরিকা, হোটেল শালিমার ইত্যাদি। এতে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল এবং কমলাপুরের জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা থাকবেন।
উল্লেখিত হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেওয়া ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখনো তারা ওই সব হোটেলে থাকার ব্যাপারে কোন কিছু জানতে পারেননি। বিভিন্ন মাধ্যমের সংবাদের জেনেছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডাক্তার জানান। তবে কবে থেকে এই হোটেলগুলো ডাক্তার-নার্সদের জন্য ব্যবহার করা যাবে এবং হোটেলগুলোর ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান খান ইনকিলাবকে বলেন, আমরা ২০ টি অভিজাত হোটেলকে বলে রেখেছি। তবে যখন যেখানে করোনা ইউনিট চালু হচ্ছে সেখানকার চিকিৎসক-নার্সদের জন্য প্রয়োজনীয় এক বা একাধিক হোটেলের সঙ্গে কথা বলে থাকার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সকল হোটেলের সঙ্গে এখনো কথা হয়নি। যখন যেটা প্রয়োজন হচ্ছে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হাবিবুর রহমান খান বলেন, করোনার চিকিৎসায় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা হাসপাতালসহ যেসব হাসপাতালে করোনার সেবা কার্যক্রম চালু আছে সেখানকার চিকিৎসক-নার্সদের থাকার সুব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন করে মহানগর হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা চালু হয়েছে। ইতিমধ্যে ওখানকার চিকিৎসক-নার্সদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, কয়দিন আগে দেশের করোনাভাইরাস চিকিৎসার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র রাজধানীর কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালের চিকিৎসকেরা অবস্থান করছিলেন এমন একটি আবাসিক হোটেল থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে রাঁধুনিসহ অনেক স্টাফ পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এতে ওখানে অবস্থানরত ৫৬ জন চিকিৎসককে খাবারের কষ্টে রীতিমত বিপাকে পড়তে হয়। একই সঙ্গে দিনভর করোনা রোগীদের সেবা করার পর একই হাসপাতালের নার্সদের ভাগ্যে জুটছে স্থানীয় একটি হোটেলের রান্না করা নি¤œমানের খাবার। এছাড়া বাজেট না থাকার অজুহাতে গত সপ্তাহে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নার্সদের না খেয়েও কাটাতে হয়েছে। যদিও ওখানকার ডাক্তার-নার্সরা জানিয়েছেন, বর্তমান অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন