শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

যে রোজাদারের পুরস্কার আল্লাহ নিজেই দিবেন

মুহাম্মদ আবুল হোসাইন | প্রকাশের সময় : ৮ মে, ২০২০, ১২:০৬ এএম

রোযা ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্বের একটি। দ্বিতীয় হিজরী শা’বান মাসে রোযা ফরজ করা হয়। ‘রোযা’ শব্দটি ফার্সী ভাষা। আরবীতে ‘সাওম’ বলা হয়। যার বাংলা অর্থ: বিরত থাকা। ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায় সুব্হে সাদিক থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়্যতে যাবতীয় পনাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নামই হল রোযা।
রোযা ফরজ হওয়া নিয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র কুর’আনুল কারীমে ইরশাদ করেন: হে মূমিনগণ! (তোমাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় তোমাদের উপরও রোযা ফরজ করা হয়েছে, যাতে তোমরা তাক্ওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জন করতে পার)। [সূরা বাক্কারা, আয়াত: ১৮৩]। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে: রমজান মাস, যার মধ্যে বিশ্বমানবের জন্য পথ প্রদর্শক এবং সু-পথের উজ্জ্বল নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার মধ্যে প্রভেদকারী কুর’আর অবতীর্ণ করা হয়েছে, অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে সে যেন রোযা রাখে)। [সূরা বাক্কারা, আয়াত: ১৮৫]। হাদীসে এসেছে: “ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি: দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে কালিমা পড়া, নামায কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, হজ¦ আদায় করা ও রমজানের রোযা রাখা”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ০৮]। অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে: “একদা চুল এলোমেলো এক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (দ.)- এর নিকট এসে বলল: ইয়া রাসূলাল্লাহ (দ.)! আমাকে বলুন আল্লাহ আমার উপর কত ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন? প্রতি উত্তরে তিনি বললেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ; কিন্তু তুমি যদি নফল পড় তা স্বতন্ত্র বিষয়। তারপর সে (বেদুঈন) বলল: আমাকে বলুন আল্লাহ আমার উপর কতটি রোযা ফরয করেছেন? প্রতি উত্তরে তিনি বললেন: পুরা রমযান মাসের রোযা; কিন্তু তুমি যদি নফল রাখ তা অন্য বিষয়...”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং:১৮৯১]
এই রমযান হল তাক্ওয়া (খোদাভীতি) অর্জনের মাস। কেননা এই মাসে শয়তানকে সিকল দিয়ে বন্ধী করে রাখা হয়। তাই মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেয়ে আল্লাহর উপসানায় লিপ্ত থাকার সুযোগ পান, যার মাধ্যমে খোদাভীতি অর্জিত হয়। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: “যখন রমজান মাসের আগমন হয় বেহেশতের দরজাসুমহ খুলে দেওয়া হয় এবং দোযখের দরজাসূমহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর শয়তানকে সীকল দিয়ে আবদ্ধ করে রাখা হয়”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ১০৭৯]।
কোন মূমিন যদি দৃঢ় ঈমানের সাথে একমাত্র মহান আল্লাহ’র সন্তুষ্টি লাভের আশায় রোযা পালন করেন, তাহলে দয়াময় ও ক্ষমাশীল আল্লাহ তার পূববর্তী অপরাধগুলো ক্ষমা করে দিবেন। হাদীসে এসেছে, প্রিয় নবী (দ.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজানের রোযা রাখবেন, তাঁহার পূর্ববর্তী গুণাহগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ১৯০১; সহীহ মুসলিম, হদীস নং: ৭৫৯]
রোযাদারের ফযিলত বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর সাওয়াব কত হতে পারে তা স্বয়ং মহান আল্লাহ নিজেই নির্ধারণ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অন্য ইবাদাতের ক্ষেত্রে সাওয়াবের পরিমাণ দশগুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে হাদীসে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু রোযার সাওয়াবের পরিমাণ কত হতে পারে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, বিখ্যাত সাহাবী আবূ হুরায়রাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: “মহান আল্লাহ বলেন: রোযা আামার জন্য রাখা হয় এবং তার প্রতিদান আমি নিজেই দিব। সে পানাহার ও কামভাবকে আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পরিত্যাগ করে থাকে। রোযা হল ডাল স্বরুপ। রোযাদারের জন্য দুইটি খুশীর সময় রয়েছে: একটি হল ইফতারের সময় আর অপরটি হল (বিচার দিবসে) আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। অবশ্যই রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মেসক্ আম্বরের সুগন্ধের চেয়েও উৎকৃষ্ট”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ১৯০৬)
বেহেশতের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের দরজা রয়েছে। ততমধ্যে ‘র্আ-রাইয়ান’ নামক যে দরজা রয়েছে তা একমাত্র রোযাদারের জন্য নির্ধারিত। তারা ব্যতীত অন্য কেউ ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করার অনুমতি পাবেন না। রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: “জান্নাতের মধ্য একটি দরজা রয়েছে যার নাম হল ‘র্আ-রাইয়ান’। কিয়ামত দিবসে একমাত্র রোযাদাররাই ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবেন। তারা ব্যতীত অন্য কেউ প্রবেশের অনুমতি পাবেন না। ঐদিন রোযাদাররা কোথায় বলে যখন ডাকা হবে, তখন তারা সাড়া দিবেন এবং তাদেরকেই ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করানো হবে। তাদের প্রবেশ সম্পন্ন হওয়ার পর ঐ দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে এবং আর কাউকেই ডুকতে দেওয়া হবে না”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ১৮৯৬] অশ্লীল আচরণ, গালমন্দ করা, জগড়া বিবেদ ইত্যাদিতে লিপ্ত হওয়া এমনেই ইসলামে নিষিদ্ধ। আর রোযা অবস্থায় এই ধরনের অপছন্দনীয় কাজে লিপ্ত হলে রোযা রাখার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতি হয়ে যাবে। তাই রোযা অবস্থায় সকল প্রকারের অপছন্দনীয় অচরণ করা থেকে বিরত থাকতে কঠোর ভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: “তোমাদের মধ্যে কেউ যেন রোযা রাখা অবস্থায় অশ্লীল কথা না বলে এবং জাহেলী আচরণ না করে। যদি কোন ব্যক্তি তাকে গালমন্দ করে অথবা জগড়া করতে চায়, তাহলে সে যেন বলে আমি রোযাদার”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ১১৫১]
ইসলামি আখলাকের মধ্যে অন্যতম হল: মিথ্যা বলা, গীবত করা, হিংসা করা, চুরি করা, সূদ খাওয়া, ব্যাভিচারী কাজে লিপ্ত হওয়া, আমানাতের খিয়ানত করা, ওয়াদা ভঙ্গ করা, অবৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জন করা, হারাম খাওয়াসহ সকল প্রকারের অনৈতিক কর্ম থেকে দূরে থাকা। আর এই ধরনের কর্মগুলো কাবীরা গুনাহের অর্ন্তভূক্ত যা তাওবা ছাড়া আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। রোযা রাখার মূল উদ্দেশ্য যেহেতু তাক্ওয়া (খোদাভীতি) অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাই উল্লেখিত সকল প্রকারের অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে রোযা রাখলে তা প্রকৃত রোযা হিসেবে গণ্য হবে না। রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং তদানুযায়ী আমল করা পরিত্যাগ করতে পারল না, রোযার উদ্দেশ্যে তার পানাহার পরিত্যাগ করা আল্লাহর কাছে কোন প্রয়োজন নেই”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ১৯০৩]
হাদীসে কুদুসীর মধ্যে যেই রোযাদারের প্রতিদান আল্লাহ নিজেই দিবেন বলেছেন এবং যেই রোযাদারের জান্নাতে প্রবেশের জন্য ‘র্আ-রাইয়ান’ নামক দরজা বরাদ্ধ রয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে। সেই ধরনের রোযার জন্য বিখ্যাত মুসলিম মনিষীগণ পানাহার ও স্ত্রী সহবাস পরিত্যাগের সাথে সাথে সকল প্রকারের গুণাহ পরিত্যাগেরও শর্ত দিয়েছেন। হিজরী পঞ্চম শতকের বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্বালী (রাহ.) [মৃত: ৫০৫ হি./১১১১ খ্রী.] তার লিখিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘এহ্ইয়া উলুমিদ্দীন’-এ রোযাকে তিনটি স্থরে ভাগ করেছেন: প্রথমত: শুধুমাত্র পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা যাকে সাধারণ রোযা বলা হয়। দ্বিতীয়ত: পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার সাথে সাথে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তথা চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, হাত-পাসহ যাবতীয় অঙ্গকে সকল প্রকারের গুণাহের কাজ থেকে বিরত রাখা যাকে মকবুল রোযা বলা হয় এবং আল্লাহ’র নেক্কার বান্দারা ঐ রোযা রাখার জন্য চেষ্টা করেন। তৃতীয়ত: সকল প্রকারের দুনিয়াবি চিন্তা থেকে বিরত থেকে ক্বলবকে একমাত্র আল্লাহমুখী করে রোযা রাখা, যাকে নবী, শহীদ ও নৈকট্যবানদের রোযা হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি দ্বিতীয় প্রকারের অর্থাৎ মকবুল রোযার জন্য ছয়টি শর্ত উল্লেখ করেছেন: এক: চক্ষুকে সংযত করার মাধ্যমে যাবতীয় গুণাহের কাজ থেকে বিরত রাখা, এটাকে চক্ষুর রোযা বলা হয়। দুই: জিহ্বাকে মিথ্যা, গীবত, অশ্লীলতা, গালমন্দ, জগড়া-বিবেদসহ যাবতীয় পাপকর্ম থেকে বিরত রেখে একমাত্র কুর’আন তেলাওয়াত ও আল্লাহর জিকিরের মধ্যে মগ্ন রাখা, এটাকে যবানের রোযা বলা হয়। বিখ্যাত মুসলিম স্কলার সুফিয়ান সূরী ও মুজাহিদের মতে গীবত ও মিথ্যার কারণে প্রকৃত রোযা ভঙ্গ হয়। তিন: কর্ণকে সকল প্রকারের গুণাহ থেকে বিরত রাখা। চার: হাত-পাসহ শরীরের যাবতীয় অঙ্গকে গুণাহের কাজ থেকে দূরে রাখা ও ইফতার-সাহ্রীর সময় হারাম পানাহার থেকে পেটকে বিরত রাখা। পাঁচ: ইফতারের সময় পেটভর্তী পানাহার পরিহার করা। কারণ, অধিক পানাহার শরীরকে অলসতায় পরিণত করে যা রোযাদারকে ইবাদাত করা থেকে নিরুৎসাহিত করে। ছয়: ইফতারের পর রোযা শেষ হওয়ার কারণে আনন্দ পরিহার করে আল্লাহর ভয়ে নত হয়ে থাকা। কারণ, তাঁহার রোযা অল্লাহ’র দরবারে কবুল হয়েছে কিনা তিনি জানেন না। এই ছয় প্রকারের শর্ত মেনে রোযা রাখাকে প্রকৃত রোযা বলা হয়।
বিখ্যাত সূফী সাধকগণ গুণাহ পরিত্যাগের মাধ্যমে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রোযার পাশাপাশি ক¦লবের রোযাকেও মকবুল রোযার জন্য শর্ত প্রদান করেছেন। অর্থাৎ পানাহার, কামভাব ও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুণাহ থেকে বিরত রাখার সাথে সাথে ক্বলবকে (অন্তর) দুনিয়ার লোভ-লালসা থেকে বিরত রেখে সর্বদা আল্লাহমুখী হওয়ায় হল প্রকৃত রোযা। আর হাদীসে কুদুসীতে এই রোযাকেই আল্লাহ নিজের জন্য আখ্যায়িত করে ইহার পুরস্কার নিজেই দিবেন বলে ঘোষণা করেছেন এবং কিয়ামত দিবসে এই রোযাদারকেই মহান আল্লাহ তার সাক্ষাত প্রদান করে জান্নাতের ‘র্আ-রাইয়ান’ নামক দরজা দিয়ে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করবেন।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই ধরনের রোযা রাখার তৌফিক দান করুক। আমিন!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
প্রফেসর মো. মজিদুল ইসলাম ১ এপ্রিল, ২০২২, ৬:০৭ পিএম says : 0
আপনি লিখেছেন রোজা ডাল স্বরূপ। তা কি ধরণের ডাল? মসুর ডাল, মুগডাল, খেসারি ডাল নাকি বুটের ডাল?
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন