শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জায়নবাদী টার্গেট কিলিং এবং পারমাণবিক হুমকি সম্পর্কে বিশ্বসম্প্রদায়ের নীরবতা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

প্রথম মহাযুদ্ধের ধাক্কায় মধ্যপ্রাচ্য ও ইসলামি দুনিয়া এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সে এলোমেলো অবস্থাকে লুটেপুটে খাওয়ার ব্যবস্থায় পরিনত করা হয়েছিল। ফিলিস্তিনী আরবদের ভ’মি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং সে অবৈধ রাষ্ট্রটিকে বিশ্বের অন্যতম অপরাজেয় আঞ্চলিক শক্তিতে পরিনত করার টার্গেট নিয়েই নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক এজেন্ডা গ্রহণ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য কায়েম হলেও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের নীলনকশা প্রণীত হয়েছিল ১৯১৬ সালে সাইক্স-পাইকট চুক্তির মধ্য দিয়ে। বৃটেন, ফ্রান্স, ইতালীর সমঝোতার র্ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগাভাগি করে শাসন করাই ছিল সে চুক্তির মূল লক্ষ্য। পরবর্তি একশ বছরে বিশ্বের অনেক পরিবর্তন ঘটলেও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বিবর্তনে তেমন কোনো হেরফের ঘটেনি। তবে ইস্পাত কঠিন নিয়ন্ত্রণ ও নির্মম আগ্রাসনের স্টিমরোলার চালিয়েও ফিলিস্তিনের জাতীয় ইস্যু ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। দুনিয়ার অধিকাংশ জাতি ফিলিস্তিনের স্বাধিকারের দাবির প্রতি সমর্থন প্রকাশ করার প্রেক্ষাপটে ইস্যুটিকে স্থায়ীভাবে মুসলমানদের হাতছাড়া করতে নতুন ফন্দি-ফিকিরের আয়োজন শুরু হয়েছিল বহু আগেই। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের সাথে সাথে ইসলাম ও মুসলমানদের নতুন হুমকি হিসেবে দাঁড় করিয়ে পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের(এমআইসি) স্বার্থ রক্ষায় যে সব অস্ত্র বিক্রি ও সামরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করা হয়েছে, নতুন নতুন ওয়ার ফ্রন্ট খোলা হয়েছে তার সবই করা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলমানদের টার্গেট করে। গত এক দশকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যে পরিমান অস্ত্র বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে, এর আগে গত ৫০ বছরেও তা হয়নি। সিরিয়া যুদ্ধ, ইয়েমেন যুদ্ধ, লিবিয়া যুদ্ধের মত ঘটনাগুলো কোনো আঞ্চলিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দ্ব›দ্ব-সংঘাতের বিষয় নয়। এগুলো মূলত পশ্চিমাদের মার্সেনারি গ্রæপের প্রক্সিতে সৃষ্ট ফল্স ফ্লাগ ও হাইব্রিড যুদ্ধ। আল কায়েদা, তালেবান বা আইএস সৃষ্টির পেছনেও সিআইএ’র ভ’মিকা এখন ওপেন সিক্রেট। এসব গ্রæপের নেটওয়ার্ক দমনের নামে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে ন্যাটোর সামরিক আগ্রাসনের চুড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ম্যধ্যপ্রাচ্যকে ডি-স্ট্যাবিলাইজ করে ফিলিস্তিনের সংগ্রামকে নস্যাৎ করা এবং মধ্যপ্রাচ্যে যে কোনে স্বাধীন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির উত্থানের সম্ভাবনাকে সমূলে ধ্বংস করা।

সাইক্স-পাইকট চুক্তির শত বছরে এসে ইতিহাসের নজিরবিহীন সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটে পতিত হয় মধ্যপ্রাচ্য। সিরিয়া যুদ্ধে বাশার আল আসাদের রিজিম পরিবর্তনে ব্যর্থ হওয়া এবং হামাস ও হেজবুল্লাহ যোদ্ধাদের সাথে ইসরাইলী বাহিনীর একাধিকবার কৌশলগত পরাজয় মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলে পশ্চিমাদের পরিকল্পনায় বড় ধরণের ছন্দপতন ঘটিয়ে দেয়। ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সব অপূর্ণতা পাশ কাটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জায়নবাদের নতুন শতাব্দীর সূচনা নিশ্চিত করতে চরমপন্থী তৎপরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইরানের সাথে ৬ জাতির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি থেকে একপাক্ষিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া, ফিলিস্তিন সমস্যার দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের পুরনো কমিটমেন্ট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারির ভ’মিকা থেকে ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী নীতির প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন জানানো এবং জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মত হঠকারি সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হওয়ায় জায়নিস্ট লবি তড়িঘড়ি করে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি নামক প্রকল্প নিয়ে টাকা দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে ফিলিস্তিনিদের মাথা কিনে ফেলার চক্রান্ত করেছিল। গত বছরের মাঝামাঝিতে এই প্রকল্পের দূরভিসন্ধি ফাঁস হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই তা ফিলিস্তিনসহ আরবদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হলে এক নতুন বাস্তবতার অভ্যুদয় হয়। যে করেই হোক, ২০২০ সালের মধ্যে জায়নিস্ট ইসরাইলের জন্য আরো একশ বছরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার টার্গেট পুরণে মার্কিন ওয়ারমঙ্গার ও জায়নিস্ট সম্প্রসারণবাদীরা মরিয়া হয়ে নানা বøু-প্রিন্ট বাস্তবায়ন করে চলেছে। বছরের প্রথম দিনে বাগদাদ বিমানবন্দরে ইরানের অভিজাত বাহিনী আল-আকসা ব্রিগেডের প্রধান কাশেম সুলাইমানিকে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা মিশনের মধ্য দিয়ে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে রেডলাইন বা বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। কাসেম সুলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইরাকে একাধিক মার্কিন সেনাঘাটি ইরানের মিসাইল হামলার শিকার হয়েছে। সে সব হামলার ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংস ক্ষমতা ছিল মার্কিনীদের ধারণার বাইরে। এরপর থেকে পুরো বছরই ইরানের সাথে মার্কিনীদের হুমকি-ধামকি ও উত্তেজনায় উত্তপ্ত ছিল। মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরিসহ ২০২০ সালের মধ্যে নতুন শতকের সূচনা কার্যক অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় ট্রাম্পের ট্রানজিশন চুড়ান্ত হওয়ার আগেই ইরানের সাথে একটি যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির বেপরোয়া তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে।

সমরাস্ত্র বা অর্থনীতি নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ বা স্টেটম্যান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি এবং দক্ষ-অভিজ্ঞ ও উচ্চপ্রশিক্ষিত সেনা কমান্ডাররাই হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির মূল স্তম্ভ। তবে জায়নবাদি ইসরাইল প্রতিপক্ষ মুসলমানদের মধ্যে অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, সামরিক কমান্ডার ও বিজ্ঞানীদের টার্গেট কিলিং করার পাশাপাশি ফিলিস্তিনের ভবিষ্যত প্রতিরোধ ঠেকাতে প্রতিদিন ফিলিস্তিনী শিশু ও নারীদেরও হত্যা করছে। পুরো বিশ্বে এ ধরনের টার্গেট কিলিংয়ে ফিলিস্তিনের ইসরাইল বার্ডারের কোনো তুলনা নেই। ইসরাইলীদের কাছে ফিলিস্তিনী শিশুদের জীবনের মূল্য ¯œাইপার রাইফেলের গুলির মূল্যের চেয়ে বেশি নয়। তবে ইরান, হামাস বা হেজবুল্লাহর কমান্ডার বা টেকনিক্যাল ব্যক্তিদের হত্যার জন্য তারা কোটি কোটি ডলার খরচ করে থাকে। গত এক দশকে ইরানের প্রায় ১০জন বিজ্ঞানী ও সেনা কর্মকর্তাকে সেটেলাইট নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তির সাহায্যে হত্যা করেছে ইসরাইল। গত জানুয়ারিতে ড্রোন হামলায় কাশেম সুলাইমানি হত্যার ঘটনাটি স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং দুই দেশের যুদ্ধ বাঁধানোর মত উস্কানিমূলক। ইরানের বিচক্ষণ নেতৃত্ব সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর উস্কানি সব সময়ই পরিহার করে এসেছে। তবে ট্রাম্পের বিদায়ের আগে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের একটি যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির টার্গেট এখনো অব্যাহত আছে। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ইরানের ইসলামি রেভ্যুলেশনারি গার্ড বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ও বিশিষ্ট নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট মোহসেন ফাখরিজাদেহকে সেটেলাইট নিয়ন্ত্রিত মেশিনগানের সাহায্যে হত্যা করেছে ইসরাইলী বাহিনী। ইতিপূর্বে কোয়ান্টাম ফিল্ড ও এলিমেন্টারি পার্টিকেল ফিজিসিস্ট মাসুদ আলি মোহাম্মাদি, পরমানু বিজ্ঞানী মাজিদ শাহরিয়ারি, দারিউশ রেজাইনেজাদ, মোস্তফা আহমাদি রোশানকে হত্যা করা হয়েছে। ইরানি অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের সাবেক প্রধান ফেরিদুন আব্বাসি টার্গেটেড আক্রমন থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হয়েছেন। ইরানে অবস্থান নিয়ে মোসাদের এজেন্ট হিসেবে অ্যাসাসিনেশন প্রোগ্রামের সাথে জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারের দাবি করেছিল ইরান কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালন বলেছিলেন, ইরানের পারমানবিক ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা নিবৃত্ত করতে তারা সম্ভাব্য সবকিছুই করবে। এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো রাখঢাক নেই। ইরানের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে তারা সব ফ্রন্টে সর্বোচ্চ আক্রমন চালিয়ে যাচ্ছে। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলী আক্রমণ এখন তার সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বহাল থাকতেই ইসরাইলকে ইরান আক্রমণে প্ররোচনা অব্যাহত রয়েছে।

ইরান আন্তজার্তিক পারমানবিক অস্ত্র নিরোধ(এনপিটি) চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ। অস্ত্র পরিদর্শক দল নিয়মিত ইরানের পরমাণু প্রকল্পগুলো পরিদর্শন করছে। এসব অস্ত্র পরিদর্শকদের মধ্যে মোসাদের গুপ্তচর থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাদের মাধ্যমে ইরানের সামরিক স্থাপনা ও গবেষণা প্রকল্পের গোপণীয়তা ফাঁস হয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কায় বিভিন্ন সময়ে অস্ত্র পরিদর্শকদের সহযোগিতা না করার ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সমঝোতা ও চুক্তি রক্ষার্থে তারা কখনোই সহযোগিতা পুরোপুরি বন্ধ করেনি। অন্যদিকে ইসরাইল কখনোই পারমানবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। ইসরাইলের হাতে দুই শতাধিক পারমানবিক বোমা থাকার কথা সবাই চেপে রাখতে চায়। আরব ফিলিস্তিনীদের জমি ও বাড়িঘর দখল করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৭০ বছরে ইসরাইল তার সব প্রতিবেশৗর উপর বার বার সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। অন্যদিকে হাজার বছরের ঐতিহাসিক ও সা¤্রাজ্যবাদী ঐতিহ্যের ্উত্তরাধিকার হয়েও ইরান তার কোনো প্রতিবেশিকে আক্রমন করেনি। ইঙ্গ-মার্কিনী প্ররোচনায় সংঘটিত ৮ বছর ইরান-ইরাক যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ফলে ইরাক কার্যত দেউলিয়া হয়ে যায়। ঋণশোধ করতে কুয়েত দখলের পরিকল্পনায় গোপণে মদত দিলেও কুয়েত মুক্ত করতে প্রথম গাল্ফ ওয়ারের সূচনা করে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী। এরপর থেকেই ইরানের পরমানু বোমা নিয়ে ইসরাইলের বাগাড়ম্বর বেড়েই চলেছে। প্রায় ৫০ লাখ ইসরাইলী ইহুদির নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ৫ কোটি মুসলমানের জীবনকে দুর্বিসহ ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলার অবিমৃষ্যকারি তৎপরতা চলছে। ক্ষুদ্র অবৈধ রাষ্ট্রটিকে শত শত পারমানবিক বোমার মজুদ গড়ে তোলার সুযোগ দিয়ে এখন এনপিটিতে স্বাক্ষরকারি দেশ ইরানের পারমানবিক অস্ত্র প্রকল্পের মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইরান আক্রমনের পাঁয়তারা করছে। ছয় বিশ্বশক্তির সাথে ইরানের পারমানবিক সমঝোতা চুক্তিটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারা স্বীকৃত সমর্থিত হয়েছিল। কিন্তু নেতানিয়াহুর ইসরাইল এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ক’টনৈতিক সাফল্য বা সমঝোতা চায়না। তারা ইরানের সাথে যুদ্ধ এবং ধ্বংস চায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ করে সংঘটিত ইরান বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তুরস্কের পর মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র আত্মময্র্াদাশীল রাষ্ট্র হয়ে উঠে ইরান। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হওয়ায় কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকলেও ইরানের উপর পশ্চিমাদের ততটুকু নিয়ন্ত্রণ নেই। চল্লিশ বছর ধরে পশ্চিমা অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা নিয়েই সব ক্ষেত্রে ঈর্ষনীয় সাফল্য নিয়ে টিকে থাকা ইরানকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বড় হুমকি বলে আখ্যায়িত করে চলেছে। ইসরাইল যখন মুসলমানদেরকে শত্রæ হিসেবে গণ্য করছে, সেখানে ইসরাইলের হাতে থাকা শত শত পারমানবিক বোমার বিপদ সম্পর্কে কেউ কিচ্ছু বলছেনা !

গত ৭০ বছর ধরে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের আনহোলি এলাইনমেন্ট মধ্যপ্রাচ্যে একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইস্টার্ন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ডিরেক্টর প্রফেসর মাজিদ শরিফি’র লেখা ‘ইনসিকিউরিটি কমিউনিটিজ ইন সাউথ এশিয়ান এন্ড মিডলইস্ট’ গ্রন্থে লেখক দেখিয়েছেন কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসির আওতায় মূলত মুসলমান প্রধান রাষ্ট্রগুলো সিস্টেমেটিক ইনসিকিউরিটি বা কৌশলগত নিরাপত্তাহীনতার শিকার হচ্ছে। বইয়ের শিরোনাম থেকে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, মার্কিন সিস্টেমেটিক ইনসিকিউরিটি এজেন্ডা এখন আর শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যেই কেন্দ্রীভুত নয়, এটি এখন দক্ষিন এশিয়ায়ও বিস্তৃত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম কমিউনিটির বাস ভারতে, এ কারণে ভারতের মুসলমানদের নিরাপত্তাহীনতার নিগড়ে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এটি এমন সময় থেকে শুরু হয়েছে, যখন ভারত তার ট্রাডিশনাল মিত্র রাশিয়ার সাথে কৌশলগত মৈত্রীর বন্ধনকে শিথিল করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সাথে নতুন ভ’-রাজনৈতিক ও স্ট্রাটেজিক সম্পর্কের গাঁটছড়া বেঁধেছে। কাশ্মিরে এখন গাজা ও ফিলিস্তিনের ছায়া। সেখানকার যুবক ও শিশুরা এখন সিস্টেমেটিক কিলিংয়ের শিকার হচ্ছে। পাক-ভারত সীমান্তের উত্তেজনায় সরাসরি ইসরাইলী বাহিনীর অংশগ্রহণের তথ্য উঠে আসতে দেখা যায়। এর মানে হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার দুটি পারমানবিক শক্তিধর দেশের মধ্যকার সীমান্ত সংঘর্ষকে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে পরিনত করার চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরাইল ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্ররা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর গত ৭০ বছরে ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা বাদ দিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব যুদ্ধই হয়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে।

একদিকে ইসরাইলের মরুভ’মিতে সভ্যতা ধ্বংসকারী মারণাস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে এবং মাঝে মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের উপর এসব অস্ত্র প্রয়োগ করে এর কার্যকারিতা ও সক্ষমতা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এভাবেই প্রক্সি ওয়ার, ফল্স ফ্লাগ ও চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে বছরে হাজার হাজার মুসলমানের মৃত্যু হচ্ছে। নিজেদের অনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মধ্যপ্রাচ্যের এক শ্রেণীর শাসক পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী ও জায়নিস্টদের সাথে আঁতাত করে মধ্যপ্রারেচ্যর উপর তাদের অবৈধ হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার সুযোগ অবারিত করে রেখেছে। পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এতদিনের গোপনীয়তা ও রাখঢাক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এখন সউদী আরবও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা ভাবতে শুরু করেছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে শুধুমাত্র ইরান ও তুরষ্ককেই কথা বলতে শোনা যাচ্ছে। মানবতার শত্রæ ইসরাইলের হাতে থাকা শত শত পারমানবিক বোমার ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিরবতা ভাঙ্গতে হবে। এনপিটিতে স্বাক্ষরকারী ইরানের পারমানবিক প্রকল্পের চেয়ে ইসরাইলের পরমাণু বোমা অনেক বেশি অনিরাপদ, ধ্বংসাত্মক এবং মানব সভ্যতার জন্য বড় হুমকি। এই একটি হুমকির বিষয়ে বিশ্বসম্প্রদায় যথাযথ ভ’মিকা পালন করলেই বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা অনেক বেশি সহজলভ্য হতে পারে। মুসলমান বিজ্ঞানী, গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমরবিদদের হত্যা করার যে মিশন ইসরাইল বাস্তবায়ন করছে, তা খুবই ভয়ঙ্কর। এর মধ্য দিয়ে প্রমান করছে, জায়নিস্টরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি অন্তহীন যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। নাইন-ইলেভেন রহস্যময় বিমান হামলার পর সে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে। জেরুজালেম ও ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধোনের ভবিষ্যত সম্ভাবনাকেও ধ্বংস করাই ছিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর প্রধান এজেন্ডা। এ জন্য তারা ইরানের বিরুদ্ধে একটি পারমানবিক যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে। সম্ভবত: একটি পারমানবিক ইরানই পারে নিজেকে পারমানবিক হুমকি থেকে রক্ষা করতে। বছরের প্রথম দিনে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরান তার সবচেয়ে চৌকষ সেনা কমান্ডারকে হারিয়েছে, বছরের শেষ প্রান্তে এসে ইসরাইলীদের সেটেলাইট নিয়ন্ত্রিত মেশিনগানে তার শ্রেষ্ঠ পরমাণু বিজ্ঞানীকে হারাল। জায়নিস্টদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে এরা মুসলমান ও মধ্যপ্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ মানব সম্পদ। এরা আর কতদিন এভাবে নি:শেষ হয়ে যেতে থাকবেন?

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
Khalil Rahman ৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ১:০৮ এএম says : 0
ইরান কে আল্লাহ সাহায্য করুন। ইরানকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে ইসরাইল। সৌদি আরব হচ্ছে ইয়াহুদিদের দালাল সুবিধাবাদী। সৌদি ক্ষমতা লোভী।
Total Reply(0)
সজল মোল্লা ৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ৭:২৩ এএম says : 0
তথ্যবহুল একটি প্রবন্ধ। লেখককে ধন্যবাদ।
Total Reply(0)
হোসাইন এনায়েত ৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ৭:২৩ এএম says : 0
বিশ্ব সম্প্রদায় তেলা মাথায় তেল দিতে জানে।
Total Reply(0)
গাজী মোহাম্মদ শাহপরান ৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ৭:২৪ এএম says : 0
মুসলিম বিশ্বের সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের দিকে চেয়ে না থেকে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে হবে।
Total Reply(0)
মো;তাওসিফ খান ৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ৯:৫৭ এএম says : 0
বর্তমান বিশ্বে অবস্থা হচ্ছে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হাওয়ার মতো কিন্তু এই ভংঙ্কার পরিস্থিতে ইসরাইল ও আমেরিকার গোয়েন্দা ফাদে পা দিয়ে মুসলিমরা একে বারে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে । কিন্তু আমাদের এই বিভক্ত হাওয়ার ফলে আমারা অথ্যাৎ মুসলিম বিশ্ব একের পর এক বু্দ্ধিজীবি হারাচ্ছি ।আর এভাবে ইরাক ,সিরিয়া লিবিয়া , আফগানস্থান ,লেবানন এর মতো অসংখ্য দেশ ধংস হয়ে যাচ্ছে । আর এর ভিতর দিয়ে আমরা হারাচ্ছি এক একজন বিশ্ব কোষ সম্পন্ন ব্যাক্তি । এখন আমাদের উচিত ইরান সাথে বিভিন্ন চুক্তি করে তাদের ও আমাদের অর্থনেতিক ভাবে উন্নতি করা। কারন অর্ননৈতিক ভাবে শক্তিশালী হলে ইসরাইল ও আমেরিকার সাথে টেক্কা দেওয়া যাবে ।
Total Reply(0)
Shafiqul Islam ৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ১১:১৫ এএম says : 0
মোঃ তাওসিফ খান এর মন্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করছি।
Total Reply(0)
এম আর ইমন ৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ৩:৫৬ পিএম says : 0
তথ্য বহুল লেখাটি পড়ে অনেক জ্ঞান অর্জন করলাম।ধন্যবাদ লেখককে।আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি,ইরান ও তুরস্ক যেন স্ব স্ব দর্পে জোট বেঁধে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকে কিয়ামত পর্যন্ত।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন