শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

“মিরাজ” শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ মু’জিযা

মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী | প্রকাশের সময় : ২৬ জুন, ২০২০, ১২:০১ এএম

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, পবিত্র সেই সত্তা যিনি রাতের বেলায় স্বীয় বান্দাকে ভ্রমন করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারপাশে আমি রেখে দিয়েছি বরকত সমূহ, যাতে করে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা (সূরা বনি ইসরাঈল)।
হযরত মুহাম্মদ (স.) এর বয়স যখন ৪৩ বছর তখনই তিনি মি’রাজের আলোকময় মর্যাদায় ভূষিত হন। হাদিস বিশারদগণ বলেন, নবুওয়তের ৩য় বছর পরে রজব মাসের ২৭তারিখ সোমবার তিনি মি’রাজে যান। আল্লাহ তাআলা জিবরাঈল (আঃ) আদেশ দিয়ে বলেন, জিবরাঈল বেহেস্তের দারোগাকে বল উত্তমরূপে বেহেস্তকে সাজাতে, হুর-গিলমানকে বলে দাও সর্বত্তোম পোশাক ও অলংকারে বিভূষিত হতে। জাহান্নামের আগুনকে বলে দাও আগুন নিভিয়ে যেতে। সমস্ত কবরের আজাব আজ রাতের জন্যে মওকুফ কওে দাও। অতপর বেহেস্ত থেকে বোরাক নিয়ে এসো। সুবহানাল্লাহ
প্রখ্যাত সাহাবি হযরত আবু সায়ীদ খুদরীর (রা.) এর বর্ণনায় আছে, নবী (স.) বলেন, আমি যখন বাইতুল মুকাদ্দাসের কর্মসূচি থেকে অবসর পেলাম, তখন একটি সিঁড়ি আমার কাছে আনা হল। এর চেয়ে সুন্দর জিনিস আমি কখনো দেখিনি। এটাই এমন সিঁড়ি যার দিকে মরণাপন্ন ব্যক্তি চেয়ে থাকে, যখন তার কাছে মরণ হাজির হয়। অতঃপর ফেরেস্তাদের শ্রদ্ধার জিবরাঈল (আঃ) আমাকে তাতে চড়িয়ে দিলেন। পরিশেষে আমি আকাশের দরজাগুলোর মধ্যে একটি দরজার কাছে পৌঁছলাম। যার নাম বা-বুল হাফাযাহ্ তথা সংরক্ষিতকারীদের দরজা। তাতে একজন ফেরেশতা আছে। যার নাম ইসমায়ীল। তার অধীনে বার হাজার ফেরেশতা আছে। ওদের মধ্যকার ফেরেশতার অধীনে বার হাজার করে ফেরেশতা আছে (সীরাতি ইবনে হিশাম ১ম খন্ড)। রাসুল সা এর অন্যতম সাহাবি হযরত আনাস (রা.) বর্নিত, নবী (স.) বলেন, যখন আমি মিরাজে পালনকর্তা এবং মূসা (আ.) এর মাঝে আসা-যাওয়া করছিলাম তখন একবার আল্লাহ তাআলা বললেন, হে মুহাম্মদ (স.) এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ দিন ও রাতে থাকলো। প্রত্যেক নামাজের জন্য দশ নেকী। তাই যে ব্যক্তি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে তাকে পঞ্চাশ ওয়াক্তের পুণ্য দেয়া হবে।
মিরাজ সম্পর্কে তাফসিরে বাইহাকীর বর্ণনায় আছে, রাসূল সা. বলেন, জিবরাঈল (আঃ) যখন আমাকে নিয়ে আকাশের দরজা খোলার প্রার্থনা করলেন। বলা হল, কে? তিনি বললেন, জিবরাঈল (আঃ)। আবার বলা হল, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (স.)। আবার বলা হল, তাঁর কাছে লোক পাঠানো হয়েছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর আদম (আ.) কে সেই আকৃতিতে দেখা গেল যে-আকৃতিতে আল্লাহ তাআলা তাকে প্রথম দিনে সৃষ্টি করেছিলেন (তাফসীর ইবনে কাসীর ৩য় খন্ড)। তারপর আমাকে ২য় আসমানে চড়ানো হল। অতঃপর জিবরাঈল দরজা খোলার প্রার্থনা করলেন। তখন বলা হল, আপনি কে? তিনি বললেন জিবরাঈল (আঃ)। বলা হল, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (স.)। বল হল, তার কাছে (দূত) পাঠানো হয়েছে কি? তিনি বললেন, পাঠানো হয়েছে। অতঃপর আমাদের জন্য দরজা খোলা হল। রাসূল সা. বলেন, হঠাৎ আমি দুই ভাইকে পেলাম। তারা হলেন, ঈসা ইবনে মারয়্যাম এবং ইয়াহ্ইয়া ইবনে যাকারিয়্যা। তারা দু’জন আমাকে স্বাগতম জানালেন। (মুসলিম, ১ম খন্ড)। তারপর আমাকে নিয়ে জিবরাঈল (আঃ) ৩য় আসমানে চড়লেন। অতঃপর দরজা খোলার আবেদন করলেন। বলা হল কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ (স.)। বলা হল, তার কাছে দূত পাঠানো হয়েছে কি? তিনি বললেন হ্যাঁ। এবার বলা হল তাঁকে স্বাগতম। অত:পর কি সুন্দর আগমন এটা। তারপর দরজা খোলা হল। অত:পর যখন আমি ৩য় আসমানে পৌঁছলাম তখন ইউসুফকে পেলাম। জিবরাঈল (আঃ) বললেন, ইনি ইউসুফ। তিনি সালামের জওয়াব দিলেন, তারপর বললেন, নবী সা. কে স্বাগতম! (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত)।
অন্য বর্ণনায় আছে, ইউসুফকে দুনিয়ার অর্ধেক সৌন্দর্য দান করা হয়েছে। আর এক বর্ণনায় আছে, তিনি পূর্ণিমার চাঁদের মত (মুসলিম ১ম খন্ড) । তারপর একে একে চতুর্থ আকাশে হযরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আকাশে হযরত মুসা (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তারপর সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ হলে জিবরাঈল (আঃ) বললেন, ইনি আপনার বংশ পিতা। তারপর আমাকে সিদ্রাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত তোলা হল। অত:পর হঠাৎ দেখলাম, ওর ফলগুলো বড় বড় কলসির মত এবং ওর পাতাগুলো হাতীর কানের মত। তিনি বললেন, এটা সিদ্রাতুল মুন্তাহা। ওখানে ৪টি নদী আছে। দুটি নদী ভেতরমুখী এবং দুটি নদী বাহিরমুখী। আমি বললাম, এ দুটি কি? হে জিবরাঈল! তিনি বললেন, ভেতরমুখী দুটো জান্নাতের মধ্যকার নদী। আর বাহিরমুখী দু’টি (মিসরের) নীল এবং (ইরাকের) ফোরাত নদী। তারপর আমার জন্য বাইতুল মা’মূরকে তোলা হল। তারপর আমার কাছে কিছু পাত্র আনা হল- মদের পাত্র ও দুধের পাত্র এবং মধুর পাত্র। আমি দুধটাকে ধরলাম। জিবরাঈল (আঃ) বললেন, এটাই তো প্রকৃত স্বভাব যার ওপরে আপনি আছেন এবং আপনার উম্মতও আছেন (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত)। অন্য বর্ণানায় আছে, জিবরাঈল (আঃ) বলেন, বাইতুল মামূর এমন ঘর যাতে প্রত্যেক দিন সত্তর হাজার ফেরেশ্তা নামাজ পড়েন তারপর কেয়ামত পর্যন্ত তারা ফিরে আসার সুযোগ আর পায় না। তারপর আমাকে সিদরাতুল মুন্তাহার দিকে তোলা হল। এর মধ্যে একটি ঝর্ণাও আছে। যার নাম সাল্সাবীল তা থেকে দুটি স্রোতধারা বের হচ্ছে। একটির নাম কাওসার এবং অপরটির নাম নাহ্রুর। অত:পর তাতে আমি গোসল করলাম। অত:পর আমি কতিপয় নহরধারা দেখলাম স্বচ্ছ পানির এবং কতিপয় নহর দুধের। যা পানকারীদের জন্য মজাদার এবং কতিপয় নহর খাঁটি মধুর। আর পাখীগুলো যেন বড় বড় উটের মত। রাসূল (স.) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তার সৎ বান্দাদের জন্য এমন জিনিস তৈরি করে রেখেছেন যা কোন চোখ দেখেনি এবং কোন কান শোনেনি। আর কোন মানুষের মনের কল্পনায়ও তা আসতে পারে না। তারপর আমার সামনে জাহান্নাম পেশ করা হল। তার মধ্যে আল্লাহর গজব ও রাগ এবং তার শাস্তি রয়েছে। তার মধ্যে যদি পাথর ও লোহা ফেলা হয় তাহলে সে ওটাকে খেয়ে ফেলবে। তারপর আমাকে সিদ্রাতুল মুন্তাহায় তোলা হল। তার প্রত্যেকটি পাতায় একটি করে ফেরেশতা আছে।
হযরত আবূ যর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (স.) বলেন, ৭ম আসমানের ওপরে আমাকে চড়ানো হলে আমি সেই জায়গাটায় চড়লাম, যেখানে আমি ফেরেশতাদের কলম চালানোর আওয়াজ শুনতে পাই (বুখারী, কিতাবুস সলাত ১ম খন্ড, ৫৪ পৃষ্ঠা)। তিনি বলেন, মেরাজে রজনিতে আমার ওপরে প্রত্যেক দিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হল। তারপর আমি নেমে এলাম। পরিশেষে মূসার কাছে পৌঁছলাম । মূসা আ. আমাকে বললেন, আপনাকে কি নির্দেশ দেয়া হল? আমি বললাম, দিন ও রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন, আপনার উম্মত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ দিন ও রাতে পড়তে পারবে না। কারণ, আল্লাহর কসম! আমি আপনার আগে লোকদেরকে পরীক্ষা করেছি এবং বণী ইসরায়ীলকে কঠিনভাবে যাচাই করেছি। তাই আপনি আপনার পালনকর্তার কাছে ফিরে যান। অত:পর আপনার উম্মতের জন্য তা হাল্কা করার প্রার্থনা করুন। ফলে আমি ফিরে গেলাম। অত:পর আমার নামাজ দশ ওয়াক্ত কমিয়ে দেয়া হল। এমনিভাবে পাঁচবার প্রার্থনা করায় পঞ্চাশ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত করা হয় (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত)। আনাস (রাঃ) হতে বর্নিত, যখন আমি পালনকর্তা এবং মূসার মাঝে ফেরাফেরী করছিলাম তখন একবার আল্লাহ তাআলা বললেন, হে মুহাম্মদ (স.) এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ দিন ও রাতে থাকলো। প্রত্যেক নামাজের জন্য দশ ওয়াক্ত নামাজের নেকী। তাই যে ব্যক্তি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে তাকে পঞ্চাশ ওয়াক্তের পুণ্য দেয়া হবে। (মুসলিম, ১ম খন্ড, মিশকাত)।
তাই আসুন ইমামুল আম্বিয়া মুহাম্মদ (স.) কে আল্লাহ তায়ালা অসীম কুদরতের ক্ষমতায় সপ্তাকাশ ভ্রমণ করিয়েছেন, কাল কিয়ামতে আমরা যেন তার শাফাআত লাভে ধন্য হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারি সর্বদা এই দুআ করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন