মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪৩০, ০৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

মুয়াজ্জিনদের মর্যাদা ও কর্তব্য

নূর মুহাম্মদ রাহমানী | প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

আজান ইসলামের অন্যতম শিয়ার বা নিদর্শন। এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম স্বীকৃত একটি বিষয়। এজন্য মুয়াজ্জিনেরও রয়েছে অনেক উঁচু মর্যাদা। এ পদের অধিকারীদেরকে ইজ্জত-সম্মানের চোখে দেখা অবশ্য কর্তব্য। কারণ এটি কোনো চাকরি নয়; বরং ইসলামের সুমহান একটি খেদমত। মুয়াজ্জিন যেভাবে আজানের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার বড়ত্বের ঘোষণা করে এবং তাঁর একত্ববাদের স্তুতি গায়, তার প্রতিদান-বিনিময়ও আল্লাহ এমনভাবে দেবেন যে, কিয়ামতের দিন সে সবার ওপর মর্যাদার অধিকারী হবে। তার বিশেষ অবস্থান হবে। এদের জন্য আল্লাহতায়ালার খাস রহমত ও পুরস্কার রয়েছে। ফজিলতগুলো জানলে সবার মনেই অবশ্যই আকাঙ্খা হবে যে, যদি ইমাম, মুয়াজ্জিন হতে পারতাম! অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আমাদের সমাজে ইমাম, মুয়াজ্জিনদের সাথে খারাপ আচরণ করা হয়। তাদেরকে হ্যায় দৃষ্টিতে দেখা হয়। অবস্থার এত অবণতি যে, ধর্মপ্রাণ সচেতন লোকগুলো থেকেও ইমামতি ও মুয়াজ্জিনিকে নীচু দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ইমামকে একটু মর্যাদা দিলেও মুয়াজ্জিনকে তো কোনোই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাদের থেকে ভুল-ত্রু টি প্রকাশ পেতে পারে, তাই বলে এদের সাথে শক্ত ভাষায় কথা বলা চরম অন্যায়। তাদেরকে ছোট করা মানে ধর্মকে ছোট করা। মসজিদের দায়িত্বশীল ছাড়াও কিছু কিছু পন্ডিত শ্রেণির মুসল্লিকেও ইমাম মুয়াজ্জিনদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে দেখা যায়। এগুলো চরমভাবে সমাজে থাকার কারণে সাধারণ মুসলমানগণ ইমাম, মুয়াজ্জিন হওয়ার সদিচ্ছা ত্যাগ করে দুনিয়াবি কাজে লেগে যান। যারা এ ধরনের অনৈতিক কাজ করেন, তাদের অবশ্যই এ ধরণের কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকা উচিত। নতুবা কিয়ামতের দিন কঠিনভাবে পাকড়াও হতে হবে মহান আল্লাহর কাছে।

নবীজির অসংখ্য-অগণিত হাদিসে মুয়াজ্জিনদের অনেক মর্যাদার কথা বলা হয়েছে।
নামাজের সময় নির্ধারণ : নামাজের সময় নির্ধারণ মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব। তিনি আমানতের সাথে সময়ের প্রতি লক্ষ রেখে আজানের দায়িত্ব পালন করবেন। এতে অন্য কেউ নাক গলানো কাম্য নয়। হাঁ মুয়াজ্জিন সাহেব প্রয়োজনে ইমাম সাহেবের সাথে পরামর্শ করতে পারেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, মসজিদের ইমাম হলো মুসল্লিদের জন্য জিম্মাদার এবং মুয়াজ্জিন আমানাতদারস্বরূপ। হে আল্লাহ! তুমি ইমামদের সৎপথ প্রদর্শন কর এবং মুয়াজ্জিনদের ক্ষমা কর।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০৭) হাদিসের শেষাংশে রয়েছে যে, নবীজি (সা.) মুয়াজ্জিনদের জন্য বিশেষভাবে মাগফিরাতের দোয়া করেছেন যে, হে আল্লাহ আজানে তাদের কোনো রকম ভুল হলে মাফ করে দেন।

বেতন- ভাতা : বেতন-ভাতা ছাড়া আজানের মতো সুমহান খেদমত করতে পারলে ভালো। উসমান ইবনে আবুল আস (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর নিকট বললাম, আমাকে আমার গোত্রের ইমাম নিযুক্ত করুন। রাসুল (সা.) বললেন, তোমাকে তাদের ইমাম নিযুক্ত করা হলো। তুমি দুর্বল ব্যক্তিদের প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখবে এবং এমন এক ব্যক্তিকে মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করবে-যে আজানের কোনোরূপ বিনিময় গ্রহণ করবে না।’ (মুসলিম, হাদিস : ৫৩১) বেতন-ভাতা ছাড়া ইমামতি-মুয়াজ্জিনি করা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। কেউ নিতে চাইলে এতে আপত্তির সুযোগ নেই। বরং একজন ইমাম মুয়াজ্জিনকে সর্বোচ্চ সম্মানী দেওয়া একান্ত কর্তব্য। অনেক মসজিদেই লক্ষ্য করা যায় যে, মসজিদে দামী দামী জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়, প্রতিমাসে মোটা অংকের ব্যয়বহুল খরচ করা হয়, কিন্তু ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতনের বেলায় ওয়াজ শুরু হয়ে যায়। এ লোকগুলো আসলে মসজিদের টাকা সাশ্রয় করছে এমন নয়, বরং তারা নিজেদের ওপর বালা-মুসিবত টেনে আনছে। চিন্তা করার বিষয় যে, গ্রামে একজন মজদুর যেখানে মাসে অন্তত সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা রোজগার করে সেখানে দীন-ধর্মের ধারক-বাহক ইমাম-মুয়াজ্জিন যারা জীবন-যৌবন ব্যয় করে মসজিদে পড়ে থাকেন, উম্মতের কল্যাণের ফিকিরে সময় কাটান, তাদের সঙ্গে একি আচরণ! কিভাবে ৫/৭ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়!

এজন্য ইমাম-মুয়াজ্জিন সাহেবদের বেতনের বিষয়টি বিবেচনা করাসহ মসজিদের যাবতীয় উন্নয়ণের জন্য যুব শ্রেণীকে দায়িত্ব দেওয়া দরকার এবং তারা নিজেরাও এ মহৎ কাজে এগিয়ে আসা কাম্য।
মুয়াজ্জিনের আজানের সাক্ষ্য : কিয়ামতের দিন মানুষ জিন সবাই মুয়াজ্জিনের আজানের সাক্ষ্য দেবে। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, যেকোনো মানুষ ও জিন অথবা অন্য কিছু মুয়াজ্জিনের স্বরের শেষ রেশটুকুও শুনবে, সে কিয়ামতের দিন তার জন্য সাক্ষ্য দেবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০৯)

মাগফিরাতের দোয়া : মুয়াজ্জিন মাগফিরাতের অনেক দোয়া পায়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত একটি বর্ণনায় রয়েছে, ‘মুয়াজ্জিনের আওয়াজ যতটুকু পৌঁছে সেখান পর্যন্ত যারা তার আওয়াজ শুনে সবাই তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করে।’ (আল মুজামুল কাবির, হাদিস : ১৩৬৯)

কিয়ামতের দিন দীর্ঘ ঘাড়বিশিষ্ট হবে : হজরত মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন মুয়াজ্জিনরা সর্বাপেক্ষা দীর্ঘ ঘাড়বিশিষ্ট হবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৩৮৭)

সাত বছর আজান দেওয়ার ফজিলত : হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সওয়াবের উদ্দেশ্যে সাত বছর আজান দেবে তার জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তির পরওয়ানা লিখে দেওয়া হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০৬)

বারো বছর আজান দেওয়ার ফজিলত : বারো বছর আজান দিলে বেহেশত নির্ধারিত। হজরত ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে বারো বছর আজান দেয়, তার জন্য জান্নাত নির্ধারিত হয়ে যায় এবং তার জন্য লেখা হয় তার আজানের বিনিময় প্রত্যহ ষাট নেকি, আর প্রত্যেক ওয়াক্ত ইকামতের বিনিময় ত্রিশ নেকি।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৭২৮)

আজান দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ যদি আজান ও প্রথম কাতারের সওয়াবের কথা জানত, তাহলে লটারি করে হলেও তা অর্জনের চেষ্টা করত।’ (বুখারি, হাদিস : ৬১৫; ২৬৮৯)

মুয়াজ্জিন মিশকের স্তুপের ওপর থাকবে : হাদিস শরিফে এসেছে, তিন ব্যক্তি মিশকের স্তুপের উপর থাকবে। হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, তিন ব্যক্তি কিয়ামতের দিন মিশকের কস্তুরীর স্তুপের উপর থাকবে। ১. যে ক্রীতদাস আল্লাহ ও তার প্রভুর হক ঠিকমত আদায় করে। ২. যে ব্যক্তি কোনো কওমের ইমামতি করে আর তারা তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং ৩. যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য প্রত্যেক দিন ও রাতে আজান দেয়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৮৬) কিয়ামতের দিন উল্লেখিত তিন শ্রেণির লোককে মিশকের স্তুপে আল্লাহ এজন্য রাখবেন যে, এরা দুনিয়ার জীবনে নিজেদের কামনা-বাসনাকে পরিত্যাগ করে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসুলের (সা.) নির্দেশনাগুলোকে মাথা পেতে নিয়েছিল। এজন্য মহান আল্লাহ বিনিময়ে তাদের খোশবুর আকৃতিতে বিরাট প্রতিদান দেবেন যাতে অন্যান্য লোকদের ওপর তাদের মর্যাদা প্রমাণিত হয়।

এজন্য যখনই সুযোগ মিলবে আজান দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা উচিত। বহু ধর্মীয় জ্ঞানবান ব্যক্তিরাও আজান দিতে চান না। এটাকে লজ্জাকর মনে করেন। অনেক ইমাম-খতিবদের আজান দিতে বললে তারা এক রকম রাগ করে বসেন। অনেকে তো পুরো ইমাম-খতিবির জীবনে একবারও আজানের মাইকের সামনে যান না। মুয়াজ্জিন না থাকলে সাধারণ মুসল্লিকে আজান দিতে বলেন। তাও নিজে এটাতে অগ্রসর হন না। এটা খুবই খারাপ কথা। এ ধরনের মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

মুয়াজ্জিনদের কর্তব্য : আজান দেওয়া যেহেতু একটি উৎকৃষ্ট পেশা। দীনের সুমহান খেদমত। এজন্য এটাকে খেদমতের মানসিকতা নিয়েই গ্রহণ করা উচিত। আমানতের সাথে সব দায়িত্ব পালন করা। শুধুমাত্র আজানের জিম্মাদারি পালন করে ক্ষ্যান্ত না হওয়া। এলাকার মানুষের পেছনে মেহনত করা। তাদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। নামাজের দাওয়াত দেওয়া। মাঝে-মঝ্যে সম্ভব হলে মুসল্লি ভাইদেরকে নিয়ে তাবলিগ জামাতে বের হওয়া। মসজিদে বাচ্চাদের সবাহি মকতব চালু করা। বড়দের জন্য বয়স্ক শিক্ষা চালু করা। নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় এমন কাজ না করা। অযথা চা স্টল, দোকান ইত্যাদিতে বসে আড্ডা না দেওয়া। এ কাজগুলো করলে আশা করা যায়, মানুষ আপনাদের কাছে ভিড়বে। আপনাদের সম্মান করবে। আপনাদের কথার প্রতি গুরুত্ব দেবে। মসজিদের যেকোনো প্রয়োজনে সাড়া দেবে। ব্যক্তিগতভাবেও আপনারা অসুবিধায় পড়লে মুসল্লিরা বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়াবে। সবমিলিয়ে আদর্শ সুন্দর একটি সমাজ বিণির্মান হবে।
লেখক : উস্তাযুল হাদিস ওয়াল ফিকহ, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন